দেশের ক্রিকেটে গোড়ায় গণ্ডগোল
গণমাধ্যম, ভক্ত আর সংগঠক সবারই নজর যখন কেবল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দিকে, তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট নিয়ে কে আর তোয়াক্কা করে? কিন্তু চলতি বছর ঘরোয়া নিম্ন স্তরের এই ক্রিকেট প্রতিযোগিতাটি যথেষ্ট আলোচনায় এসেছে। কিন্তু সেই আলোচনাটা অবশ্যই কোনো সুখকর বিষয় নিয়ে নয়।
পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং, অন্যায় সুবিধা দেওয়া, পয়েন্ট কেনা-বেচার মতো গুরুতর বহু অভিযোগ উঠেছে এই বিভাগের খেলার সময়। একাধিক গণমাধ্যমে হয়েছে প্রতিবেদন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়েছে গুরুতর অভিযোগের ভিডিও। এসবের প্রতিক্রিয়ায় বিসিবি খেলোয়াড়, কোচ এমনকি টিম বয়কে পর্যন্ত ম্যাচের সময় সকল ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করা থেকে নিষিদ্ধ করেছে।
২০ দলের এই লিগে চ্যাম্পিয়ন যাত্রাবাড়ী ক্রীড়া চক্র, রানার্সআপ গুলশান ক্রিকেট ক্লাব। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, চ্যাম্পিয়নশিপ নির্ধারণের আগেই আসরের বাইলজ ভঙ্গ করেছে খোদ আয়োজকরা। ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিস (সিসিডিএম) নিজেরা যে বাইলজ তৈরি করেছে তা অনুসরণ করলে আট দলের সুপার লিগে নারায়ণগঞ্জ ক্রিকেট একাডেমির বদলে খেলার কথা ঢাকা ক্রিকেটার্সের।
নারায়ণগঞ্জ ক্রিকেট একাডেমি আর ঢাকা ক্রিকেটার্সের পয়েন্ট ছিল সমান। বাইলজ অনুযায়ী এক্ষেত্রে পরের ধাপের জন্য প্রথমে বিবেচিত হবে লিগে সব ম্যাচ মিলিয়ে যারা বেশি জয় পেয়েছে তারা। তা-ও যদি সমান হয়, দেখা হবে একে অন্যের বিপক্ষে কে জিতেছে। সেটাও সমান হলে দেখা হবে নেট রান রেট।
এই নিয়ম অনুযায়ী, সুপার লিগে খেলার কথা ঢাকা ক্রিকেটার্সের। কারণ লিগে ঢাকা ক্রিকেটার্সের জয় আছে চারটি, অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ জেতে তিন ম্যাচ। কিন্তু তা আমলে না নিয়ে হেড-টু-হেড বিবেচনায় এনে সুপার লিগে সুযোগ দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ ক্রিকেট একাডেমিকে।
বিসিবি ও সিসিডিএম বলছে, এটা নেহায়েত একটা ‘ভুল’ এবং এই ভুলের কারণ খতিয়ে দেখতে ‘তদন্ত চলছে’। কিন্তু যারা এই কথিত ভুলের কারণে ক্ষতির শিকার হয়েছে, তাদের মত আবার ভিন্ন। তারা বলছে, এটা মানবিক কোনো ভুল নয়। ‘তাদের দলকে’ সুবিধা দিতে এমনটা করা হয়েছে ইচ্ছে করে।
এই ‘তাদের দল’, ‘আমাদের দল’ এসবই হচ্ছে সমস্যার মূলে। এই ‘তাদের দলকে’ অনেকে মজা করে ‘সরকারি দল’ বলে থাকেন।
দেশের ঘরোয়া তৃণমূল ক্রিকেটে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতির কালো থাবা বিষয়ে বিশদ জানতে দ্য ডেইলি স্টার সংশ্লিষ্টদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছে। তাদের অনেকেই অবশ্যই নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি।
কেন এমন হচ্ছে, যা বলছেন অভিযোগকারীরা
- এর বড় কারণ কিছু বিসিবি কর্মকর্তা ক্লাব কোটায় বিসিবির কাউন্সিলরশিপ নিশ্চিত করতে এমন কাজে (অন্যায় সুবিধা) জড়িত হন।
- অভিযোগের তীর দুই প্রভাবশালী বিসিবি পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিক ও খালেদ মাহমুদ সুজনের দিকে। তারা দুজনই উপর থেকে নিচের সমস্ত ‘মেকানিজম’ করে থাকেন। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে থাকে তাদেরই বাছাই করা নির্দিষ্ট কিছু আম্পায়ার।
- এসব আম্পায়ার হচ্ছেন তারেকুল ইসলাম মাসুম, মাসুদ রানা, সাদিউর রহমান, তৌহিদুর রহমান, আশরাফ টিপু, জাহিরুল ইসলাম জুয়েল ও শাহীনুর রহমান শামীম।
