১৩ ডিসেম্বর, সোমবার, ১৯৭১

আজ আটটা-দুটো কারফিউ নেই। আমার বাজার ও রান্না দুই-ই সারা আছে, তবু শরীফের কথামত আরো চাল, ডাল, লবণ, তেল, বিস্কুট ইত্যাদি কেনার জন্য বাজারে বেরুলাম। শরীফ গাড়ি নিয়ে অফিসে গেল, জামী বাবার কাছে থাকল, আমি লুলুকে নিয়ে প্রথমে মা’র বাসায় যাবার জন্য বেরিয়ে দেখি রিকশা পাওয়া মুশকিল। সব রিকশাই বোঁচকা-বুঁচকি-সুটকেসসহ যাত্রী নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। কোথায় ছুটছে, কে জানে। বেশ খানিকটা হেঁটে একটা খালি রিকশা পেলাম। ওটাকে আর ছাড়লাম না।
Jahanara Imam
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ছবি: সংগৃহীত

আজ আটটা-দুটো কারফিউ নেই। আমার বাজার ও রান্না দুই-ই সারা আছে, তবু শরীফের কথামত আরো চাল, ডাল, লবণ, তেল, বিস্কুট ইত্যাদি কেনার জন্য বাজারে বেরুলাম। শরীফ গাড়ি নিয়ে অফিসে গেল, জামী বাবার কাছে থাকল, আমি লুলুকে নিয়ে প্রথমে মা’র বাসায় যাবার জন্য বেরিয়ে দেখি রিকশা পাওয়া মুশকিল। সব রিকশাই বোঁচকা-বুঁচকি-সুটকেসসহ যাত্রী নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। কোথায় ছুটছে, কে জানে। বেশ খানিকটা হেঁটে একটা খালি রিকশা পেলাম। ওটাকে আর ছাড়লাম না।

মা’র বাসায় গিয়ে দেখি ওঁর খালি একতলাটায় লালুর বান্ধবী আনোয়ারা সপরিবারে এসে উঠেছে। ওরা পোস্তাগোলার দিকে থাকে, ওখান থেকে ভয় পেয়ে এ পাড়াতে চলে এসেছে। ওদের দেখে নিশ্চিত হলাম। যাক মা’র জন্য আমাকে আর অত ভাবনা করতে হবে না।

ওই রিকশা নিয়েই বাজার সেরে বাসায় আসতে আসতে বারোটা। যদিও ফ্রিজে রান্না করা মাছ-তরকারি আছে, তবু আরো মাছ-গোশত্ কিনে এনেছি। আবার কখন চব্বিশ ঘন্টার কারফিউ দেয়, কে জানে। রান্নাঘরে তিনটে চুলো ধরিয়ে গোশত, মাছ আর ভাত বসালাম। একটু পরে শরীফ এলো অফিস থেকে। রান্নাঘরে একবার মাত্র উঁকি দিয়েই ছাদে চলে গেল। দেখেই আমার রাগ হল। চেঁচিয়ে জামীকে ডেকে বললাম, ‘দাদাকে গোসলখানায় নিয়ে যাও। গোসল হলে ভাত খাওয়াও। খবরদার এখন ছাদে যাবে না। খুনোখুনি হয়ে যাবে তাহলে।’

দুপুরে টেবিলে খেতে বসে আমি একটাও কথা বললাম না। ওরাও সব চুপ। দেড়টা বেজে গেছে। দুটোয় কারফিউ শুরু। খেয়ে উঠেই লুলু চলে গেল।

আমি দু’হাতে ডাল ও গোশতের বাটি তুলে প্যান্ট্রিতে রেখে আবার এঘরে আসতেই দেখি, রেডিও বগলে শরীফ গুটিশুটি সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। তার পিছু পিছু জামী। দিনে দিনে ওদের স্বার্থপরতা বাড়ছে। আগে তবু নিচে থাকত, সাইরেন বাজলে কিংবা প্লেনের শব্দ পেলে তখন দুদ্দাড় উঠে যেত এখন তাও করে না। আগে থেকেই উঠে গিয়ে বসে থাকে। দাঁত কিড়মিড় রাগের মধ্যেই হঠাৎ খেয়াল হল আরে! আমিই তো শরীফকে বলেছি সবসময় অমন দুদ্দাড় করে সিঁড়ি না ভাঙ্গতে- ভাত খাওয়ার পর তো নয়ই। ওতে শরীরের ক্ষতি হতে পারে।

