সরগরম বাংলাবাজার

বই আর বই। চারদিকে শুধু বই। ঘর ভর্তি কেবলই বই। সেলফ ভর্তি বই। মেঝেতেও বই। নতুন বইয়ে ভরে আছে প্রকাশকদের ঘর। নতুন বই ঘর ছাড়িয়ে জমা হচ্ছে গোডাউনে।
ভ্যানগাড়ি ভর্তি নতুন বই আসছে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ বাংলাবাজার থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশে। ছবি: শেখ মেহেদী মোর্শেদ

বই আর বই। চারদিকে শুধু বই। ঘর ভর্তি কেবলই বই। সেলফ ভর্তি বই। মেঝেতেও বই। নতুন বইয়ে ভরে আছে প্রকাশকদের ঘর। নতুন বই ঘর ছাড়িয়ে জমা হচ্ছে গোডাউনে।

ভ্যানগাড়ি ভর্তি নতুন বই আসছে। মাথায় করে আনা হচ্ছে নতুন বই। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ বাংলাবাজার থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশে।

বছরের এই সময়টায় এমনই দৃশ্য দেখা যায় বাংলাবাজারে। এই সময়ের বাংলাবাজারের সকাল বিকেলের চিত্র এটা।

দেশের সবচেয়ে বড় বইয়ের বাজার হচ্ছে বাংলাবাজার। যাকে অনেকে বলে থাকেন বইয়ের বাড়ি অথবা বইয়ের আদি ঠিকানা।

বই মেলার বাকি আছে তিন দিন। মাসব্যাপী অমর একুশে বই মেলার জন্য এখন পুরোপুরি প্রস্তুত বাংলাবাজারের প্রকাশকরা। দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটছে তাদের।

প্রত্যেক বছর অমর একুশে বই মেলাকে ঘিরে প্রকাশকদের ব্যস্ততা বাড়ে। জানুয়ারি মাসের এই সময়টায় এসে সেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। বাংলাবাজারে ছোট বড় মিলিয়ে প্রকাশকের সংখ্যা প্রায় চারশ। সবার মাঝেই এখন বই মেলার ব্যস্ততা।

বাংলাবাজারে বইয়ের জন্য রয়েছে অনেকগুলো ভবন। ছোটবড় গলি রয়েছে অনেকগুলো। সবগুলো গলিতে এখন নতুন বইয়ের ভ্যানগাড়িতে ভরা। এছাড়া এই সময়ে এসে বই বহন করার জন্য শ্রমিকের চাহিদাও বেড়ে যায়। এই তথ্য জানালেন বাংলাবাজারের পার্ল পাবলিকেশন্স এর প্রকাশক হাসান জায়েদী।

বাংলাবাজারে নতুন বইয়ের ঘ্রাণের সঙ্গে সঙ্গে আছে ব্যস্ততা। সেই ব্যস্ততা ছড়িয়ে পড়েছে এই এলাকার আশপাশের বিভিন্ন ছাপাখানায়ও। সবগুলো ছাপাখানায় এখন দিন রাত বই ছাপা চলছে। একশরও বেশি রয়েছে বাঁধাইঘর। সেসব বাঁধাইঘরে চলছে রাত জেগে বই বাঁধাই। একজন প্রকাশক জানালেন, এই সময়টায় এসে বাঁধাইকারিরাও মজুরি বাড়িয়ে দেয়।

প্রত্যেক বছর অমর একুশে বই মেলাকে কেন্দ্র করে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়ে থাকে। পাশাপাশি পাঠক সাড়া পাওয়া পুরনো বইগুলোও নতুন করে ছাপা হয়। এছাড়া কোনো কোনো লেখকের বই দ্বিতীয় মুদ্রণ বা তৃতীয় মুদ্রণও আসে। সেসবও এই সময়টায় ছাপা হয়ে থাকে।

