পুরনো বোতলে নতুন মাদক

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে যাওয়া এই পথ ধরে ভারতের আগরতলা বিমানবন্দরে পৌঁছানো যায়। এই পথ ধরেই চোরাচালানকারীরা ভারত থেকে নিয়ে আসছে ফেন্সিডিল। ছবি: মাসুক হৃদয়

নতুন উদ্ভাবনে আখাউড়া সীমান্তে চলছে মাদকের জমজমাট ব্যবসা।

ফেন্সিডিল ক্রেতা সেজে ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর আখাউড়ার আনোয়ারপুর গ্রামের আবু রায়হানের বাড়িতে যান দুই সংবাদদাতা।

তবে রায়হানের শর্ত একটাই, তার সামনেই খেতে হবে ফেন্সিডিল এবং খালি বোতল তাকে ফেরত দিতে হবে।

শর্তে রাজী হলে, বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে সিল নষ্ট না করেই ফেন্সিডিলের বোতল খোলেন রায়হান।

রায়হান বলেন, “আপনারা ভাগ্যবান যে খাঁটি ফেন্সিডিল পেয়েছেন। সাধারণত ভারতীয় কাশির সিরাপ এসকফ, চিনির শরবত আর এনার্জি ড্রিংক থাকে।”

রায়হান আগে মাদক ব্যবসায়ী কাপ্তান মিয়া এবং কাজলের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্র অনুযায়ী, গত বছরের ৫ অক্টোবর কাপ্তানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ এবং ১৪ অক্টোবর আত্মসমর্পণ করেন কাজল।

গত বছরের শুরুর দিকে রায়হানকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তবে, এক মাসের মধ্যে জামিন পেয়ে যান তিনি।

ভারত সীমান্তবর্তী আখাউড়ার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্যে রায়হান ও কয়েকজন ব্যবসায়ী সেখানকার তিনটি গ্রামে (আনোয়ারপুর, চানপুরান্দ ও ছোট কুড়িপাইকা) মাদকের ব্যবসা করছেন।

মাদক ব্যবসায় নতুন কৌশল নিয়েছে এই চক্র। ভারতে নিষিদ্ধ কাশির ওষুধ এসকফ, চিনির সিরাপ ও কয়েক ফোটা এনার্জি ড্রিংক মিশিয়ে ফেন্সিডিল হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে।

এ কারণে আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন গ্রামে ১০০ টাকা পর্যন্ত দামে ফেন্সিডিলের খালি বোতল বিক্রি হচ্ছে। তবে শর্ত হচ্ছে ক্যাপের সিল ভাঙা থাকলে চলবে না।

সীমান্ত এলাকায় এক বোতল “আসল” ফেন্সিডিলের দাম ১ হাজার ২০০ টাকা হলেও এই চক্রের নকল ফেন্সিডিল ৮০০ টাকাতেই কিনতে পাওয়া যায়।

ভারতে নিষিদ্ধ এসকফ সিরাপ মাদকসেবিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫০০ টাকায় এক বোতল এসকফ বিক্রি হয়।

তারাগান গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী কাজী আনোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “একবার পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরার সময় কয়েকশ ফেন্সিডিলের বোতল পেয়েছিলাম। পানিভরা বোতলগুলোর ক্যাপের সিল অক্ষত ছিলো।”

আখাউড়ার নারায়ণপুরের ভাঙারি ব্যবসায়ী মো. আলমগীর জানান, ২০ বছর এই ব্যবসা করছেন তিনি। এক বছর আগেও প্রতি মাসে ৬০ ব্যাগ খালি ফেন্সিডিলের বোতল বিক্রি করতেন। তবে এখন আর ফেন্সিডিলের বোতল তেমন পাওয়া যায় না, এমনকি মাসে এক বা দুই ব্যাগ বোতলও বিক্রি করতে পারেন না তিনি।

লাল সংকেত

অক্টোবরের ৮ তারিখ বিকাল ৩টার দিকে সীমান্তের শূন্যরেখায় এক যুবককে লাল গামছা পরে হাঁটতে দেখেন ডেইলি স্টারের দুই সাংবাদিক। এসময় একদল মানুষের দিকে একটি ছোট প্লাস্টিকের ব্যাগ ছুঁড়ে দিয়ে হাটা দেন তিনি।

প্রতিবেদকদের সঙ্গে থাকা স্থানীয় একজন যুবককে ডেকে বলেন, “আমরা প্রশাসনের লোক না, আমরা এখানে এসকফ কিনতে এসেছি।”

