১৭ ডিসেম্বর, শুক্রবার, ১৯৭১

আজ ভোরে বাসায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হল। মঞ্জুর এসেছিলেন, বাড়িতে যাঁরা আছেন, তারাও সবাই ছাদে উঠলেন। ২৫ মার্চ থেকে ফ্ল্যাগপোলটায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আবার নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেই ফ্ল্যাগপোলটাতেই আজ আবার সেদিনের পতাকাটাই তুললাম।
jahanara_imam-1.jpg
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ছবি: সংগৃহীত

আজ ভোরে বাসায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হল। মঞ্জুর এসেছিলেন, বাড়িতে যাঁরা আছেন, তারাও সবাই ছাদে উঠলেন। ২৫ মার্চ থেকে ফ্ল্যাগপোলটায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আবার নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেই ফ্ল্যাগপোলটাতেই আজ আবার সেদিনের পতাকাটাই তুললাম।

সবাই কাঁদতে লাগলেন। আমি কাঁদতে পারলাম না। জামীর হাত শক্ত মুঠিতে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

গত তিনদিন থেকে জামীকে নিয়ে বড়ই দুশ্চিন্তায় আছি। শরীফের মৃত্যুর পর থেকে ও কেমন যেন গুম মেরে আছে। মাঝে-মাঝেই খেপে ওঠে, চেঁচামেচি করে, ছুটে বেরিয়ে যেতে চায়, বলে পাঞ্জাবি মারবে, বিহারি মারবে, আব্বুর হত্যার প্রতিশোধ নেবে। ওকে যত বোঝাই এখন আর যুদ্ধ নেই, যুদ্ধের সময় পাঞ্জাবি মারলে সেটা হত শত্রুহনন, এখন মারলে সেটা হবে মার্ডার- ও তত ক্ষেপে ওঠে। কি যে করি! ওর জন্য আমিও কোথাও বেরুতে পারছি না। তাছাড়া এই যে গুষ্ঠি রয়েছে বাড়িতে! গত রাতেই হোসেন সাহেব ও আসলাম সাহেবরা নিজেদের বাড়িতে চলে গেছেন। কিন্তু বাকিরা নড়তে চাইছে না। কি এক দুর্বোধ্য ভয়ে এই ঘরের মেঝে আঁকড়ে বসে আছে!

আত্মীয়-বন্ধু পরিচিতজন কত যে আসছে সকাল থেকে স্রোতের মত। তাদের মুখে শুনছি রমনা রেসকোর্সে সারেন্ডারের কথা, দলে দলে মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকায় আসার কথা, ইন্ডিয়ান আর্মির কথা, লোকজনের বিজয়োল্লাসের কথা। এরই মধ্যে রক্ত-হিম করা একটা কথাও শুনেছি। মুনীর স্যার, মোফাজ্জল হায়দার স্যার, ডা. রাব্বি, ডা. আলিম চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার এবং আরো অনেকেরই খোঁজ নেই। গত সাত-আটদিনের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে কারফিউয়ের মধ্যে এঁদের বাসায় মাইক্রোবাস বা জীপে করে কারা যেন এসে এঁদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ ঝলকের মত মনে পড়ল গত সাত-আটদিনে যখন-তখন কারফিউ দেওয়ার কথা। কারফিউয়ের মধ্যে রাস্তা দিয়ে বেসামরিক মাইক্রোবাস ও অন্যান্য গাড়ি চলাচলের কথা। এতক্ষণে সব পরিষ্কার হয়ে উঠল।

বিকেল হতে হতে রায়েরবাজারের বধ্যভূমির খবরও কানে এসে পৌঁছল। বড় অস্থির লাগছে। কি করি? কোথায় যাই, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। রুমী! রুমী কি বেঁচে আছে? আমি কি করে খবর পাব? কার কাছে খবর পাব? শরীফ এমন সময়ে চলে গেল? দু’জনে মিলে রুমীর জন্য কষ্ট পাচ্ছিলাম, রুমীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখন একাই আমাকে সব করতে হবে, একাই সব কষ্ট বহন করতে হবে।