মোটকথা বাংলাবাজার এখন নতুন বই নিয়ে নতুন সাজে সেজেছে।

পুরনো বই নতুন করে ছাপার মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে হুমায়ূন আহমেদের  লেখা বই। এখনো তাঁর লেখা বই সর্বোচ্চ বিক্রির তালিকায় রয়েছে। বিশেষ করে তাঁর লেখা হিমু সিরিজ, মিসির আলী সিরিজ এই প্রজন্মের পাঠকরা বেশি কেনেন। সেভাবেই প্রকাশকরা এইসব বই প্রতি বছরই মেলার সময়ে বেশি ছাপিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ  বাংলাবাজারের প্রকাশকদের এবারের বই মেলার প্রস্তুতির বিষয়ে ডেইলি স্টারকে বলেন, “আমরা এখন প্রস্তুতির সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছি। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে যেমন ব্যস্ততা, একইভাবে ছাপাখানায়ও ব্যস্ততা। মেলার প্রথম সপ্তাহেই আমাদের বেশিরভাগ নতুন বই চলে আসবে। এজন্য আমরা ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছি।”

ফরিদ আহমেদ আরও বলেন, “এ বছর ৩৪টি প্যাভিলিয়ন থাকছে বই মেলায়। প্যাভিলিয়ন ছাড়াও বই মেলায় ৩২২টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে।”

বই মেলার বাকি আছে তিন দিন। মাসব্যাপী অমর একুশে বই মেলার জন্য এখন পুরোপুরি প্রস্তুত বাংলাবাজারের প্রকাশকরা। ছবি: শেখ মেহেদী মোর্শেদ

বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নির্বাহী সম্পাদক অনন্যা প্রকাশনীর  মনিরুল হক বলেন, “অমর একুশে বই মেলার জন্য আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত। আসলে এই প্রস্তুতি চলে বছর জুড়ে। তবে বই মেলা শুরুর এই সময়টায় আমরা প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকি।”

বাংলাবাজারের প্রকাশকদের কাছে খোঁজ নিয়ে  জানা যায়, চারশ প্রকাশক কেবল সৃজনশীল প্রকাশনারই। এছাড়া পাঠ্য বইয়েরও প্রকাশক রয়েছেন। সব মিলিয়ে এখানে দোকান আছে দুই হাজারের মতো। বইয়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী, ছাপাখানার কর্মচারী, বাঁধাইখানার কর্মচারী সব মিলিয়ে এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবিকার উৎস হচ্ছে বাংলাবাজারের প্রকাশনা শিল্প।

প্রকাশক, ছাপখানা, বাঁধাইকারি ছাড়াও বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকিয়েদেরও এখন চলছে অন্যরকম ব্যস্ততা। বিখ্যাত প্রচ্ছদ শিল্পীদের পাশাপাশি নবীন শিল্পীরাও এই সময়ে প্রচ্ছদের কাজ করছেন দিন রাত।

বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঘুরে জানা গেছে, কোনো কোনো প্রকাশক ১০০ বই প্রকাশ করবে, কোনো কোনো প্রকাশক ৫০টি বই প্রকাশ করবে আবার কোনো প্রকাশনী ৪০টি বই প্রকাশ করবে। বড় বড় প্রকাশকদের ভিড়ে ছোট প্রকাশকরাও বই মেলার জন্য নতুন বই ছাপাতে প্রস্তুত।

মুজিব জন্মশতবর্ষকে ঘিরে এবছর বাংলাবাজারে সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পাচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর লেখা বই। একজন প্রকাশক জানিয়েছেন, এ বছর দুই শতাধিকের বেশি বই প্রকাশ হবে কেবল জাতির জনকের ওপর। তার মধ্যে বেশিরভাগ বইয়ের ছাপা ও বাঁধাই শেষ হয়েছে।

৫০ এর দশকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বাংলাবাজারে বইয়ের ব্যবসা গড়ে ওঠে। তবে, সে সময়ে সৃজনশীল বইয়ের চাইতে পাঠ্য বইয়ের চাহিদা ছিলো বেশি। দেশ ভাগের আগে ভারতের কলকাতায় প্রকাশনা শিল্পের রমরমা ব্যবসা ছিলো। সেই সময়ে পূর্ব বাংলার অল্প কয়েকজন প্রকাশক সৃজনশীল বই এনে এদেশে বিক্রি করতেন।

