গাম্বিয়ার মামলা, বাংলাদেশের যা অর্জন

স্থায়ী সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক দেশ মিয়ানমার। বর্তমানের অং সান সু চি সেই সামরিক স্বৈরাচারের পৃষ্ঠপোষক। ২০১৭ সালে মিয়ানমার যখন রোহিঙ্গা নিধন শুরু করে তখন অনেকেরই ভাবনা বিলাস ছিলো সব দোষ সামরিক বাহিনীর, সু চির নয়। সামরিক বাহিনীর চালানো হত্যাকাণ্ড দেখে সু চি প্রথম দিকে নীরব ছিলেন। তার এই নীরবতা ছিলো সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা ও দেশত্যাগে বাধ্য করা জঘন্য অপকর্মের সমর্থন।
নেদারল্যান্ডের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চি (বামে) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ। ছবি: সংগৃহীত

স্থায়ী সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক দেশ মিয়ানমার। বর্তমানের অং সান সু চি সেই সামরিক স্বৈরাচারের পৃষ্ঠপোষক। ২০১৭ সালে মিয়ানমার যখন রোহিঙ্গা নিধন শুরু করে তখন অনেকেরই ভাবনা বিলাস ছিলো সব দোষ সামরিক বাহিনীর, সু চির নয়। সামরিক বাহিনীর চালানো হত্যাকাণ্ড দেখে সু চি প্রথম দিকে নীরব ছিলেন। তার এই নীরবতা ছিলো সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা ও দেশত্যাগে বাধ্য করা জঘন্য অপকর্মের সমর্থন।

বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ নোবেল বিজয়ীরা বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে সু চিকে সোচ্চার হতে হবে। রোহিঙ্গা-নিধন বন্ধ করতে হবে। তা না হলে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সু চিকে পদত্যাগ করতে হবে। তখন বাংলাদেশেরও অনেককে সু চিকে ‘সংবেদনশীল’ আখ্যা দিয়ে নোবেল বিজয়ীদের সমালোচনা করতে দেখা গিয়েছিলো। হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে সু চির অবস্থান ও বক্তব্য নিশ্চয় তাদের চিন্তাজগতে পরিবর্তন আনবে। অন্যভাবে বলা যায় গান্বিয়ার মামলার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা হয়ত সু চিকে চিনতে পারলেন।

এর বাইরে বাংলাদেশের আর কী অর্জন?

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে বক্তব্য রাখার সময় সু চি ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)’র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। মিয়ানমার ইতোপূর্বে কখনো আরাকান রাজ্যের নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠীকে ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে পরিচিতি দিতে চায়নি। বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তার কোথাও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি লেখা হয়নি। মিয়ানমারের চাপেই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি বাংলাদেশ বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে। আরাকান রাজ্যের মানুষগুলোকে মিয়ানমার ‘মুসলিম জনগোষ্ঠী’ হিসেবে চিহ্নিত করে।

আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা গ্রামগুলো আগুন গিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার কথা এই প্রথম স্বীকার করেছে মিয়ানমার। খাদ্যের অভাবে রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়, সে কারণে খাদ্য সংকট তৈরির কথাও স্বীকার করেছে মিয়ানমার।

মিয়ানমার বোঝানোর চেষ্টা করেছে তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে। সেই অভিযানে সাধারণ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা যে যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে, স্বীকার করেছে মিয়ানমার। মিয়ানমার প্রমাণ করতে চেয়েছে সামরিক বাহিনী যুদ্ধাপরাধ করলেও, গণহত্যা করেনি। উদ্দেশ্য যে গণহত্যা ছিলো না, তা প্রমাণ করতে পারেনি মিয়ানমার। বলেছে, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো আকাশ থেকে যে ছবি তুলেছে তাতে গ্রাম পোড়ানোর ছবি দেখা গেলেও, গণকবরের ছবি দেখা যায়নি। গণহত্যা করেনি, অকাঠ্য প্রমাণ হিসেবে সামনে আনতে চেয়েছে তথ্যটি।