একা একাই হেসে ফেললাম। কি যে ছেলে মানুষের মত রাগ করি। যুদ্ধের টেনশান আমারও মন মাথায় ঢুকে গেছে দেখছি।

তাছাড়া শরীফেরও তো কষ্ট কম নয়। আগষ্ট মাসে পাক আর্মি ওর ওপর যে টর্চার করেছিল, তারপর থেকে ওর শরীরটা আর আগের মত নেই। যদিও অফিস করছে, আমার সঙ্গে পাগলা বাবার বাসায় যাচ্ছে, টেনিস খেলছে, শত্রুর নাকের ডগায় বসে বিপজ্জনক কাজ-কারবার বিলি বন্দোবস্ত চালিয়ে যাচ্ছে, তবু ক্রমাগত ওঁর ওজন কমে যাচ্ছে। আজকের দুপুরে খাবার সময় ওর মুখটা বিষণ্ন দেখাচ্ছিল।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে দোতলায় উঠে বাথরুমে ঢুকলাম। দু’দিন গোসল করা হয় নি, গোসলটা সেরেই ছাদে রোদে গিয়ে বসবো। যদিও সব ব্যবস্থা নিচেই, তবু নিজের বাথরুমে গোসল না করলে আমার তৃপ্তি হয় না। তাই প্লেনের কড়কড়ানি থাকলেও সেটা খানিকক্ষণের জন্য উপেক্ষাই করি।

বেডরুমে আমাদের ডবল খাটে ছোবড়ার জাজিম উদোম হয়ে পড়ে রয়েছে। ওপরের পাতলা তোষক, চাদর, বালিশ, সব নিচে। আজ ভোরে ফজরের নামাজের পরে আমরা দু’জনে খানিকক্ষণের জন্য এই খসখসে ছোবড়ার গদির ওপর এসে শুয়েছিলাম।

গোসল সেরে বেডরুমে পা দিয়েই চমকে গেলাম। শরীফ ছোবড়ার গদির ওপরে এলোমেলোভাবে উবুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। ছুটে ওর কাছে গিয়ে বললাম, ‘কি হয়েছে? এখানে এমনভাবে শুয়ে কেন?’

শরীফ খুব আস্তে বলল, ‘বুকে ব্যাথা করছে। নিশ্বাস নিতে পারছি না।’

পিঠে হাত দিয়ে দেখলাম ঘামে গেঞ্জি-সার্ট ভিজে সপসপ করছে। ওগুলো খুলে গা মুছিয়ে শুকনো জামা পরিয়ে দিলাম। তারপর ফোন তুলে ডাঃ এ. কে. খানকে ডাকলাম। উনি সঙ্গে সঙ্গে ওঁর ডাক্তারি ব্যাগ নিয়ে চলে এলেন।

স্টেথেস্কোপ দিয়ে শরীফকে পরীক্ষা করতে করতে জিগ্যেস করলেন, ‘পা ঝিনঝিন করছে কি? ঘাম হয়েছিল?’

শরীফ বলল, ‘পা ঝিনঝিন করছে।’

আমি বললাম, ‘ঘামে একেবারে নেয়ে উঠেছিল। এই দেখুন আবার ঘামছে।’

এ. কে. খানের মুখ গম্ভীর হলো। ব্যাগ থেকে একটা অ্যামপুল বের করে শরীফকে ইনজেকশান দিলেন। তারপর বললেন,‘এটা ওর প্রথম হার্ট অ্যাটাক। এটার জন্য যে ওষুধ দরকার, তা আমার কাছে ছিল, দিয়েছি। কারো কারো দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাক খুব তাড়াতাড়ি হয়। সে রকম হলে আমার কাছে আর ওষুধ নেই। সুতরাং সময় থাকতে হাসপাতালে রিমুভ করাই ভালো।’

বাঁ পাশের বাড়ির প্রতিবেশী ডাঃ রশীদ পিজি-র সুপারিন্টেন্ডেন্ট। ওঁকে ফোন করে পি.জি.তে শরীফের ভর্তির ব্যবস্থা এবং এম্বুলেন্সের জন্য অনুরোধ করলাম।

কে জানে ক’দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। এ. কে. খান বললেন, ‘কিছু কাপড়জামা, বিস্কুট, এক বোতল পানি, মোমবাতি, টর্চ এগুলো গুছিয়ে সঙ্গে নিন।’

