নির্ভয়ে চলাফেরার নিশ্চয়তা চান নারী ভোটাররা
রাজধানীর কুর্মিটোলা এলাকার একটি নির্জন স্থানে গত ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক শিক্ষার্থী। এর কয়েক দিনের মধ্যেই এক সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
অভিযুক্ত ধর্ষকের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, এর আগেও ওই জায়গাতেই বেশ কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করেছেন তিনি।
এ ঘটনার পর বেশ নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। ওই স্থানে থাকা অকেজো বাতিগুলো ঠিক করা হয়। তবে শুধু কুর্মিটোলার ওই জায়গাই নয়, ঢাকায় এমন বেশ কিছু নির্জন এলাকা রয়েছে। সন্ধ্যা নামার পরই এই এলাকাগুলো অন্ধকারে ডুবে যায়। মূলত এই জায়গাগুলোতেই যৌন হয়রানি ও ছিনতাইয়ের শিকার হন নারীরা।
এসব সমস্যার কারণে রাতে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারেন না বলে জানিয়েছেন পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকার বাসিন্দা নুর জাহান খাতুন। এছাড়াও, সাম্প্রতিককালে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় তার ভয়ও বেড়েছে।
মেয়রের কাছ থেকে কী চান, জবাবে নূর জাহান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “নারীবান্ধব ঢাকা চাই। যাতে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারি।”
সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কাছ থেকে নারী ভোটাররা কী চান, এ বিষয়ে জানতে বেশকিছু নারী ভোটারের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই জন মেয়র ও ১১১ জন কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে দায়িত্বে আসবেন। নির্বাচনের কমিশনের (ইসি) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটিতে মোট ভোটার ৫৪ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬৭ জন। এদের মধ্যে নারী ভোটারের সংখ্যা ২৬ লাখ ২০ হাজার ৪৫৯। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক ভোটারই নারী।
নূর জাহানের মতো অন্য নারী ভোটাররাও নিরাপদ ও নির্ভয়ে নগরীতে চলাচলের নিশ্চয়তা চান।
নারীদের জন্য নিরাপদ ও সুরক্ষিত নগরী গড়তে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ নাকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা বেশি হওয়া উচিত, এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে।
তবে, লালমাটিয়ার বাসিন্দা রুমানা বলেছেন, “আমরা আশা করি শহরে পর্যাপ্ত বাতি লাগাতে মেয়র ও কাউন্সিলরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে। যাতে আমরা রাতেও নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারি।”
তিনি আরও বলেছেন, “লালমাটিয়ায় কিছু সড়ক রয়েছে যেগুলো রাতে অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। এ কারণে সেখানে চলতে ভয় হয়।”
সিটি করপোরেশন বিধিমালা ২০১২’তে স্পষ্টভাবে বলা আছে, জননিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার ও এটি নিশ্চিতে জনগণকে একত্রিত করা কাউন্সিলরদের দায়িত্ব।
পথচারী, বিশেষত নারীদের সুবিধায় ফুটপাত দখলমুক্ত রাখা ও রাস্তায় পর্যাপ্ত বাতি লাগানো সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব।
নারী ভোটাররা জানিয়েছেন, নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সঙ্গে সমন্বয় করতেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
২০১৭ সালে টমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, নারীদের জন্য অনুপযুক্ত শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান সপ্তমে। এছাড়া নারী সহিংসতার ক্ষেত্রে বিপদজনক শহর হিসেবে ঢাকার অবস্থান চতুর্থতে।
নারীদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হলো, তাদের জন্য নিরাপদ, সুরক্ষিত ও ঝামেলামুক্ত গণপরিবহন নিশ্চিত করা।
ব্র্যাকের এক সমীক্ষায় (২০১৭ সালের) বলা হয়, গণপরিবহনে যাতায়াতকারী নারীদের ৯৪ শতাংশই কোনো না কোনো ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হন।
যদিও শুধু নারীদের জন্য বেশকিছু বাস পরিষেবা ও রাইড শেয়ারিং সার্ভিস চালু করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কারণ নারীদের জন্য বাস রয়েছে মাত্র ১৫টি।