যুবকটি এরপর সামনে এসে জানান, কয়েক বোতল এসকফ যোগাড় করে দিতে পারবে। তবে প্রতি বোতলের দাম পড়বে ৫০০ টাকা করে।

এ সময় তার কাছে জিন্সের প্যান্টের উপর গামছা পরার কারণ জানতে চাইলে জানান, ভারতের মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য এটি এক ধরনের সংকেত এবং এর মাধ্যমে বোঝানো হয় এই মুহূর্তে সীমান্ত নিরাপদ। তারা চাইলে এপাশে মাদক ফেলে দিতে পারবেন।

লেনদেনের বিষয়ে তিনি বলেন, “বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশি টাকাই পাঠানো হয়, তবে বড় লেনদেন হলে ডলারে পরিশোধ করা হয়।”

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে এই জেলা থেকে ৭ হাজার ৮১৩ বোতল ফেন্সিডিল এবং ৫ হাজার ৬৩৭ বোতল এসকফ জব্দ করা হয়েছে।

গত বছরের প্রথম নয় মাসে জেলা পুলিশ ৩ হাজার ৭৩ বোতল এসকফ এবং ২ হাজার ১৩৬ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করে।

একইসময়ে, মাদক বিক্রি ও পাচারের দায়ে ১ হাজার ৩৬৩টি মামলা হয়েছে এবং ২ হাজার ১১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ২০১৮ সালে ১ হাজার ৫৭৭টি মামলা হয় এবং ২ হাজার ৫১ জনকে গ্রেপ্তার করেছিলো পুলিশ।

ফেনসিডিল এবং এসকফের ব্যবহার সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মজিবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, কেউ যদি প্রেসক্রিপশন ছাড়া ক্রমাগত কাশির সিরাপ গ্রহণ করেন, তাহলে তিনি এতে আসক্ত হয়ে পড়বেন।

তিনি বলেন, “ব্যক্তিটি ধীরে ধীরে তার নিয়মিত জীবনযাপনের ক্ষমতা হারাবেন।" 

শূন্য রেখায় বাড়ি

পুলিশের একটি সূত্র সংবাদদাতাদের আাখাউড়ার স্থলবন্দরের বাউতলা গ্রামে নিয়ে যান। এ সময় তারা শূ্ন্যরেখার ওপাশে ভারত সীমান্তে অনেকগুলো বাড়ি দেখিয়ে জানান, ফেন্সিডিল, এসকফসহ অন্যান্য মাদক আনা ও রাখার জন্য ওই বাড়িগুলো বানানো হয়েছে।

সীমান্তের অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে বা নজরদারি কমলে পাচারকারীরা ওখান থেকে বাংলাদেশে মাদক পাচার করে।

এসব বাড়ির একজনের মালিক হলেন মো. হানিফ মিয়া। তিনি বিভিন্ন মাদক চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।

গত বছরের শেষের দিকে আখাউড়া থানার ওসি রসুল আহমেদ নিজামী দ্য ডেইল স্টারকে জানিয়েছিলেন, মাদক চোরাকারবারীরা প্রায়ই সীমান্তের এসব বাড়িতে আশ্রয় নেন।

তিনি আরও জানান, পুলিশের সেখানে যাওয়ার অনুমতি না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই।

গত বছরের অক্টোবরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ব্যাটালিয়ান-২৫ এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল গোলাম কবীর দ্য ডেইল স্টারকে বলেন, “আমরা বিষয়টি ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে জানিয়েছি এবং এখানকার পরিস্থিতি উন্নয়নে কাজ করছি।”

তিনি আরও বলেন, “সীমান্ত অঞ্চলের নজরদারি বাড়াতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।”

রক্ষাকর্তা!

আখাউড়া উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান স্বপন পুলিশের তালিকায় থাকা মাদকব্যবসায়ীদের আত্মসমপর্ণে সহযোগিতা করেছেন।

তবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের অনেকের দাবি, চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান স্বপন এই ব্যবসার অন্যতম একজন। স্বপনের ভাগ্নে সাদ্দামকে অক্টোবরের ২৫ তারিখে আখাউড়ার আজমপুর এলাকা থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো।

তিনি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১০০ জনের একটি দল পরিচালনা করেন বলেও জানা গেছে।

তবে, এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি অভিযুক্ত চেয়ারম্যান স্বপন। বরং তিনি সংবাদদাতাদের স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতায় এলাকাটি ঘুরে দেখতে বলেন।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago