সীমান্ত-রেখায় মোটরসাইকেল চোরাচালান সিন্ডিকেট

আন্তঃদেশীয় চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যরা এ বাড়ির রান্নাঘরটিকে মোটরসাইকেলের গোডাউনে পরিণত করেছেন। সীমান্তের ওপার থেকে আলাদা আলাদাভাবে তেলের ট্যাঙ্ক, চাকা, হেডলাইট এবং সিটসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ আনে তারা। তারপর সেগুলো সংযোজন করে তৈরি করা হয় পূর্ণাঙ্গ মোটরসাইকেল।
সীমান্ত পিলার বরাবর এই বাড়িটির বাম পাশের অর্ধেকটা ভারতে ও ডান পাশটা পড়েছে বাংলাদেশে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার ধ্বজানগর গ্রামে রয়েছে এই বাড়িটি। এখান থেকে ১০০ গজ দূরে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। মোটরসাইকেল চোরাচালানের জন্য এই বাড়িগুলো ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা। ছবি: সংগৃহীত

এটি সীমান্ত-রেখার ঠিক পাশের একটি বাড়ি। 

আন্তঃদেশীয় চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যরা এ বাড়ির রান্নাঘরটিকে মোটরসাইকেলের গোডাউনে পরিণত করেছেন। সীমান্তের ওপার থেকে আলাদা আলাদাভাবে তেলের ট্যাঙ্ক, চাকা, হেডলাইট এবং সিটসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ আনে তারা। তারপর সেগুলো সংযোজন করে তৈরি করা হয় পূর্ণাঙ্গ মোটরসাইকেল।

অভিযোগ রয়েছে, কিছু পুলিশ কর্মকর্তা ও বিজিবি সদস্যের সঙ্গে এসব সিন্ডিকেটের যোগাযোগ রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্ত দিয়ে পাচার সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের নজরে এসেছে বিষয়টি।

গত ৯ অক্টোবর এই সংবাদদাতারা পুলিশের এক সোর্সের সহায়তায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে সড়ক ও রেলপথে ৫৪ কিলোমিটার মোটরসাইকেলে এবং প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে সীমান্তের এই স্থানে পৌঁছান।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সীমান্তের কাছে এসে পুলিশের সেই সোর্স সীমান্ত-রেখায় নির্মিত একটি বাড়ির বাসিন্দা মো. মোমেন মিয়াকে ফোন করেন।

বাংলাদেশি সিম ব্যবহারকারী মোমেন মিয়াকে জানানো হয়, একটি মোটরসাইকেল কেনার জন্য দুজন ক্রেতা এসেছেন।

ইতিবাচক সংকেত পেয়ে সেই সোর্স এই সংবাদদাতাদেরকে ১০ মিনিট ঘন ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে হাঁটিয়ে সেই বাড়ির কাছাকাছি একটি স্থানে নিয়ে যান (সীমান্ত-রেখার কাছে)। সেসময় আশপাশে কোনো সীমান্তরক্ষী ছিলেন না।

সীমান্ত-রেখার কাছে চোরাচালানের বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে মোমেন জানান, তার রান্নাঘরে নতুন একটি টিভিএস অ্যাপাচি আরটিআর মডেলের মোটরসাইকেল আছে। যার দাম ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। যদিও বাংলাদেশের বাজারে এর অনুমোদিত মূল্য ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

এই সংবাদদাতা মোটরসাইকেলটি কেনার আগ্রহ দেখালে, মোমেন তাদেরকে তার সহযোগী ও পুলিশের আরেক সোর্স মনিরের সঙ্গে দেখা করতে বলেন।

কসবা বাজারে কথা হয় মনিরের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতিটি মোটরসাইকেলের জন্য সীমান্তের দুপাশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়।

মনির বলেন, “পুলিশ কর্মকর্তারাও প্রায় সমপরিমাণ টাকা পান।”

সীমান্তে পাহারা না থাকলেই কাঁটাতারের বেড়ার ওপর দিয়ে কাঠের তৈরি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে ভারত থেকে বাংলাদেশে মোটরসাইকেল আনা হয়।

মনির বলেন, “এভাবে আমরা প্রতিদিন প্রায় আট থেকে ১০টি মোটরসাইকেল আনতে পারি। তবে আমাদের মধ্যে ছয় জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করায় পরিস্থিতি এখন একটু কঠিন হয়ে পড়েছে।”

সীমান্তের এই চোরাচালান বিষয়ে আরও অনুসন্ধানের জন্য চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের সদস্য, চোরাই মোটরসাইকেল ক্রেতা ও অন্য কয়েকটি সোর্সের সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে।

কোনো ক্রেতা মোটরসাইকেলের লাইসেন্স নম্বর ও নিবন্ধনপত্র পেতে চাইলে চোরাকারবারিরা মোটরসাইকেলটিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত সংলগ্ন কুমিল্লা ও হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে তৎপর আরেকটি গ্রুপের হাতে তুলে দেয়।

তারা মোটরসাইকেলের চেসিস নম্বর মুছে দিয়ে সেখানে অনুমোদিত শো-রুমে বিক্রি হওয়া বৈধভাবে আমদানিকৃত মোটরসাইকেলের নম্বর বসিয়ে দেয়। এজন্য তারা শো-রুম থেকে বিক্রয় সংক্রান্ত কাগজপত্রও সংগ্রহ করে থাকে।

লাইসেন্স ও নিবন্ধন পাইয়ে দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এই চোরাকারবারিরা অতিরিক্ত ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা নেন। গ্রাহকরা লাইসেন্স নম্বরের পাশাপাশি কিছু জাল কাগজপত্রও পেয়ে থাকেন।

চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশি এক তরুণ জানান, ভারতীয় অংশে এই সিন্ডিকেট সদস্যরা অনেক সময় স্থানীয় ব্যক্তিদের আইডি কার্ড (আধার কার্ড) ব্যবহার করে মোটরসাইকেল নিবন্ধন করে। পরে মোটরসাইকেলটি চুরি হয়ে গেছে বলে থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “তারা মোটরসাইকেলের নিবন্ধন এ কারণেই করেন, যাতে সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়লে সেটিকে চুরি যাওয়া সম্পত্তি হিসেবে দেখিয়ে ফিরে পেতে পারেন।”

যদিও ভারতের চোরাকারবারিদের এই কৌশলের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেনি দ্য ডেইলি স্টার।

বিজিবি ৬০ ব্যাটেলিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইকবাল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, এই জেলায় চলাচল করা মোটরসাইকেলের একটা বড় অংশ ভারত থেকে চোরাই পথে আনা হয়েছে।

যেহেতু মোটরসাইকেলের কাগজপত্র ঠিকমতো যাচাই করা হয় না, সেহেতু তরুণদের মধ্যে চোরাই মোটরসাইকেলের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, “আমরা প্রায়শই চোরাই মোটরসাইকেলের ব্যাপারে তথ্য পাই, কিন্তু চোরাকারবারিরা সেগুলো সীমান্ত-রেখায় নির্মিত বাড়িগুলোতে নিয়ে রাখে। সেখানে অভিযান চালানোর জন্য আমাদের কোনো অনুমোদন নেই।”

বিজিবির এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “পতাকা বৈঠকের সময় আমরা প্রায়ই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে এ ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগের কথা জানাই।”

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্সেরা জানান, মোটরসাইকেল চোরাচালানের জন্য সিন্ডিকেট সদস্যরা হাকুর, বাদলা, মাদলা এবং বায়েক সীমান্ত এলাকা ব্যবহার করে থাকেন।

সোর্সের তথ্য অনুসারে, কুমিল্লার গঙ্গানগর গ্রামের ওয়াসিম মিয়া ও রামচন্দ্রপুর গ্রামের হোসেন মিয়া একটি সিন্ডিকেট পরিচালনা করেন। কসবার গৌরাঙ্গনা এলাকার শিপন মিয়া তাদের সঙ্গে কাজ করেন।

সিন্ডিকেটের অপর সদস্যরা হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোপীনাথপুর গ্রামের জহির মিয়া, ধ্বজানগর গ্রামের বিল্লাল মেম্বার, নারায়ণপুর বাজারের রুবেল মাস্টার ও সাদেক সরদার এবং মাদলা গ্রামের কামাল মিয়া।

সোর্স ছাড়াও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা নিশ্চিত করেছেন যে, এরা চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। তবে অভিযুক্তদের কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

কসবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. লোকমান হোসেন জানান, চোরাকারবারি সিন্ডিকেট সদস্যদের চিহ্নিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

তিনি বলেন, “আমরা পুলিশ কর্মকর্তাদের সতর্ক করে বলেছি আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে। এক্ষেত্রে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইকবাল হোসেন চোরাকারবারের সঙ্গে বিজিবি কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তিনি জানান, তারা সবসময়েই সক্রিয় থাকেন এবং যখনই তথ্য পান, তখনই অভিযান পরিচালনা করেন।

গ্রেপ্তার প্রসঙ্গ

পুলিশ জানিয়েছে, মোটরসাইকেল চোরাচালান করতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করায় গত ১১ মে চার ভারতীয় নাগরিকসহ মোট ছয় জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- বাংলাদেশের আমজাদ হোসেন শাওন (২২) ও হাসিবুল হাসান অনিক (১৯) এবং ভারতের সঞ্জীত দেবনাথ (২৩), নির্মলেন্দু চৌধুরী (৩২), শংকর সরকার (৩১) এবং বিমল দাস (৩৩)।

সেসময় তাদের কাছ থেকে একটি পিস্তল, দুটি পাইপ গান, ছয়টি ম্যাগাজিন, দুটি ওয়াকিটকি ও একটি চার্জারসহ আরও কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

কসবা সার্কেলের তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুল করিম জানান, সীমান্ত এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকমতো কাজ না করায় এই গ্রুপটি ওয়াকিটকি ব্যবহার করতো।

গত ২৭ অক্টোবর খুলনায় বদলি হয়ে যাওয়া এএসপি করিম জানিয়েছিলেন, শাওন একজন পেশাদার চোরাকারবারি। তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে একটিসহ মোট দুটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত চার ভারতীয়কেও পেশাদার চোরাকারবারি হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থানীয় এক সোর্স জানান, বাংলাদেশে তৎপর অপর চোরাকারবারি সিন্ডিকেট সদস্যদের রক্ষা করতে এসব তথ্যের বিস্তারিত উল্লেখ না করেই পুলিশ তড়িঘড়ি করে গত ২৬ জুলাই অভিযোগপত্র জমা দিয়ে দেয়।

এএসপি করিম এই অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন। গত ১০ অক্টোবর ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, পুলিশ অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি, তাই তারা কেবল ছয়জনের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দিয়েছেন।

তিনি বলেন, “আইন অনুযায়ী আমাদের ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।”

সোর্স জানায়, কসবা সীমান্তে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে এই ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছিলো পুলিশ।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ফারুক জানান, চোরকারবারি দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে মাজহারুল ইসলাম তানিম (৩০) খুন হন।

তিনি বলেন, “আমরা এই হত্যাকাণ্ডে নয়জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছি। এদের মধ্যে তিনজন ইতোমধ্যে জেলহাজতে রয়েছেন।”

Comments