নিরাপত্তার পাশাপাশি আরও বেশকিছু নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কথা তুলে ধরেছেন নারী ভোটাররা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস ও পানির পরিষেবা।
যাত্রাবাড়ীতে থাকেন শাহিনা আক্তার। তিনি বলেছেন, “আমাদের এখানে নিরাপদ পানির অভাব, জলাবদ্ধতা ও মশা দৈনন্দিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তিনি বলেন, “মেয়র কিংবা কাউন্সিলরের কাছ থেকে বেশিকিছু চাই না। শুধু স্বাচ্ছন্দ্যে বাসায় থাকতে চাই। এছাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীর পণ্যের দর কমাতেও মেয়রের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।”
গোপীবাগে থাকেন চিকিৎসক রীনা রানি সরকার। তিনি বলেছেন, “সড়কের যথাযথ সংরক্ষণ ও জলাবদ্ধতার সমাধান দরকার। হালকা বৃষ্টি হলেই এখানে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। জনপ্রতিনিধিদের উচিত এটির সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।”
জিগাতলার বাসিন্দা শাহিদা ফেরদৌসি বলেছেন, “নারীদের জন্য আরও বেশি পাবলিক টয়লেট দরকার। চলাফেরার সময় আমরা কোনো পাবলিক টয়লেট পাই না। এটি শুধু অসুবিধাই নয়, স্বাস্থ্যের জন্যেও ঝুঁকি।”
শাহিদা আরও বলেছেন, “দৈনন্দিন জীবনে নারীরা একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। কিন্তু তারা মেয়র কিংবা পুরুষ কাউন্সিলদের কাছে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তারা সহজেই সমস্যাগুলো নিয়ে নারী কাউন্সিলরদের কাছে যেতে পারেন।”
“এ কারণে সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলরদের ক্ষমতায়ন জরুরি,” যোগ করেন তিনি।
ঢাকার দুই সিটিতে নারীদের জন্য ৪৩টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে। এর মধ্যে উত্তরে ১৮টি, দক্ষিণে ২৫টি।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলরদের আরও সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফাওজিয়া মোসলেম।
গত ১২ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, “সংরক্ষিত আসনের প্রত্যেক নারী কাউন্সিলরকে তিনটি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করতে হয়। যে কারণে তারা যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেন না। এছাড়া, পর্যাপ্ত সরকারি তহবিল ও উপযুক্ত কাজের পরিবেশও তারা পান না।”
অনুষ্ঠানে দুই সিটির নির্বাচিত মেয়রের প্রতি নারীবান্ধব ঢাকা গড়ার আহ্বান জানায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এসময় নারীদের জন্য গণপরিবহন সুবিধা বৃদ্ধি, ফুটপাত পরিষ্কার-পথচারীবান্ধব করা এবং কর্মজীবী নারীদের জন্য হোস্টেল সুবিধা বাড়ানোর আহ্বানও জানানো হয়।
ইশতেহারে কী বলছেন প্রার্থীরা?
ঢাকা উত্তর সিটিতে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আতিকুল ইসলাম তার নির্বাচনী ইশতেহারে আধুনিক ও নারীবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু এবং নারীবান্ধব স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
দক্ষিণ সিটিতে আওয়ামী লীগের ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস তার ইশতেহারে নারী ও শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত হোস্টেল এবং ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন ও অ্যাপ চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বিপরীতে, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে বিএনপি মনোনীত মেয়রপ্রার্থী ইশরাক হোসেন তার ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নারীদের জন্য আলাদা বাস সার্ভিস, পোশাক শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ আবাসন ও পরিবহন সুবিধা এবং নারীদের জন্য পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট সুবিধা দেওয়ার।
বিএনপি মনোনীত উত্তরের মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল তার ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, শহরের প্রত্যেক রাস্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে জনসাধারণের সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন।
Comments