গণকবর পাওয়া যায়নি, তথ্য হিসেবে এটা অসত্য। ২০১৭ সালে হত্যাকাণ্ড শুরু করার কিছুদিন পর বেশকিছু গণকবরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গণকবরগুলোতে চার’শ মৃতদেহ পাওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো। তখন মিয়ানমার বিষয়টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বলেছিলো, এসব হিন্দু জনগোষ্ঠীকে ‘আরসা’ হত্যা করে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছিলো। হত্যাকাণ্ড যে ‘আরসা’ করেছিলো, তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি মিয়ানমার। হত্যা ও গণকবর যে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী করেছিল আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এপি’র সূত্র উল্লেখ করে বিবিসি বাংলা সংবাদ প্রকাশ করেছিলো-

“স্যাটেলাইটে পাওয়া চিত্রের সাথে এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বর্ণনা মিলে যাচ্ছে। স্যাটেলাইটের চিত্র এবং রোহিঙ্গাদের ভাষ্য অনুযায়ী অন্তত পাঁচটি গণকবরের সন্ধান মিলেছে। এসব গণকবরে ৪০০‘র মতো মানুষকে চাপা দেয়া হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।” (১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)।

এই তথ্যটি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়ার জোরালোভাবে উপস্থাপন করা দরকার ছিলো। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে গাম্বিয়াকে সহায়তা করতে পারতো।

আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণ-বিতাড়ন-হত্যাকাণ্ড ঘটানোর আগে-পরে থেকে সম্পূর্ণভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। ‘আরসা’ নামক রোহিঙ্গাদের সংগঠনটিকে মিয়ানমার যতোটা শক্তিশালী হিসেবে দেখাতে চায়, তার সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ‘আরসা’র দৃশ্যমান কোনো উপস্থিতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কখনো খুঁজে পায়নি। যেটা পাওয়া গেছে ‘আরাকান আর্মি’র ক্ষেত্রে। উল্লেখ্য, ‘আরাকান আর্মি’র অবস্থান মূলত থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তে। বাংলাদেশ সীমান্তে ‘আরাকান আর্মি’র তেমন কোনো তৎপরতা নেই বললেই চলে।

‘আরসা’, ‘আরাকান আর্মি’সহ আরও বেশ কয়েকটি সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনী গড়ে ওঠার সম্পূর্ণ দায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর। দীর্ঘ বছর ধরে তারা ‘রোহিঙ্গা’, ‘কোচেন’সহ নানা জাতিগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। যার ফলস্বরূপ গড়ে উঠেছে এসব প্রতিরোধ বাহিনী।

রোহিঙ্গা গণহত্যা যে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী পরিকল্পিতভাবে করেছে, তার প্রমাণ সেনাপ্রধানের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। ধর্ষণ-গণহত্যা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের পর সেনাবাহিনীর বক্তব্য ছিলো, যে কাজ বহু আগে করার কথা ছিলো তা এখন করা হলো।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়ার মামলার পর মিয়ানমার সত্যিকার অর্থে চাপে পড়েছে। ১৯৭৭ সাল থেকে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করে বাংলাদেশে পাঠাতে শুরু করেছে। কখনো মিয়ানমার এমন চাপে পড়েনি। চাপে পড়ে মিয়ানমার যা কিছু স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে, তার থেকে প্রমাণ হয়েছে যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মামলা থেকে বাঁচার জন্যে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়টি সামনে আনছে। মিয়ানমারের এই অবস্থান অতীতের কূটকৌশল থেকে আলাদা, তা ভাবার কারণ নেই। তবে মিয়ানমারের অতীতের সুবিধাজনক অবস্থান এখন অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে। সুবিধাজনক অবস্থানে চলে এসেছে বাংলাদেশ।

গাম্বিয়া যেসব তথ্য প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করেছে, তাতে গণহত্যার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত অন্তর্বর্তী কোনো আদেশ দিলে, তা হবে মিয়ানমারের বিপদের কারণ। তাছাড়া মামলা যতো বছরই চলুক, গণহত্যা প্রমাণিত হলে ভয়াবহ বিপদে পড়ে যাবে সু চি ও জেনারেলরা। রায় যদি মিয়ানমার না মানে, নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব এনে বাধ্য করার সুযোগ আছে জাতিসংঘের। মিয়ানমার ভেবে নিতে পারে ভেটো ক্ষমতার দুই দেশ চীন ও রাশিয়া তাকে রক্ষা করবে। মিয়ানমারের এমন ভাবনার সত্যতা আছে। চীন ও রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে ইতোমধ্যে দুবার ভেটো প্রয়োগ করে মিয়ানমারকে বাঁচিয়েছে। মামলার ফল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তা করতে পারে।