শরীফ বলল, ‘বাঁকা আর মঞ্জুরকে ফোন করে খবরটা দাও। বাঁকা কিন্তু উয়ারীতে থাকছে না। ওকে অফিসের তিনতলার ফোনে পাবে।’

ফোন ঘুরালাম। মঞ্জুরের ফোন এনগেজড, বাঁকার ফোন কেউ ধরছে না। এম্বুলেন্স এসে গেছে। এ. কে. খানও আমাদের সঙ্গে হাসপাতালে যাবেন বলছেন। সানু এসে রাতে এ বাড়িতে থাকবে। কারণ বাবা বেশি বুড়ো, অথর্ব। আর জামী ছেলেমানুষ। রাতে আবার যদি কিছু হয়, জামী একা সামাল দিতে পারবে না।

এখন বিকেল পাঁচটা। এলিফ্যান্ট রোডের নির্জন রাস্তা দিয়ে এম্বুলেন্স ছুটে চলেছে। সন্ধ্যার অন্ধকার দ্রুত চারদিক ঢেকে ফেলেছে। এরই মধ্যে পশ্চিম আকাশের লালচে রঙটা কেমন যেন ভয়াবহ দেখাচ্ছে। চারদিকে ফুটফাট শব্দ হচ্ছে- বন্দুকের, গ্রেনেডের। মাঝে-মাঝে ঠাঠাঠাঠা- মেশিনগানের। প্লেনের আনাগোনা কেন জানি খানিকক্ষণ নেই বললেই চলে। মাঝে-মাঝে জীপ বা মাইক্রোবাস হুশ করে চলে যাচ্ছে।

শরীফকে পি.জি.র তিনতলায় ইনটেনসিভ কেয়ার ওয়ার্ডের সামনে তোলা হয়েছে। ভেতরে বেড রেডি করা হচ্ছে, শরীফ বারান্দার মেঝেয় স্ট্রেচারের ওপর শুয়ে। তার বাঁ পাশে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে আমি তার হাত ধরে রয়েছি। ডান পাশে দাঁড়িয়ে এ. কে. খান আর পি.জি.র ডিরেক্টর প্রফেসর নুরুল ইসলাম।

প্রফেসর ইসলাম আমাদেরও বেশ ঘনিষ্ট পরিচিত। উনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বলে দিচ্ছেন : ধোপার ধোয়া চাদর যেন বের করে পাতা হয়, কম্বল যেন পরিষ্কার দেখে দেওয়া হয়। কোনদিক দিয়ে যত্নের যেন ত্রুটি না হয়।

ইনটেনসিভ কেয়ার ওয়ার্ডের ডাক্তার, নার্স ও ওয়ার্ড বয়দের স্পেশাল কেয়ার নেবার নির্দেশ দিয়ে প্রফেসর নুরুল ইসলাম দোতলায় নেমে গেলেন। দোতলার কেবিনগুলোতে পি.জি.র অনেক ডাক্তার সপরিবারে এসে উঠেছেন। প্রফেসর ইসলামও তাঁর ফ্যামিলি নিয়ে একটা কেবিনে আছেন।

দেখতে দেখতে গোধূলির আবছায়া মুছে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। ইনটেনসিভ কেয়ার ওয়ার্ডের কাচের জানালাগুলো বিরাট বিরাট- সব দরজার মাপের। কোন কাচে কাগজ লাগানো নেই, পর্দাগুলো টেনে ঠিকমত ঢাকা যায় না- কোনখানে পর্দাও নেই।

শরীফকে তার পরিষ্কার চাদরপাতা বেডে তোলা হয়েছে। এর মধ্যেও শরীফ আমাকে বলছে, ‘মঞ্জুরকে ফোন করে খবরটা দাও।’ এ. কে. খান বলছেন, ‘শরীফ একদম কথা বলবে না। চুপচাপ রেস্টে থাক।’

অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি আমার ব্যাগ থেকে একটা মোমবাতি বের করে জ্বালাতেই পি.জি.র কর্তব্যরত ডাক্তার হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘বন্ধ করুন। নিচের গার্ডরা দেখলে চিল্লাচিল্লি করবে।’

আমি হকচকিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে বললাম, ‘কিছু যে দেখা যাচ্ছে না, কাজ করবেন কি করে?’

‘টর্চ আছে? টর্চ থাকলে দিন।’ অন্য একজন ডাক্তার বললেন, ‘গার্ডগুলো এমন হারামী না, বাতি দেখলেই ওপর মুখ করে গুলি ছুড়ে বসে।’

শরীফ বলল, ‘আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেন...’

