শ্রীমঙ্গলের ৬ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
পরিবেশবিদদের সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে শ্রীমঙ্গলে ৬ হাজার ৬৩২টি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে বনবিভাগ।
জানা গেছে, সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় চাওতলী এলাকার এসব গাছ কাটার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছিলো। শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া বনের পাশেই চাওতলী বনাঞ্চল।
গত বছরের ডিসেম্বরে চাওতলী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সেখানের চাপালি, বহেরা, ডুমুর, হর্তকি, আমলকি, জামরুল, লটকন, লুকলুকি এবং বাদাম গাছ চিহ্নিত করে তাতে লাল কালি দিয়ে সংখ্যা লেখা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বন সংরক্ষণ বিভাগের প্রধান মো. সাইফুল আলম চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বিষয়টি জানার পরে তারা সংশ্লিষ্টদের গাছ কাটা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। গতকাল (১ জানুয়ারি) তিনি আরও বলেন, “আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি।”
এর আগে আঞ্চলিক বন বিভাগ জানিয়েছিল, সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির কারণেই এসব গাছ কাটার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু, এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ এবং স্থানীয়দের প্রতিবাদের ফলে তারা বলতে শুরু করেন, গণনার জন্য এসব গাছ চিহ্নিত করা হয়েছিলো। বনবিভাগের মাধ্যমে সারাদেশে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিটি পরিচালিত হয়। এই কর্মসূচির আওতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত বর্ধনশীল গাছ লাগানো হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পরে তা কেটে ফেলা হয়। আর এ থেকে উপার্জিত অর্থ সরকার ও অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
মৌলভীবাজারের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সার্কেলের সহকারী সংরক্ষক আনিসুর রহমান সম্প্রতি এই এলাকাটি পরিদর্শন করেছেন এবং বনবিভাগের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। গতকাল (১ জানুয়ারি) তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ৩০ ডিসেম্বর আঞ্চলিক বনবিভাগ গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বাতিলের কথা জানিয়েছেলো। তিনি বলেন, “গাছগুলো কাটার আগে যারা এগুলো লাগিয়েছিলো তাদের সঙ্গে একটি বৈঠক হবে এবং কোনো ফলের গাছ কাটা হবে না।”
তিনি আরও বলেন, “সামাজিক বনায়নের জন্য চাওতলী বিট যেন ভবিষ্যতে আর না ব্যবহার করা হয় সেই সিদ্ধান্তও নেওয়া হবে ওই বৈঠকে।”
এখানে কেন সামাজিক বনায়ন?
লাওয়াছড়া একটি সংরক্ষিত বন। বিশ্বজুড়ে হুমকির মুখে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাস্থল হিসেবে এটি সুপরিচিত।
টুরিস্ট গাইড সাজু মারছিয়াং বলেন, পার্ক সংলগ্ন চাওতলী বিটটি ৩২ হেক্টর জায়গার উপর অবস্থিত। এখানের অধিকাংশ গাছ প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি বয়সী এবং এগুলো বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর প্রতিদিনের খাবারের অন্যতম উৎস।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি লাউয়াছাড়া থেকে বিরল বন্যপ্রাণীরা এসব গাছের ফল খেতে আসে, তারপর আবার ফিরে যায়। যদি গাছগুলো কেটে ফেলা হয় তাহলে এসব প্রাণী হুমকির মুখে পড়বে।”
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জড়িত প্রতিষ্ঠান মিতা ফাউন্ডেশনের সদস্য বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ৩২ হেক্টরের এ ফলের বাগানের মাত্র ১০ শতাংশ জায়গায় রয়েছে উপকারভোগীদের লাগানো একাশিয়া (আকাশমনি) এবং বেলজিয়া গাছ। কিছুদিন আগে থেকে এই দুই জাতের গাছগুলোর পাশাপাশি প্রায় সব ফলের গাছে ‘লাল নম্বর’ দিয়ে কেটে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে বন বিভাগ।
তিনি বলেন, এখানে পৃথিবীব্যাপী মহাবিপন্ন উল্লুকসহ চশমাপরা হনুমান, কুলু বানর, কোটা বানর, লজ্জাবতী বানর, উড়ন্ত কাঠবিড়ালী, বড় বাদুড়, গন্ধগোকুল প্রভৃতি প্রাণী রয়েছে।
সেখানকার ফল-ফুলের গাছের ওপর বণ্যপ্রাণীরা সরাসরি নির্ভরশীল। এ গাছগুলো যত কমবে ততই কিন্তু বণ্যপ্রাণীদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
লাউয়াছড়া বন ও জীব রক্ষা আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ ভূঁইয়া বলেন, অবৈধ কর্মকাণ্ডের ফলে দিনদিন এখানকার বনে গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, “বন ধ্বংসের ফলে বন্যপ্রাণীর খাবারের উৎস কমে গেছে। ফলে বহু প্রজাতি এখন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়ে বনবিভাগও একই কাজ করছে বলে আমার মনে হয়।” “কেন প্রাকৃতিক বনে সামাজিক বনায়ন হচ্ছে?” প্রশ্ন করেন এই পরিবেশ কর্মী।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী সদস্য আব্দুল করিম কিম বলেন, লাউয়াছড়া বনটি বাংলাদেশের জন্য মূল্যবান সম্পদ। আইন প্রয়োগ ও যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে এই বন রক্ষা করা উচিত। তিনি বলেন, “আমাদের দেশে আইন আছে। কিন্তু আইন প্রয়োগের অভাবে দুর্নীতির সুযোগ বাড়ছে।”
তিনি আরও বলেন, “এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই রেইনফরেস্টের জীববৈচিত্র্যের কথা সরকারের বিবেচনা করা উচিত ছিলো।”
Comments