অং সান সু চির ভিন্ন রূপের প্রকাশ

২০১৩ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী অং সান সু চি গৃহবন্দি দশা থেকে মুক্তি পান। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচতে তখন থেকেই মিয়ানমারের সামরিক সরকার ধীরে ধীরে তাদের ক্ষমতা দেখানো কমাতে থাকে।
দীর্ঘদিন বন্দি থেকেও দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সু চির অবদানের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তাকে ‘দেশের বিবেক এবং মানবতার নেতা’ হিসাবে প্রশংসিত করে।
মুক্তির দুই বছর পরে মিয়ানমারের প্রথম অবাধ নির্বাচনে সু চির বিরাট জয় তাকে এশিয়ার নেলসন ম্যান্ডেলা হিসাবে ইতিহাসে জায়গা করে দেবে বলে মনে হয়েছিল।
কিন্তু, নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে সেই অবস্থান বিসর্জন দিয়েছেন সু চি। তার দেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার অভিযোগ এনেছে গাম্বিয়া। সেই অভিযোগ খণ্ডাতে এবং সামরিক কর্মকর্তাদের পক্ষে সাফাই দিতে নিজেই আইসিজেতে হাজির হয়েছেন তিনি।
২০১৫ সালের নির্বাচন পরবর্তী মিয়ানমারের রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে পূর্বতন মিয়ানমারের রাজনৈতিক অবস্থার খুব বেশি পার্থক্য নেই। দৃশ্যত দেশটিকে গণতান্ত্রিক মনে হলেও সামরিক বাহিনী পরোক্ষভাবে দেশ শাসনে ভূমিকা রাখছে। যার ফলে, স্বাধীনতার পর এত বছরেও জাতিগত কলহ এবং গৃহযুদ্ধ বন্ধ হয়নি মিয়ানমারে।
বিরোধী দলে থাকা এবং সরকার চালানোর মধ্যে একটি পার্থক্য রয়েছে। সু চি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর হিসাবে আছেন, দেশ পরিচালনা করছেন। রাষ্ট্রপতি হতে পারছেন না সামরিক সরকারের তৈরি সংবিধানের কারণে। এই অবস্থার মাধ্যমে সামরিক শক্তিকেও যেমন তার হাতে রাখতে হচ্ছে তেমনি তাকে ধরে রাখতে হচ্ছে জনগণের সমর্থনও।
একই সঙ্গে আবার পশ্চিমাদের অনুগ্রহও হারাতে পারবেন না সু চি। কারণ, পশ্চিমা চাপে পড়লে দেশের অর্থনীতিতে আঘাত লাগবে।
সবদিক ঠিক রেখে এগিয়ে চলাটা তার জন্য বেশ কঠিন। যেকোনো সময় তিনি হোঁচট খাবেন এটা অনেকটা অনিবার্যই ছিল। তবে পশ্চিমাদের মাঝে থাকা সমর্থকেরা তার পক্ষে প্রভাব বজায় রাখায় তিনি মিয়ানমারের ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন। সব মিলিয়ে বেশ গোঁজামিল দিয়েই সব কিছু পরিচালনা করে যাচ্ছিলেন, সবাইকে খুশি করে। কিন্তু তা তো আর বেশি দিন চলতে পারে না।
‘দ্য হিডেন স্টোরি অব বার্মা’ বইয়ে মিয়ানমারের ইতিহাসবিদ থান্ট মাইন্ট ইউ লিখেছেন, “যখন বিরোধের খবর এল তখন বলা হলো এটা একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেখানে সেনাবাহিনী এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এর মাধ্যমে মূল ঘটনা খুব সহজেই অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে। গল্পটি খুব ভালো ছিল, এ সময়ে এমন টনিকের খুব প্রয়োজন ছিল যখন আরবরা সহিংসতার পথে হাঁটছিল। বার্মা অন্তত একটি নৈতিকতার গল্প নিয়ে এগোচ্ছিল যা মনে হয়েছিল যে সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই শেষ হবে।”
২০১৫ সালে উত্তরাধিকার সূত্রে অনেকগুলি সমস্যা নিয়ে সু চি ক্ষমতা নেন। মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই এই সমস্যাগুলো ছিল।
মিয়ানমারের ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের স্বার্থে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করে।
সু চির পিতা, মিয়ানমারের মুক্তির নেতা জেনারেল অং সান তার বর্মী জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে শান, চিন এবং কোচিন গোষ্ঠীগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু, কমিউনিস্ট এবং ক্যারেনদের একত্রিত করতে পারেননি।
১৯৮৫ সালে সু চি লিখেছিলেন, “বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই সেনাবাহিনী শক্তিশালী হয়েছে।”
মিয়ানমারে সামরিক শাসনের পাঁচ দশকের মধ্যে সু চি নিজেকে গড়ে তোলেন একজন বিরোধী নেতা হিসেবে। এর জন্য সহায়ক হয়েছিল তার পারিবারিক ঐতিহ্য এবং দৃঢ় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।
আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে তার সাফল্য ছিল অভাবনীয়।
তবে সবাই সু চিকে যে কারণে সমর্থন দিয়েছিল, সেই মানবতার অবস্থান থেকে তিনি সরে এসেছেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
জাতিসংঘে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিল রিচার্ডসন অং সান সু চিকে নিয়ে বলেছিলেন, “দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি বদলে গেছেন। একজন রাজনীতিবিদ সামরিক শক্তিকে ভয় পেয়েছেন এবং ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকট সমাধানের জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পেয়েছেন।”
সু চি সম্ভবত বদলে গেছেন কিংবা তিনি সেই ব্যক্তিই নন যে ব্যক্তি সকলের সামনে এতদিন ছিলেন।
সংখ্যা গরিষ্ঠদের সমর্থন পাবার জন্য তিনি সংখ্যালঘুদের ত্যাগ করেছেন। সু চিই সম্ভবত প্রথম নেতা যিনি এমন করলেন, তবে হয়তো শেষ নন।
সু চির এমন পতন থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা হল নোবেল শান্তি বিজয়ীরা নির্ভুল মানুষ নন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করত। তারা ভাবত সু চির হাত ধরে গণতন্ত্রের এক নতুন অধ্যায় দেখতে পাবে সবাই। কিন্তু তা হলো না।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার কারণে যে পরিমাণ নিন্দা সু চি পেয়েছে এবং পাচ্ছে তার প্রাপ্য।
Comments