অসহনীয় শব্দদূষণ
ঘনিয়ে এসেছে ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনের সময়। এখন নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত প্রার্থীরা। তবে, নির্বাচনী বিধিতে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও লাউডস্পিকার ব্যবহার করে উচ্চশব্দে প্রচারণা চালাচ্ছেন প্রার্থীরা।
সিটি করপোরেশন (নির্বাচনী আচরণবিধি) বিধিমালা ২০১৬ এর ২১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে লাউডস্পিকার ব্যবহার করে প্রচারণা চালানো যাবে।
বিধিতে আরও বলা আছে, কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষে কেউ প্রচারণা বা সমাবেশে একাধিক মাইক্রোফোন বা সাউন্ড অ্যামপ্লিফায়ার (শব্দ পরিবর্ধক) ব্যবহার করতে পারবেন না।
কিন্তু বাস্তবে এসব মানছেন না কেউ। গত ১০ জানুয়ারি প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন নগরবাসী। নির্বাচনী বিধিমালায় বেঁধে দেওয়া সময়ের বাইরেও গাড়িতে লাউডস্পিকার লাগিয়ে উচ্চস্বরে গান- স্লোগান বাজিয়ে চলছে অসহ্য প্রচারণা।
এক সপ্তাহ পরেই এসএসসি পরীক্ষা। শহরজুড়ে দিনব্যাপী এসব নির্বাচনী প্রচারণার কারণে সৃষ্ট শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পরীক্ষার্থীরা। এছাড়াও, এরকম উচ্চশব্দে বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
গত ২৩ জানুয়ারি দুপুরের দিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে রিকশায় মাইক লাগিয়ে এক ব্যক্তিকে প্রচারণা চালাতে দেখেন দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি।
সেখান থেকে দুই-তিন মিনিট হেঁটে এগোতেই সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের কাছে তৈরি করা মঞ্চে এক মেয়রপ্রার্থীকে ভোটারদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে দেখা যায়। সেখানেও লাউডস্পিকারে মেয়রপ্রার্থীর প্রচারণার জন্য গান বাজছিল।
গেন্ডারিয়ার পুকুরপাড়স্থ ডিআইটি প্লটে ১০০ ফুট দূরত্বের দুই স্থানে লাউডস্পিকার বাজিয়ে দুই কাউন্সিলরপ্রার্থীর প্রচারণা চলতে দেখা যায়।
নিজের নাম উল্লেখ না করে গেন্ডারিয়ার সতিশ সরকার লেনের এক বাসিন্দা বলেছেন, “আমার মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী। উচ্চস্বরে নির্বাচনী প্রচারণা চলার কারণে তার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বেশ সমস্যা হলেও কিছুই করার নেই।”
খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা শাহিদা কাদের। তার মেয়েও এসএসসি পরীক্ষার্থী। প্রতিদিন সকাল থেকেই তার এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয় বলে জানান তিনি। “মেয়ের পরীক্ষার অল্প কিছুদিন বাকি। কিন্তু উচ্চশব্দে পড়াশোনায় মন দেওয়া দায়। কিন্তু এটা সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই,” বলেন শাহিদা।
৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে এসএসসি পরীক্ষা।
২৩ জানুয়ারি রাত ১০টার দিকেও দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতা অন্তত তিনটি স্থানে লাউডস্পিকারে নির্বাচনী প্রচারণা চলতে দেখেন।
ওই এলাকার একজন নারী কাউন্সিলরপ্রার্থীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে তিনি জানিয়েছেন, রাত ১০টার দিকে প্রচারণা চালানোর ব্যাপারটি তিনি জানেন না। তবে তিনি তার সমর্থকদের নির্বাচনী বিধি মেনে প্রচারণা চালাতে বলবেন।
উত্তর সিটি করপোরেশন
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়েও প্রার্থীদের প্রচার প্রচারণা বিধি লঙ্ঘন করতে দেখেন দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি।
১৮ নম্বর ওয়ার্ডস্থ নদ্দা এলাকায় থাকেন এসএসসি পরীক্ষার্থী তিনমণি রিচিল। তিনি বলেছেন, “তাদের প্রচারণার ব্যাপারে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তবে লাউডস্পিকার বাজানোটা খুব বিরক্তিকর। বিশেষভাবে, যখন পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করতে হয় এবং ক্রমাগত উচ্চশব্দে এসব চলতে থাকে তখন খুবই বিরক্ত লাগে।”
তিনি বলেছেন, “এসএসসি পরীক্ষা আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে চাই।”
দিনের যেসময় লাউডস্পিকারে প্রচারণা চালানো নিষেধ, সেসময়ে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে বিভিন্ন প্রার্থীর প্রচারণায় রিকশায় লাউডস্পিকার বাজাতে দেখেনদ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতা।
বিধি লঙ্ঘন করে লাউডস্পিকারে প্রচার চলছিল যে কাউন্সিলরপ্রার্থীর, তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেছেন, “রিকশাচালকরা বিধিতে থাকা সময়ের বিষয়টা জানেন না। তাই অননুমোদিত সময়ে হয়তো তারা প্রচারণা চালায়। তবে আমি এখন থেকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকব।”
এছাড়া, অন্যান্য প্রার্থীরাও একই কাজ করেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
শব্দের অনুমোদিত মাত্রা
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুসারে, আবাসিক অঞ্চলে শব্দের দিনের বেলায় ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবল মাত্রায় শব্দের অনুমতি রয়েছে।
শিল্প অঞ্চলগুলোতে এই মাত্রা দিনে ও রাতে যথাক্রমে ৭৫ ডেসিবল এবং ৭০ ডেসিবল। এছাড়া, সেটি আবাসিক ও শিল্পাঞ্চল, দুটোই, সেখানে দিনে ৬০ ডেসিবল এবং রাতে ৫০ ডেসিবল।
বিধি অনুযায়ী, যেকোনো হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অফিসের ১০০ মিটারের মধ্যে লাউডস্পিকার ব্যবহার এবং যানবাহনের হর্ন দেওয়াও নিষেধ।
যেকোনো অনুষ্ঠানে লাউডস্পিকার ব্যবহারের জন্য অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক বলে উল্লেখ করা আছে বিধিতে।
অসহনীয় শব্দদূষণ
পরিবেশন বাঁচাও (পবা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেছেন, “প্রার্থীরাই যদি বিধি লঙ্ঘন করে ও নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়, তাহলে অন্য যে কেউই এ ধরনের কাজে উৎসাহ পাবে।”
“তবে আমরা আশা করবো প্রার্থীরা পরিবেশ আইন মেনে চলবে এবং পরিবেশের ক্ষতি ও শব্দদূষণ হয়, এমন কিছু তারা করবেন না,” যোগ করেন তিনি।
রাজধানীতে শব্দদূষণের তীব্রতা ইতোমধ্যে অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “লাউডস্পিকারের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফলে শব্দদূষণের মাত্রা আরও বেড়ে চলেছে। এটি প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাশেমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেছেন, “নির্বাচনী প্রচারণায় লাউডস্পিকারের ব্যবহার রোধে আমারা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।”
“আমরা ইতোমধ্যে প্রার্থীদের প্রচারণায় ব্যবহার করায় বেশ কয়েকটি লাউডস্পিকার বাজেয়াপ্ত করেছি এবং তাদের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছি। দুর্ভাগ্যক্রমে, এসব বিষয় নিয়ে প্রার্থীরা ভাবেন না,” যোগ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে কথা বলতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি। কিন্তু তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
Comments