কলকাতা থেকে বাংলাবাজারে এসে সৃজনশীল বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন মল্লিক ব্রাদার্স।

বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্প শুরু হয় নওরোজ কিতাবিস্তান, স্টুডেন্ট লাইব্রেরী, গ্রেট ইস্ট লাইব্রেরী, আল হামারা কিতাব মহল, মালিক লাইব্রেরী, খোশরোজ কিতাব মহল, হার্ডসন অ্যান্ড কোম্পানি, পুঁথিপত্রের হাত ধরে। দেশ ভাগের পরই এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকাশনা  ব্যবসা শুরু করেন। যাদের দিয়ে বাংলাবাজারে গড়ে ওঠে বইয়ের বাজার।

সেই সময়ে কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশক ছিলেন লেখকরাও। নওরোজ কিতাবিস্তান এর মালিক ছিলেন শিশু সাহিত্যিক মোহাম্মদ নাসির আলী।

একজন সিনিয়র প্রকাশক জানিয়েছেন ৬০ এবং ৭০ এর দশকে বাংলাবাজারের প্রকাশকদের বেশিরভাগ বিক্রয়কেন্দ্র ছিলো একতলা। যার বেশিরভাগই ছিলো টিনের। সেখান থেকে এগিয়ে আজ অনেকদূর প্রসারিত হয়েছে এই শিল্প। বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত বই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও যাচ্ছে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে।

আশির দশককে বলা হয়ে থাকে বাংলাবাজারের প্রকাশকদের সুবর্ণ সময়। সেই সময়ে বেশকজন প্রকাশক প্রকাশনা শিল্পের ব্যবসায় এগিয়ে আসেন। তাদের হাত ধরেই মূলত এই শিল্পের প্রসার লাভ করে। সময় প্রকাশন, অনন্যা, আগামী, বিদ্যা প্রকাশ, আফসার্স ব্রাদার্স, অনুপম, বিদ্যা প্রকাশ সহ আরও কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সেই সময়ে বেশ বড়সড় ভাবে প্রকাশনায় আসেন।

এইসব প্রকাশকরা দেশের বড় বড় সব কবি ও সাহিত্যিকদের বই প্রকাশনা শুরু করেন। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম চারটি বইয়ের প্রকাশকও তাদের মধ্যেই একজন। সেটি খান ব্রাদার্স।

সবশেষে জানা যাক বাংলাবাজার নামটির কথা। দেশের সবচেয়ে বড় বইয়ের বাজার বাংলাবাজার জায়গাটি মূলত মোগল আমলের আগেই ঢাকা শহরের একটি পুরাতন এলাকা ছিলো। ওই সময়ে এই এলাকাটি ছিলো ব্যবসা বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। আরও পরে এসে ঢাকা শহর পশ্চিম দিকে বেড়ে যায়। যার ফলে চকবাজার হয়ে উঠে ব্যবসা  বাণিজ্যের আসল ঠিকানা। কিন্তু বইয়ের জন্য বাংলাবাজার ঠিকই থেকে যায়।

সেই সময়ে কিছু কিছু পর্যটক বেংগলা নগর হিসেবে বাংলাবাজারের কথা উল্লেখ করেছেন। কারও কারও মতে, বাংলাবাজার নামটি সেখান থেকেও আসতে পারে।

অন্যদিকে, কারও কারও মতে বাংলাবাজার এলাকাটিতে শুরু থেকে বাঙালীরা বসবাস করতেন। তারা সেখানে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। যার কারণে এর নামকরণ হয়ে যায় বাংলাবাজার।

Comments

The Daily Star  | English

Tax collection falls short of IMF loan condition

government falls Tk 17,946 crore short of the revenue last fiscal year as one of IMF's $4.7 billion loan conditions

6h ago