- এসব নির্দিষ্ট আম্পায়ার থাকলে ম্যাচের দিন সকালেই আভাস পাওয়া যায় ম্যাচ কোন দিকে যাবে। বলা হয়, ম্যাচটা ‘কোপানো হবে’। তৃণমূলের ক্রিকেটে যে ম্যাচ ইশারায় নির্ধারিত হয়ে যায়, সেটাকে ‘কোপানো ম্যাচ’ টার্মে চেনেন সবাই।
- অভিযুক্ত এই আম্পায়াররাই সবচেয়ে বেশি ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পান। অভিযুক্তদের হিসাব মতে, তৃতীয় বিভাগের ১২৪ ম্যাচের মধ্যে ৯৩ ম্যাচই এরা পরিচালনা করেছেন। ‘সরকারি দল’কে জেতাতে এমনকি তারা হাতে লাগলেও এলবিডব্লিউয়ের সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন।
- আম্পায়ার জহিরুল ইসলাম জুয়েলের আবার আছে একের ভেতর অনেক রূপ। তিনি একই সঙ্গে আম্পায়ার এবং একটি ক্লাবের কোচ। এমনকি পূর্বাচল ক্রিকেট ক্লাবের প্রতিনিধি হিসেবে আছেন সিসিডিএমেও।
- একটা নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের হাতেই এখন নিম্ন স্তরের ক্রিকেটের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ফলে কোনো প্রতিবাদী কণ্ঠকে আর পরের মৌসুমে দেখা যায় না। এখানে তিনটা ক্যাটাগরি আছে। সেই সিন্ডিকেটের সরাসরি অর্থায়নের ক্লাব, তাদের আর্শিবাদপুষ্ট ক্লাব এবং টিকে থাকার স্বার্থে সিন্ডিকেটকে সমঝে চলা ক্লাব। খুবই অল্প ক্লাব আছে যারা এর বাইরে লড়াই করছেন।
- কেবল নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি বের করতে পারবে তৃণমূলের ক্রিকেট আসলে কারা, কীভাবে ধ্বংস করছে।
সিসিডিএম ও অভিযোগের তীর যাদের দিকে তারা যা বলছেন
- বোর্ড কর্মকর্তাদের ক্লাব সংশ্লিষ্টতা নতুন কিছু নয়।
- ঢালাওভাবে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের কোনো ভিত্তি নেই।
- কেউ পারফর্ম করতে না পারায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাইছে।
- ক্যামেরা বসানোর পর থেকে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। সিসিডিএম এখন অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পারে।
- ম্যাচ অফিসিয়াল নিয়োগের বিষয়ে সিসিডিএমের কিছু করার নেই। বিষয়টি দেখে বিসিবির আম্পায়ার্স ও স্কোয়ার কমিটি।
আক্রান্তরা যা বলছেন
- “এমন নগ্ন হস্তক্ষেপ আমি কোনোদিন দেখিনি। মূল কথা হচ্ছে, যেকোনো কিছু করে বোর্ডে থাকতে হবে। আপনারা জানেন, এখানে কাউন্সিলরশিপের ব্যাপার আছে। আম্পায়াররা বোর্ডেরই চাকুরে। তারা বোর্ড কর্তাদের নির্দেশ মানতে বাধ্য। আমরা যেটা শুনি, সব নিয়ন্ত্রণ করেন মল্লিক। তারা ক্রিকেটটা ধ্বংস করে দিচ্ছে। ব্যাপারটা হচ্ছে, আপনি দৌড় থেকে ছিটকে গেলে এই পরিস্থিতিতে আর ক্রিকেটে ফিরতে পারবেন না। ক্রিকেটটা বাঁচাতে হবে। না হলে নিবেদিত ক্রিকেট সংগঠক আর পাওয়া যাবে না। আমাদের ক্রিকেটকে এই পরিবেশ সাহায্য করবে না, স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতাও হারিয়ে যাবে। দৃশ্যটা পরিষ্কার। তারা তাদের পেশিশক্তি প্রদর্শন করছে। মাঠে কেউ প্রতিবাদ করলে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।”
- মোহাম্মদ সরওয়ার, সাধারণ সম্পাদক, কলাবাগান গ্রিন ক্রিসেন্ট একাডেমি
“ক্রিকেটে এক-দুইটা সিদ্ধান্ত আপনার বিরুদ্ধে যেতেই পারে। কিন্তু এক ম্যাচে চার-পাঁচটা? যা হচ্ছে তা ক্রিকেট না। নির্দিষ্ট কিছু আম্পায়ার দেখলেই কেন খেলোয়াড়রা চাপে পড়ে যাবে? আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। একজন ব্যাটসম্যান অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলতে গিয়ে কট বিহাইন্ড হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কীভাবে লেগ আম্পায়ার দিতে পারে? কিংবা বাউন্সারে ব্যাটসম্যানের হাতে এসে লেগেছে বল, এটা কী করে এলবিডব্লিও হতে পারে?
