গরিবের চোখের আলো
৫০ বছর বয়সী বিধবা লাখপতি ভোর, কাজ করেন কুলাউড়া উপজেলার তিলকপুর চা বাগানে। স্বল্প আয়ের কারণে নিজের চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারতেন না এই চা শ্রমিক। ২০ বছর আগে জন্মের পরপরই প্রথম সন্তানকে হারান তিনি। এরপর স্বামীও অসুস্থ হয়ে মারা যান।
স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের জীবন অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে লাখপতির। কিছুদিন পর সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন তিনি। কিন্তু, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ায় সেটিও ছেড়ে দিতে হয় একসময়।
এরপর ভাইয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন । ভাইও একজন স্বল্প আয়ের চা শ্রমিক। যার দিন কাটতো দিন এনে দিন খেয়ে। ফলে বোনের পাশে দাঁড়ানো তার জন্য এক প্রকার অসম্ভবই ছিলো।
২০১৪ সালে, লাখপতি চা বাগান কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে একটি চক্ষু চিকিৎসা শিবিরের খোঁজ পান। সেখানকার ডাক্তার পরীক্ষার মাধ্যমে তার ডান চোখে ছানি শনাক্ত করেন। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় এবং বিনামূল্যে ছানি অপারেশন করা হয়।
শুধু লাখপতি নয়, তার মতো সিলেটের অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে এভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে মৌলভীবাজারের মাতারকাফন এলাকার বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল।
হাসপাতালটির নির্বাহী কমিটির যুগ্ম-সচিব আবদুল হামিদ মাহবুব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “১৯৭৪ সাল থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়াসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনএসবি।”
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় ২৬ লাখ মানুষকে বিনামূল্যে ও স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, ৫৮৯টি চক্ষু চিকিৎসা শিবির এবং ৯২০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছেন তারা।
বাংলাদেশ অন্ধ কল্যাণ সমিতি (বিএনএসবি) এই হাসপাতালটি চালুর পর ১৯৭৪ সালে মৌলভীবাজারে প্রথম চক্ষু চিকিৎসা শিবিরের আয়োজন করে।
১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য দাতাদের সহযোগিতায় বিএনএসবি একটি পরিপূর্ণ হাসপাতাল হয়ে ওঠে।
হাসপাতালটির ১৭ সদস্যের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব সৈয়দ মুশাহিদ আহমেদ চুন্নু বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য হলো জনসচেতনতা তৈরির মাধ্যমে অন্ধত্ব প্রতিরোধ করা।
তিনি বলেন, “আমরা আবাসিক ও বহির্বিভাগের সবধরনের রোগীর জন্যই ৫০ শতাংশ ছাড়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করছি। তবে, শিশু ও শিক্ষার্থীদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হয়।”
২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক চক্ষুসেবাদানকারী সংস্থা অরবিসের সহযোগিতায় হাসপাতালটিতে একটি বিশেষায়িত পেডিয়াট্রিক ইউনিট বসানো হয়। যা ছিলো সিলেট বিভাগের মধ্যে প্রথম।
হবিগঞ্জ সদরের বাসিন্দা মো. সিরাজ (৬০) বলেন, “আমি দীর্ঘদিন ধরে চোখের ব্যথায় ভুগছিলাম। কিছুদিন আগে আমি এখান থেকে চিকিৎসা ও ওষুধ নিয়েছি। এজন্য আমার মাত্র ১০০ টাকা খরচ হয়েছে। যা খুব বড় অঙ্ক নয়, তাই এমন সাশ্রয়ী সেবা পেয়ে আমি অনেক খুশি।”
সিলেটের কাজিরবাজারের মিনহাজ উদ্দীন (৪৫) বলেন, “চোখের অপারেশনের জন্য আমি এখানে দুদিন ছিলাম। চিকিৎসা খরচ, ওষুধ এবং খাবার মিলিয়ে মাত্র ১০০ টাকা খরচ হয়েছিলো।”
শ্রীমঙ্গলের ইছাপুর গ্রামের হাসিনা বেগম (৫৫) জানান, “গরিবের জন্য এই হাসপাতালটি আশীর্বাদ। আমি এখান থেকে এক মাস চিকিৎসা নিয়েছিলাম। আমার চোখ এখন ভালো হয়ে গেছে। এখানে আসতে পছন্দ করি, কারণ হাসপাতালটিতে কোনও বিশৃঙ্খলা নেই।”
হাসপাতালটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. এহসানুল মান্নান বলেন, এখানে মোট ১৩৪ জন পূর্ণকালীন কর্মী রয়েছে। তাদের মধ্যে ১৪ জন চিকিৎসক এবং ৩২ জন সেবিকা। এ-স্ক্যান, বি-স্ক্যান, লেজার চিকিৎসা, ছোট অপারেশন, ওয়ান-স্টপ ছানি ক্লিনিক, গ্লুকোমা ইউনিট, ডায়াবেটিক ইউনিট, অকুলার মাইক্রোবায়োলিজিক পরীক্ষাগার, ইন্ট্রাকুলার লেন্স ও ফ্যাকো সেবা, বিশেষ পেডিয়াট্রিক ইউনিট রয়েছে বিএনএসবি হাসপাতালে।
হাসপাতালের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে এখান থেকে চিকিৎসা নেন ১ লাখ ৮৭৭ জন মানুষ। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১ লাখ ৩ হাজার ৫৩৬ এবং ১ লাখ ৪ হাজার ৬৮০ জনে।
Comments