তবে চীন ও রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দিলেও, পরিস্থিতি প্রায় সম্পূর্ণরূপে মিয়ানমারের প্রতিকূলেই চলে যাবে।

আমেরিকা ইতিমধ্যে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ চার জেনারেলের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করেছে। সু চিকেও অবরোধের আওতায় আনতে পারে আমেরিকা।

বিশ্বব্যাপী যে ‘বয়কট মিয়ানমার ক্যাম্পেইন’ চলছে, ইউরোপের দেশগুলো তা বেশিদিন উপেক্ষা করতে পারবে না। জনচাপে সু চি ও সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে ইউরোপ। উত্তর আমেরিকা-ইউরোপ বাতিল করতে পারে বাণিজ্যিক সুবিধা জিএসপি। এতে মিয়ানমারে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগকারী দেশ চীন ও জাপান বড় রকমের বিপদে পড়ে যেতে পারে। তেল-গ্যাস সম্পদ ছাড়া চীন অন্যান্য যা মিয়ানমারে উৎপাদন করছে, তা রপ্তানির বাজার উত্তর আমেরিকা-ইউরোপ। ইয়াঙ্গুনের পাশে জাপানের সনি-প্যানাসনিকসহ ২৪টি বৃহৎ কোম্পানি যে শিল্পপার্ক গড়ে তুলছে, তারও রপ্তানি বাজার হবে উত্তর আমেরিকা-ইউরোপ।

মিয়ানমার যে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারে, তা তারা আঁচ করতে পারছে।

মিয়ানমারের এখন প্রধান কৌশল হবে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি। চীন এক্ষেত্রে তাদের পাশে থাকবে। মিয়ানমার প্রমাণ করতে চাইবে, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের তারা ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে চীনের চাপ উপেক্ষা করে বাংলাদেশ কতোটা শক্ত অবস্থান নিতে পারবে, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের দৃশ্যমান সমর্থনও বাংলাদেশের জন্যে জরুরি ছিলো। বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত তা পায়নি। সামনে পাবে কী না, সেটাও দেখার বিষয়।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা এসেছে সাত থেকে আট লাখ। আগের আছে পাঁচ থেকে সাত লাখ। এখন ফিরিয়ে নেওয়ার আলোচনায় আছে সাত-আট লাখের বিষয়টি। চাপে পড়া মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশ পূর্বের পাঁচ-সাত লাখ রোহিঙ্গা ফেরতের বিষয়টি সম্পৃক্ত করতে পারে। ফেরত নেওয়ার চুক্তি যেনো কোনো অবস্থাতেই পূর্বের মতো মিয়ানমারের স্বার্থ রক্ষা করে না হয়, বাংলাদেশকে তা নিশ্চিত করতে হবে। চীনের চাপ মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে বাংলাদেশের।

কারণ- মনে রাখতে হবে, মিয়ানমার সত্যি সত্যি সব রোহিঙ্গা ফেরত নিতে চাইবে না। কয়েক’শ বা হাজার ফেরত নিয়ে পৃথিবীকে দেখাতে চাইবে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া শুরু করেছে মিয়ানমার।

বাংলাদেশের অবস্থানে এটা পরিষ্কার থাকা দরকার যে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা ভিন্ন বিষয়। নিজেদের নাগরিক রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নিতে বাধ্য। আর বিচার হচ্ছে তাদের অপরাধের কারণে। মিয়ানমার রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়া প্রক্রিয়ার সঙ্গে মামলার বিষয়টি সম্পৃক্ত করে দেখাতে চাইবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে বাংলাদেশকে। মামলার প্রেক্ষিতে যে অর্জন, তা কাজে লাগিয়ে সুবিধা নেওয়া খুব সহজ নয়।

বাংলাদেশের বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপর নির্ভর করছে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি।

[email protected]

আরও পড়ুন:

রোহিঙ্গারা ফুটবল, বাংলাদেশ খেলার মাঠ, চীন মূল খেলোয়াড়

রোহিঙ্গা: বাংলাদেশের সামনে গভীর সঙ্কট

Comments

The Daily Star  | English

Fashion brands face criticism for failure to protect labour rights in Bangladesh

Fashion brands, including H&M and Zara, are facing criticism over their lack of action to protect workers' basic rights in Bangladesh, according to Clean Clothes Campaign (CCC)..One year after a violent crackdown by state actors and employers against Bangladeshi garment workers protesting

Now