‘অক্সিজেন সিলিন্ডার আনতে গেছে। বুঝলেন, অক্সিজেনের একটু ঘাটতি আছে।’

এখন প্রায় সাড়ে ছ’টা বাজে। এখনো অক্সিজেন এল না। শরীফের শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ডাঃ এ. কে. খান ওর নাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। শরীফ বলল, ‘অক্সিজেনের জন্য মঞ্জুরকে ফোন কর। ও যোগাড় করে দিতে পারবে। ডাঃ এ. কে. খান বললেন, ‘কথা বোলো না। একদম চুপচাপ রেস্টে থাক।’

অক্সিজেন সিলিন্ডার একটা নিয়ে এল ওয়ার্ড বয়। কিন্তু সিলিন্ডারের মুখের প্যাঁচটা খোলার রেঞ্চটা আনে নি।

‘রেঞ্চ কই? রেঞ্চ আনো, শিগরির।’ একজন ডাক্তার চেঁচিয়ে উঠলেন।

‘রেঞ্চ তো স্যার দুইতলায় নিয়া গেছে।’

হাত দিয়ে সিলিন্ডারের মুখের প্যাঁচাটা ঘোরাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে কর্তব্যরত ডাক্তার আবার চেঁচিয়ে উঠলেন,‘এ ওয়ার্ডের রেঞ্চ কেন দোতলায় দেওয়া হয়েছে? দৌড়াও, রেঞ্চ নিয়ে এস।’

অন্ধকারে সাবধানে হোঁচট বাঁচিয়ে ওয়ার্ড বয়টা দৌড়াল।

শরীফ খুব ছটফট করছে। এ. কে. খান তাকে আশ্বস্ত করার জন্য বারবার মৃদুকন্ঠে বলছেন, ‘একটু ধৈর্য ধরে চুপচাপ থাকো শরীফ। একদম কথা বলো না, নোড়ো না। এখনি সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

শরীফ ছটফটানির মধ্যেই আবার জিগ্যেস করল, ‘মঞ্জুরকে ফোন করতে পেরেছ।’

আমার কান্না পাচ্ছে। এই অন্ধকারে কোথায় ফোন কোনদিকে যাব? আমার আনা টর্চটা নিয়েই ডাক্তাররা কি কি যে করছে, কিছুই বুঝি না।

একজন ডাক্তার হঠাৎ এ. কে. খানকে বলল, ‘স্যার পেশেন্টকে পাশের ছোট ঘরটাতে নিয়ে যাই, ওখানে জানালা নেই, মোমবাতি জ্বালানো যাবে। ওখানে ডিফিব্রিলেটার মেশিনটা আছে।’

অতএব, আবার শরীফকে স্ট্রেচারে তুলে টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে পাশের ছোট ঘরটাতে নেওয়া হল। ঘরটা আসলে অন্য একটা ঘরের কিছুটা অংশ পার্টিশন করা- সরু অংশ। একটা মাত্র বেড, বেডের পাশে একটা মেশিন। দু’পাশে এত কম জায়গা দু’তিনজন লোক কোনমতে দাঁড়াতে পারে। এখানে এসে একটা মোমবাতি জ্বালালাম।

শরীফকে বেডে তোলা হল। আমি ফোনের খোঁজে দরজা দিয়ে বারান্দায় এসে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার দেখে হতাশ হয়ে আবার ঘরের ভেতরে ঢুকে তাকিয়েই আঁতকে উঠলাম। পি.জি.র কর্তব্যরত ডাক্তার দু’জন শরীফের বেডের দু’পাশে দাঁড়িয়ে হাতে করে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দিচ্ছেন। আমি এ. কে. খানকে জিগ্যেস করলাম, ‘মেশিনটা? মেশিনটা লাগাচ্ছেন না কেন?’

শরীফের বুকে হাতের চাপ দিতে দিতে একজন ডাক্তার বললেন, ‘লাগাব কি করে? হাসপাতালের মেইন সুইচ বন্ধ। ব্লাক আউট যে।’

‘হাসপাতালের মেইন সুইচ বন্ধ রেখে ব্ল্যাক আউট? এমন কথা তো জন্মে শুনি নি। তাহলে মরণাপন্ন রোগীদের কি উপায় হবে? লাইফ সেভিং মেশিন চালানো যাবে না?’

আরও পড়ুন:

১২ ডিসেম্বর, রবিবার, ১৯৭১

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago