ঘরোয়া ফুটবলের কাঠামোতে পরিবর্তন প্রয়োজন: জেমি ডে
২০২২ বিশ্বকাপ ও ২০২৩ এশিয়ান কাপের চলমান যৌথ বাছাইপর্বে র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা দলগুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। ব্রিটিশ কোচ জেমি ডে’র তত্ত্বাবধানে কাতার-ভারতের বিপক্ষে লড়াকু মনোভাব দেখিয়ে দেশের ফুটবলের সোনালি সময় ফিরিয়ে আনারও আভাস দিয়েছিলেন খেলোয়াড়রা। কিন্তু মাত্রই শেষ হওয়া দক্ষিণ এশিয়ান (এসএ) গেমসে ভরাডুবির পর ফের ফুটে উঠেছে নির্মম বাস্তবতা।
গেমসে অংশ নেওয়া অনূর্ধ্ব-২৩ দলে ছিলেন জাতীয় দলের ১৬ ফুটবলার। তারপরও নেপালের মাটিতে সোনা জিততে পারেনি বাংলাদেশ। তবে শঙ্কার মূল কারণ সোনার পদক জিততে না পারাটা নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ ক্রীড়াযজ্ঞে বাংলাদেশ যে ধরনের ফুটবলের প্রদর্শনী দেখিয়েছে সেটা।
সোনা জিততে না পারায় কোনো আক্ষেপ নেই ডে’র। তবে দল ফাইনালে উঠতে পারলে তার লক্ষ্য পূরণ হতো বলে তিনি জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে ডে দাবি করেছেন, এসএ গেমসে ফুটবলে বাংলাদেশ ব্রোঞ্জ জেতায় তিনি সন্তুষ্ট।
সোনার পদক প্রসঙ্গকে আমলে না নিলেও এসএ গেমসের বিবর্ণ পারফরম্যান্স ডে’কে বাধ্য করেছে দেশের ফুটবলের দর্শনে যেসব ত্রুটি আছে, সেগুলোর দিকে আঙুল তাক করতে। প্রায় দেড় বছর আগে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবারের মতো তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন ঘরোয়া ফুটবল কাঠামোকে।
‘দ্য ডেইলি স্টার’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ৪০ বছর বয়সী ডে দেশের ফুটবলের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশ ও প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। তবে বরাবরের মতো শিষ্যদের গোল করতে না পারার পক্ষেও যুক্তি দিয়েছেন তিনি।
এসএ গেমসে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিয়ে সংক্ষেপে নিজের মতামত জানাতে গিয়ে ডে বলেছেন, ‘আমি মনে করি, প্রথম ম্যাচে (ভুটানের বিপক্ষে) আমরা আমাদের মান অনুযায়ী খারাপ খেলেছি। সে তুলনায় বাকি তিন ম্যাচে আমরা অনেক ভালো খেলেছি এবং আমি পারফরম্যান্স নিয়ে সন্তুষ্ট। আমরা ফাইনাল খেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা হয়নি। (ব্রোঞ্জ) পদক পাওয়ায় আমি সন্তুষ্ট। যদি না পেতাম, আমি খুবই হতাশ হতাম।’
গোটা আসরে গোল পেতে বাংলাদেশের ফরোয়ার্ডদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। চার ম্যাচে মাত্র দুটি গোল করেন বুটাররা। ফলে পাঁচ দলের পয়েন্ট তালিকায় তৃতীয় হয়ে এসএ গেমস শেষ করে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ও মালদ্বীপের সঙ্গে ড্র করে ৪ পয়েন্ট পেয়েছিল লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। হারতে হয়েছিল স্বাগতিক ভুটান ও নেপালের কাছে।
ডে’র বিশ্লেষণ বলছে, গোল করায় ব্যর্থতা থেকে শিগগিরই মুক্তি মেলার কোনো সম্ভাবনা নেই, ‘যদি না আমরা ঘরোয়া ফুটবলের কাঠামোতে পরিবর্তন নিয়ে আসি, তাহলে গোল করা ইস্যুটা সবসময়ই বাংলাদেশের জন্য সমস্যা হয়ে থাকবে।’
পরিবর্তন কোথায় আনতে হবে তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি, ‘আমি মনে করি, (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে) প্রতি দলে বিদেশি খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমিয়ে দুইয়ে নামাতে হবে। সব দলের একাদশে ও ম্যাচের স্কোয়াডে অনূর্ধ্ব-২৩ বছর বয়সী খেলোয়াড় রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক সূচির সঙ্গে মিল রেখে লিগের মৌসুম পরিচালনা করতে হবে এবং (ঘরোয়া মৌসুমের সূচি) বারবার পাল্টানো যাবে না। মাঠের মান ও সুযোগ-সুবিধা উন্নত করতে হবে।’
ডে আরও বলেছেন, নির্ধারিত আন্তর্জাতিক বিরতির সূচির বাইরে জাতীয় দলের জন্য কোনো ম্যাচ আয়োজন করা যাবে না যেন ফুটবলাররা পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও টানা ম্যাচের ধকল কাটিয়ে ওঠার যথেষ্ট সময় পায়। তিনি আরও একটি লিগ আয়োজনের জোর দাবি করেছেন যেখানে তরুণ খেলোয়াড়রা মাঠে নামার সুযোগ পাবে ও নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারবে। কারণে ডে’র পর্যবেক্ষণ বলছে, ‘উঠতি ফুটবলাররা কেবল অনুশীলন করার সুযোগ পায়, খেলার সুযোগ পায় না।’
বাছাইপর্ব ও এসএ গেমসের পারফরম্যান্সে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে তুলনামূলক শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে পাল্টা-আক্রমণ কৌশল অবলম্বন করে ভালো ফল আদায় করতে পারলেও সমশক্তির দলগুলোর বিপক্ষে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে তেমন সুবিধা করতে পারে না বাংলাদেশ।
বিষয়টি মেনে নিয়েছেন ডে। তবে ঘরোয়া ফুটবলকেও এর জন্য দায়ী করেছেন তিনি, ‘যখন আমরা শক্তিশালী দলের বিপক্ষে খেলি, তখন আমাদেরকে হারানো কঠিন। আমরা খুব বেশি সময় বল দখলে পাই না। এটা আমাদের জন্য মানানসই। কিন্তু যখন আমরা সমশক্তির দলের বিপক্ষে খেলি, তখন আমরা বেশি সময় বল দখলে রাখতে পারি। কিন্তু সমস্যা হলো (ঘরোয়া লিগে) আমাদের ফুটবলাররা সঠিক পজিশনে খেলে না। তাই নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে তাদেরকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। তাছাড়া তখন জেতার প্রত্যাশা থাকে যা তাদের ওপর চাপ তৈরি করে।’
সবশেষে আরও একটি কঠিন সত্যকে সহজভাবে ব্যক্ত করেছেন এই ব্রিটিশ নাগরিক, ‘আমি মনে করি, (নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার ফুটবলাররা) তারা টেকনিক্যালি আমাদের চেয়ে ভালো। তবে এটা আমাদের খেলোয়াড়দের দোষ নয়। যখন তারা উঠতি খেলোয়াড় ছিল, তখন তাদেরকে সঠিকভাবে কোচিং করানো হয়নি। তাছাড়া ওই দেশগুলোতে অল্প বয়সীদের জন্য একাডেমিও আছে।’
Comments