‘কেউ আমাদের দমাতে পারবে না’
অবশেষে সব অপেক্ষার অবসান ঘটল, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দেশের মানুষের পুনর্মিলনের মুহূর্ত। যারা তাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসেন এবং যাদের জন্যে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাদের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার দিন আজ। উড়োজাহাজ থেকে নেমে এসে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে যখন পা রাখলেন তিনি, চারদিকে তখনই স্বস্তি, আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের ঝলকানি দেখা যায়।
বন্দি হওয়ার আগে যে বাংলাদেশকে তিনি রেখে গিয়েছিলেন, তাকে ততোদিন ছিঁড়ে-খুবলে খেয়েছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বাংলার মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে, নারী ধর্ষিত হয়েছে, শিশুদেরকে হত্যা করা হয়েছে, মুক্তিকামী যুবকের লাশ ভাসছে নদীর বুকে এবং এক কোটি লোককে ঘরছাড়া করে শরণার্থী হিসেবে প্রতিবেশী ভারতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
তিনি ফিরে এসেছেন। তাই মানুষ আজ সব দুর্ভোগ-যন্ত্রণা ভুলে গেলো মুহূর্তে। পরম আনন্দের দিন আজ। যার নেতৃত্বে জাতি আজ স্বাধীন, বিজয়ের উচ্ছ্বাস উদযাপন তো তাকে ছাড়া হয় না।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি নেতার প্রতি ভক্তির গৌরবময়তা ও বিশালতার এক অনন্য নিদর্শন দেখিয়েছে বাঙালি জাতি। ছোট্ট শহর ঢাকার বিমানবন্দরে নেমে রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আসার পথ পুরোটাই মানুষে মানুষে ছেয়ে গিয়েছিলো।
কান্নায় ভারী হয়ে আসছিলো তার কণ্ঠস্বর, কিন্তু তীব্র বজ্রধ্বনিতে যখন আওয়াজ তুললেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তখনই দেশের জনগণ পলকে টের পেল তাদের মাঝে প্রিয় নেতার উপস্থিতি। স্বাধীনতার লড়াইয়ের ডাক দেওয়ার সেই ৭ মার্চের মুহূর্তগুলোই যেনো ফিরে এসেছে আবার। একইস্থানে দাঁড়িয়ে তিনি এখন সেই জনগণকে শুভেচ্ছা জানাবেন, যারা আজ তার স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে; শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছে তাদের জাতির পিতাকে।
মুজিববর্ষ- বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে দ্য ডেইলি স্টারের প্রচ্ছদে চার পাতার বিশেষ ক্রোড়পত্র এবং ভিতরে দুই পাতার বিশেষ আয়োজনে ৪৮ বছর আগের সেই মোহময় ক্ষণগুলোকে আবার তৈরি করার চেষ্টা করেছি যেনো, দেশের জন্যে বঙ্গবন্ধুর অবদান বর্তমান প্রজন্ম উপলব্ধি করতে পারবে।
-সম্পাদক
“আমি প্রথমে স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী জনগণকে, হিন্দু-মুসলমানকে। যাদের হত্যা করা হয়েছে আমি তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করি।
আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারবো না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু, আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবে না। আমি আমার যেই ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে, তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আজ প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা হয়ে হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এতো মানুষ এতো সাধারণ জনগণ মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই যা আমার সাত কোটির বাংলায় করা হয়েছে। আমি জানতাম না আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসবো। আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও কোনো আপত্তি নাই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিও- এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।
আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে। আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের জনগণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের সামরিক বাহিনীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই রাশিয়াকে, আমি মোবারকবাদ জানাই জার্মানি, ব্রিটিশ, ফ্রান্স সব জায়গার জনগণকে। তাদের আমি মোবারকবাদ জানাই যারা আমাকে সমর্থন করেছে।
আমি মোবারকবাদ জানাই আমেরিকার জনসাধারণকে, মোবারকবাদ জানাই সারাবিশ্বের মজলুম জনগণকে যারা আমার এই মুক্তির সংগ্রামে সাহায্য করেছে। আমার বলতে হয়, এক কোটি লোক এই বাংলাদেশ থেকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিলো। ভারতের জনসাধারণ, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। তাদের আমি মোবারকবাদ না দিয়ে পারি না। যারা অন্যরা সাহায্য করেছেন তাদের আমার মোবারকবাদ দিতে হয়।
তবে মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে, বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি যাবার আগে বলেছিলাম, বাঙালি এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সংগ্রাম করছো। আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই, বহু কর্মী, আমার বহু মা-বোন আজ দুনিয়ায় নাই। তাদের আমি দেখবো না।
আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম বাংলার আবহাওয়া অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই। আমার সোনার বাংলা, তোমায় আমি বড় ভালোবাসি। বোধহয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।
দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন, আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার খাবার নাই। আমার জনগণ গৃহহারা-সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো। মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। তোমরা আমার বাংলাদেশকে রিকোগনাইজ করো। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও, দিতে হবে, উপায় নাই, দিতে হবে। আমি আমরা হার মানবো না, আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-
“সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি”
কবিগুরু আজ মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে এতো লোক আত্মাহুতি, এতো লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি আমায় দাবায় রাখতে পারবা না।
আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম- ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, তোমাদের মোবারকবাদ জানাই তোমরা গেরিলা হয়েছো। তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।
একটা কথা, আজ থেকে বাংলায় যেনো আর চুরি-ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেনো আর লুটতরাজ না হয়। বাংলায় যারা অন্য লোক আছে অন্য দেশের লোক, পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, বাংলায় কথা বলে না তাদের বলছি তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। আর আমি আমার ভাইদের বলছি, তাদের উপর হাত তুলো না। আমরা মানুষ, মানুষ ভালোবাসি।
তবে যারা দালালি করেছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। তাদের বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন, একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের, শাস্তি হবে। আমি দেখিয়ে দিতে চাই দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।
আমায় আপনারা পেয়েছেন। আমি আসছি। জানতাম না আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিলো। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ। মুসলমান একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আসে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো। আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাবো না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না।
এবং যাবার সময় বলে যাবো জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।
ভাইয়েরা আমার যথেষ্ট কাজ পরে রয়েছে। আমার সকল জনগণকে দরকার। যেখানে রাস্তা ভেঙে গিয়েছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দাও। আমি চাই জমিতে যাও ধান বুনো, কর্মচারীদের বলি একজনও ঘুষ খাবেন না। মনে রাখবেন, তখন সুযোগ ছিলো না, আমি অপরাধ ক্ষমা করবো না।
ভাইয়েরা আমার, যাওয়ার সময় আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তাজউদ্দীন, নজরুলেরা আমাকে ছেড়ে যায়। আমি বলেছিলাম ৭ কোটি বাঙালির সাথে মরতে আমার ডেকো না। আমি আশীর্বাদ করছি। ওরা কাঁদছিল। আমি বলি, তোরা চলে যা। আমি এই বাড়িতে মরতে চাই। এটাই হবে বাংলার জায়গা। এখানেই আমি মরতে চাই। ওদের কাছে মাথা নত করতে আমি পারবো না।
ড. কামালকে নিয়ে ৩ মাস জেরা করছে- আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দাও। কয়েকজন বাঙালি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে। তাদের আমরা জানি, চিনি এবং তাদের বিচারও হবে। আপনারা বুঝতে পারেন- “নম নম নম সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি, গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবনও জুড়ালে তুমি।”
আজ আমি যখন এখানে নামছি আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। যে মাটিকে আমি এতো ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এতো ভালোবাসি, যে জাতকে আমি এতো ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কী না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।
পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি, তোমরা সুখে থাকো। তোমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা যা করেছে আমার মা-বোনদের রেপ করেছে, আমার ৩০ লক্ষ লোককে মেরে ফেলে দিয়েছে, যাও সুখে থাকো। তোমাদের সাথে আর না। তোমরা স্বাধীন থাকো, আমিও স্বাধীন থাকি।
তোমাদের সাথে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বন্ধুত্ব হতে পারে। তাছাড়া বন্ধুত্ব হতে পারে না। তবে যারা অন্যায়ভাবে অন্যায় করেছে তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হবে। আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাই। আমি আরেকদিন বক্তৃতা করবো। একটু সুস্থ হয়ে লই। আপনারা চেয়ে দেখেন, আমি সেই মুজিবর রহমান আর নাই। আমার বাংলার দিকে চেয়ে দেখেন, সমান হয়ে গেছে জায়গা, গ্রাম এর পর গ্রাম পুড়ে গেছে। এমন কোনো পরিবার নাই যার মধ্যে আমার লোককে হত্যা করা হয় নাই।
কতোবড় কাপুরুষ যে নিরপরাধ লোককে এভাবে হত্যা করে এভাবে সামরিক বাহিনীর লোকেরা। আর তারা বলে কী আমরা পাকিস্তানের মুসলমান সামরিক বাহিনী। ঘৃণা করা উচিত। জানানো উচিত, দুনিয়ার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পরে বাংলাদেশই দ্বিতীয় মুসলিম দেশ।