ফোন ও ইলেকট্রিকের লাইন এখনো ঠিক হয় নি। কে ঠিক করবে? সারা ঢাকার লোক একই সঙ্গে হাসছে আর কাঁদছে। স্বাধীনতার জন্য হাসি। কিন্তু হাসিটা ধরে রাখা যাচ্ছে না। এত বেশি রক্তে দাম দিতে হয়েছে যে কান্নার স্রোতে হাসি ডুবে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে।

সন্ধ্যার পর একটা মোমবাতি জ্বেলে ভুতুড়ে আলোয় জামীকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম। হঠাৎ দরজায় করাঘাত। তার আগে বাসার সামনে জিপগাড়ি থামবার শব্দ পেয়েছি। উঠে দরজা খুললাম। কাঁধে স্টেনগান ঝোলানো কয়েকটি তরুণ দাঁড়িয়ে। আমি দরজা ছেড়ে দু’পা পিছিয়ে বললাম, ‘এসো বাবারা, এসো।’

ওরা ঘরে ঢুকে প্রথমে নিজেদের পরিচয় দিল, ‘আমি মেজর হায়দার। এ শাহাদত, এ আলম। ও আনু, এ জিয়া ও ফতে আর এই যে চুল্লু।’

হায়দার আর আনু ছাড়া আর সবাইকেই তো আগে দেখেছি।

চুল্লু এতদিন সেন্ট্রাল জেলে ছিল। ওকে জেল থেকে বের করে এনে রুমীর অনুরাগী এই মুক্তিযোদ্ধারা রুমীর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

আমি ওদেরকে হাত ধরে এসে ডিভানে বসলাম। আমি শাহাদতের হাত থেকে চাইনিজ স্টেনগানটা আমার হাতে তুলে নিলাম। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলাম। তারপর সেটা জামীর হাতে দিলাম। চুল্লু মাটিতে হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসল। আমার দুই হাত টেনে তার চোখ ঢেকে আমার কোলে মাথা গুঁজল। আমি হায়দারের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘জামী পারিবারিক অসুবিধার কারণে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারে নি। ও একেবারে পাগল হয়ে আছে। ওকে কাজে লাগাও।’

মেজর হায়দার বলল, ‘ঠিক আছে জামী, এই মুহূর্ত থেকে তুমি আমার বডিগার্ড হলে। এক্ষুণি আমার সঙ্গে আমার অফিসে চল, তোমাকে একটা স্টেন ইস্যু করা হবে। তুমি গাড়ি চালাতে পার?’

জামী সটান অ্যাটেনশনে দাঁড়িয়ে ঘটাং করে এক স্যালুট দিয়ে বলল, ‘পারি।’

‘ঠিক আছে, তুমি আমার গাড়িও চালাবে।’

জামীর পাশেই আলী দাঁড়িয়ে ছিল। জামী বলল, ‘স্যার, আমার বন্ধু আলী-’

মেজর হায়দার গম্ভীর মুখে বলল, ‘ইনফ্যাক্ট আমার দু’জন বডিগার্ড দরকার- তোমার বন্ধুকেও অ্যাপয়েনমেন্ট দেওয়া গেল। কিন্তু ভেবে দেখ, পারবে কি না। এটা খুব টাফ জব। চব্বিশ ঘণ্টার ডিউটি।’

পাঁচদিন পর জামী এই প্রথমবারের মত দাঁত বের করে হাসল,

‘আটচল্লিশ ঘণ্টার হলেও পরোয়া নেই।’

আরও পড়ুন:

১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭১

১৫ ডিসেম্বর, বুধবার, ১৯৭১

১৪ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৭১

১৩ ডিসেম্বর, সোমবার, ১৯৭১

১২ ডিসেম্বর, রবিবার, ১৯৭১

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

9h ago