গারো পাহাড়ের গেরিলা

আলবার্ট ম্রং প্রতিদিন ভোরে বাইসাইকেলে চেপে চলে যান গ্রাম থেকে গ্রামে। সঙ্গে থাকে ব্যাগভর্তি ওষুধ। মধুপুরের কলাবাগান বেষ্টিত মাটির রাস্তা ধরে সাইকেল চালান, আর পথে কোনো বাড়ি দেখলেই থেমে যান। প্রতিদিন প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে স্থানীয় কৃষকদের গবাদি পশুর চিকিৎসা করেন তিনি।
albert_mrong-1.jpg
আলবার্ট ম্রং ও আলপনা ম্রি। ছবি: স্টার

আলবার্ট ম্রং প্রতিদিন ভোরে বাইসাইকেলে চেপে চলে যান গ্রাম থেকে গ্রামে। সঙ্গে থাকে ব্যাগভর্তি ওষুধ। মধুপুরের কলাবাগান বেষ্টিত মাটির রাস্তা ধরে সাইকেল চালান, আর পথে কোনো বাড়ি দেখলেই থেমে যান। প্রতিদিন প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে স্থানীয় কৃষকদের গবাদি পশুর চিকিৎসা করেন তিনি।

এভাবেই কাকরাগনি ও এর আশপাশের বহু গ্রামের বাসিন্দাদের পরম বন্ধু হয়ে উঠেছেন ৬৬ বছরের আলবার্ট। যদিও মৌলিক সুযোগ-সুবিধা কিংবা নিত্যদিনের সংগ্রাম নিয়ে একটুও মাথা ঘামান না তিনি।

গত কয়েক দশক ধরে এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই পশু চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন আলবার্ট। সর্বোপরি তিনি এই অঞ্চলকে আপন করে নিয়েছেন এবং তিনি মনে করেন, সেখানকার মাটি-মানুষই তার সব।

মানুষের প্রতি এমন ভালোবাসার জোরেই আলবার্ট ৪৮ বছর আগে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন।

তবে, সংবাদমাধ্যমের কাছে এখন আর সেসব কথা সহজে বলতে রাজি নন আলবার্ট। কিন্তু এই প্রতিবেদক আলবার্টের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাকে সাক্ষাৎকারের জন্য রাজি করাতে সক্ষম হন।

এরপর প্রতিবেদকরা তার গ্রামের বাড়িতে যান। আলবার্টের গ্রামের বাড়িটি মাটির তৈরি এবং টিন দিয়ে ছাওয়া। আর বাড়ির চারপাশ ঘিরে রয়েছে বাদাম, নারকেল এবং কলা গাছ।

প্রতিবেদকরা যখন সেখানে পৌঁছালেন, আলবার্ট তখন ভেটেরিনারি ওষুধ বিতরণের কাজে বাইরে ছিলেন। পাওয়া গেলো তার স্ত্রী আলপনা ম্রি-কে। তিনি বলেন, “আমার স্বামী সবসময় বলেন- তিনি কোনো পুরষ্কারের জন্য যুদ্ধ করেননি। আমরা তাকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নেওয়ার জন্য সবসময় জোর করতাম।”

এমন সময়ে উঠানে সাইকেলের বেল বেজে উঠলো। আলবার্ট তার দিনের কাজ শেষে ঘরে ফিরেছেন।

অবশেষে কথা হয় আলবার্টের সঙ্গে। তিনি বলেন, “যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিলো ১৭ বছর এবং আমি তখন ময়মনসিংহ শহরে পড়ালেখা করি। আমার বাবা ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই মোতাবেক আমার পরিবার ও আরও কিছু পরিবার মিলে মেঘালয় সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাটের কাছে গারো পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলো।”

তবে দেশ ছাড়তে মন সায় দেয়নি আলবার্টের। তিনি বলেন, “সাত মার্চে বঙ্গবন্ধু সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন। আর আমাদের দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতে বললেন।”

আলবার্ট তখন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ওই সময়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের বিভৎস অভিযানে ভীষণ কষ্ট পেলেন।

তিনি বলেন, “তখন আমি কয়েকজন গারো যুবককে সংগঠিত করলাম। আমাদের এই দলে প্রায় ৪০ জন যুবক ছিলেন এবং আমরা সবাই কাছাকাছি বয়সের ছিলাম। দেশের হয়ে যুদ্ধ করতে আমাদের সবার বয়স যথেষ্ট ছিলো।”

আলবার্ট তার পরিবারকে রাজি করালেন।

“আমি আমার বাবাকে জানালাম। বললাম- তোমার আরও ছেলে আছে। তাই একটি ছেলেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দাও”, বলেন আলবার্ট।

তিনি বলেন, “পরিবারের সবাইকে জানিয়ে আমরা মেঘালয়ের একটি ভারতীয় ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের জন্য যোগ দিলাম। সেখানে আমাদের তিনটি দলে ভাগ করা হলো। প্রতিটি দলে ১০০ জন করে সদস্য ছিলো। যারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে এসেছিলো।”

পরবর্তীতে তারা মেঘালয়ের দালু গ্রামের একটি পাহাড়ে আশ্রয় নেন। সেখানে থেকে ১০-১৫ জন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতো এবং মুক্তিবাহিনীদের অস্ত্র সরবরাহ করতো বলে জানান আলবার্ট।

আলবার্ট বলেন, “সেখান থেকে আমার গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতাম। আমাদের লক্ষ্য ছিলো শত্রুপক্ষের ওপর নিয়মিত হামলা করা। আমরা সফলভাবে তা করছিলামও। কারণ আমরা সবাই নিজের সেরাটাই দিচ্ছিলাম এবং ওই এলাকাও আমাদের খুব ভালোভাবে চেনা। আমরা কয়েকটি সেতু উড়িয়ে দিয়েছিলাম, পাহাড়ে ল্যান্ডমাইন পুতে রেখেছিলাম। আর এসব কাজে স্থানীয়রা আমাদের সহায়তা করতো।”

দুর্বার যুদ্ধ শুরু হলে আলবার্টরাও যুদ্ধের সঙ্গে নিজেদের আরও জড়িয়ে নিলেন। মে মাসে তাদের দলের ৫৩ জন শেরপুরে গেলেন এবং সেখানের একটি গ্রামে আশ্রয় নিলেন।

তিনি বলেন, “ওই গ্রামের মানুষ আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। অনেকদিন পরে আমরা সেখানে খাবার খেলাম। কিন্তু রাতের খাবারের পরে বিশ্রামের সময় আমরা বাইরে অনেক শব্দ শুনলাম। বুঝতে পারলাম পাক হানাদার বাহিনী আমাদের ঘিরে ফেলেছে। আমাদের চারপাশে তখন বুলেটের শব্দ, মাথার ওপর দিয়ে বুলেট ছুটছে। আমাদের পাশেই একটি খাল ছিলো। সবাই মিলে সেই খালে লাফিয়ে পড়লাম।”

“সেদিন আমরা তিনজন সহযোদ্ধাকে হারিয়েছিলাম। যার মধ্যে আমাদের কমান্ডার নাজমুলও ছিলেন। আহত হয়েছিলেন আরও অনেকেই। আমরা সারারাত সাঁতরালাম এবং একসময় পাহাড়ে এসে পৌঁছলাম। এরপর থেকে আমরা বেশ সচেতন থাকতাম। উইলিয়াম ম্রংকে আমাদের নতুন কমান্ডার বানানো হলো।”

জুলাই এবং আগস্টে আলবার্ট এবং অন্যান্য গেরিলারা তারাকান্দা, ফুলপুর, নারন্দি ও আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালান।

গারো পাহাড়ের এ অকুতোভয় গেরিলার জীবনের গল্প এখানেই শেষ নয়।

(সংক্ষেপিত, পুরো প্রতিবেদনটি পড়তে এই The guerrilla of Garo hills লিংকে ক্লিক করুন)

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

6h ago