আমার রাষ্ট্রে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র। এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। যারা জানতে চান, আমি বলে দিবার চাই আসার সময় দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথা হয়েছে। আমি আপনাদের বলতে পারি তাকে জানি, আমি তাকে শ্রদ্ধা করি, সে পণ্ডিত নেহরুর কন্যা, সে মতিলাল নেহরুর ছেলের মেয়ে। তারা রাজনীতি করেছে, ত্যাগ করেছে, তারা আজকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে। যেদিন আমি বলবো সেদিন ভারতের সৈন্য বাংলার মাটি ছেড়ে চলে যাবে এবং তিনি আস্তে আস্তে কিছু সরিয়ে নিচ্ছেন।
যে সাহায্য তিনি করেছেন আমি আমার সাত কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে তাকে, তার সরকারকে, ভারতের জনগণকে শ্রদ্ধা, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই।
ব্যক্তিগতভাবে এমন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান নাই যার কাছে তিনি আপিল করেন নাই, শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে বলেছেন, তোমরা ইয়াহিয়া খানকে বলো- শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে, একটা রাজনৈতিক সমাধান করতে। এক কোটি লোক নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য দেশে চলে গেছে? এমন অনেক দেশ আছে যেখানে লোক সংখ্যা দশ লাখ, ১৫ লাখ, ২০ লাখ, ৩০ লাখ, ৪০ লাখ, ৫০ লাখ। আর আমার বাংলা থেকে এক কোটি লোক মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে ভারতে স্থান নিয়েছিলো। কতো অসুস্থ হয়ে মারা গেছে, কতো না খেয়ে কষ্ট পেয়েছে, কতো ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এই পাষাণদের দল।
ক্ষমা করো। আমার ভাইয়েরা ক্ষমা করো। আজ আমার কারো বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা নাই। একটা মানুষকে তোমরা কিছু বলো না। অন্যায় যে করেছে তাকে সাজা দিবো। আইন নিজের হাতে তুলে নিও না। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো, ছাত্রসমাজ তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো, শ্রমিকসমাজ তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো। বাংলার হতভাগ্য হিন্দু-মুসলমান আমার সালাম গ্রহণ করো।
আর আমার কর্মচারী, পুলিশ, ইপিআর যাদের উপর মেশিনগান চালিয়ে দেয়া হয়েছে, যারা মা-বোন ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছে, তার স্ত্রীদের ধরে কুর্মিটোলা নিয়ে যাওয়া হয়েছে- তোমাদের আমি সালাম জানাই, তোমাদেরকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।
নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা। বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে- এই আমার সাধনা। এই আমার জীবনের কাম্য। আমি যেনো এই কথা চিন্তা করেই মরতে পারি। এই আশীর্বাদ এই দোয়া আপনারা আমাকে করবেন। এই কথা বলে আপনাদের কাছে থেকে বিদায় নিবার চাই। আমার সহকর্মীদের আমি ধন্যবাদ জানাই, যাদের আমি যে কথা বলে গিয়েছিলাম- তারা সকলে একজন একজন করে প্রমাণ করে দিয়ে গেছে। মুজিব ভাই বলে গিয়েছে তোমরা সংগ্রাম করো, তোমরা স্বাধীন করো, তোমরা জান দাও, বাংলার মানুষকে মুক্ত করো।
আমার কথা চিন্তা করো না, আমি চললাম। যদি ফিরে আসি, আমি জানি- আমি ফিরে আসতে পারবো না। আজ আল্লাহ আছে, তাই আজ আমি আপনাদের কাছে ফিরে এসেছি। তোমাদের আমি মোবারকবাদ জানাই। আমি জানি কী কষ্ট তোমরা করছো। আমি কারাগারে ছিলাম নয় মাস। আমাকে কাগজ দেয়া হয় নাই। এ কথা সত্য, আসার সময় ভুট্টো আমায় বললেন, শেখ সাব দেখেন দুই অংশের কোনো একটা বাঁধন রাখা যায় নাকি। আমি বললাম, আমি বলতে পারি না। আমি বলতে পারবো না, আমি কোথায় আছি। আমি বাংলায় গিয়ে বলবো। আজ বলছি, ভুট্টো সাহেব সুখে থাকো। বাঁধন ছিঁড়ে গেছে। আর না। তুমি যদি কোনো বিশেষ শক্তির সাথে গোপনে আমার বাংলার স্বাধীনতা হরণ করতে চাও, মনে রেখো, দলের নেতৃত্ব দিবে শেখ মুজিবুর রহমান। মরে যাবো, স্বাধীনতা হারাতে দিবো না।
ভাইয়েরা আমার, আমার চার লক্ষ বাঙালি আছে পাকিস্তানে। আমি অনুরোধ করবো, তবে একটা জিনিস আমি বলতে চাই, ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে জাতিসংঘের মাধ্যমে অথবা ওয়ার্ল্ড জুরির পক্ষ থেকে একটা ইনকোয়ারি হতে হবে, কী পাশবিক অত্যাচার; কীভাবে হত্যা করা হয়েছে আমার লোকেদের। এ সত্য দুনিয়ার মানুষকে জানতে হবে। আমি দাবি করবো জাতিসংঘকে, বাংলাদেশকে আসন দাও এবং ইনকোয়ারি করো। ভাইয়েরা আমার, যদি কেউ চেষ্টা করেন ভুল করবেন। আমি জানি ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই। সাবধান বাঙালিরা, ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই।
একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলো। একদিন বলেছিলাম, যার যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধ করো। বলেছিলাম, এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এ জায়গায়। ৭ মার্চ। আজ বলছি, তোমরা ঠিক থাকো, একতাবদ্ধ থাকো, কারো কথা শুনো না।
ইনশাল্লাহ স্বাধীন যখন হয়েছি স্বাধীন থাকবো। একজন মানুষ এই বাংলাদেশে বেঁচে থাকতে এই সংগ্রাম চলবে। আজ আমি আর বক্তৃতা করতে পারছি না। একটু সুস্থ হলে আবার বক্তৃতা করবো। আপনারা আমাকে মাফ করে দেন। আপনারা আমাকে দোয়া করেন। আপনারা আমার সাথে সকলে মুনাজাত করেন।”
Comments