এসব বিদঘুটে সিদ্ধান্ত কেন দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তারা (আম্পায়ার) আমাদের বলে, ‘আমাদের তো পরিবার চালাতে হয়, আমাদের বসদের নির্দেশ মেনে চলতে হয়। আমাদের কিছু করার নেই।’ এমনকি খেলার মাঝে আম্পায়ারকে নির্দিষ্ট ক্লাবের ড্রেসিং রুমে ছুটে নির্দেশ আনতে দেখা যায়। এভাবে কতদিন চলবে?”
- নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্রিকেটার
আম্পায়ার্স কমিটির বক্তব্য
- “ঢাকা শহরে আমাদের ৫০-৬০ জন আম্পায়ার আছে, এছাড়া আরও ১০০ জন আছে যারা অনিয়মিত কাজ করেন। ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরি আছে। ১২ থেকে ১৫ জন প্রথম শ্রেণির ম্যাচ করে। ১২-২৫ জন এই ধাপে করে (তৃতীয় শ্রেণির)। আমরা ট্রায়াল হিসেবে পুরনোদের সঙ্গে নতুন আম্পায়ার মিশিয়ে দেই। এবার ২০-২২ ম্যাচ করার জন্য ঢাকার বাইরে থেকে ৭ থেকে ৮ জন আম্পায়ার কাজ করেছেন। কাজেই অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। আপনি কাউকে পছন্দ না করলে তার কোনো কিছুই ভালো লাগবে না। যারা অভিযোগ করেছে তাদের নিজস্ব এজেন্ডা আছে। এটাও সত্য, মাঠের সব কিছুই খেয়াল করে দেখা সম্ভব হয় না। এই পরিস্থিতিতে আরও সতর্ক থাকতে হবে।”
- সয়লাব হোসেন টুটুল, সাধারণ সম্পাদক, আম্পায়ার্স ও স্কোরার অ্যাসোশিয়েশন
কী বলছেন প্রভাবশালী দুই পরিচালক
- “১৪ জন পরিচালক ৬০টা ক্লাব পরিচালনা করেন। তাহলে কেন শুধু আমার দিকে আঙুল? যদি কাউন্সিলরের ব্যাপার হতো, তাহলে তো আমার কেবল একটাই দরকার। আম্পায়ার অ্যালোকেশন নিয়ে যেটা বলা হচ্ছে, এটার দায়িত্ব তো আম্পায়ার্স কমিটির। আমার মনে হয়, কিছু মানুষ দেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে চাইছে।”
- ইসমাইল হায়দার মল্লিক
“তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি যাই না ওখানে। ওখানে কি হচ্ছে তা নিয়েও আমি আগ্রহী না। বেক্সিমকোর পাঁচ থেকে সাতটা দল আছে। তাদের খেলোয়াড় দরকার হলে আমি দিয়ে থাকি। সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। পরিচালকরা ক্লাবে যুক্ত থাকেন- এটা আমাদের দেশের পুরনো রীতি। আমার মনে হয়, ভিডিও ফুটেজের সাহায্যে সিসিডিএম খতিয়ে দেখতে পারে। তিন-চার বছর আগে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং করা যেত, এখন এটা সম্ভব না।”
- খালেদ মাহমুদ সুজন
সিসিডিএম চেয়ারম্যানের বক্তব্য
- “বাইলজ ভঙ্গ হওয়া দুর্ভাগ্যজনক। এটা আসলে একটা ভুল। এটা নেহায়েত ভুল নাকি ইচ্ছাকৃত তা খতিয়ে দেখতে কমিটি করা হয়েছে। এরকম ভুল যাতে আর না হয় সেজন্য আমরা ব্যবস্থা নিব। আমার মনে হয় না, ঢালাও অভিযোগের কোনো ভিত্তি আছে। আমাদের সভাপতি এসব ব্যাপারে খুব কঠোর।”
- কাজী ইনাম আহমেদ।
Comments