ভোটকেন্দ্রে যা দেখেছি
ঢাকা ৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমের ভাগ্নে মো. হাসান পিল্লু ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনীত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ছিলেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে সেখানে জিতেছেন হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম।
গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনে দিনভর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে হাজী সেলিমের অনুসারীদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। ভোটকেন্দ্রগুলো ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। নির্ধারিত এজেন্টের বাইরেও কেন্দ্রের ভেতরে বাইরে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে বিরোধীপক্ষ দাঁড়াতেই পারেনি।
সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত এই ওয়ার্ডের স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ কেন্দ্রে উপস্থিত থেকেছি। একইসঙ্গে আশপাশের আরও পাঁচটি কেন্দ্র পরিদর্শন করে একই চিত্র দেখেছি। কোনো কেন্দ্রেই বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কোনো এজেন্ট ছিলো না। আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের এজেন্ট বেশিরভাগই কাজ করেছেন বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে। দু-একটি কেন্দ্র ছাড়া ছিলো না আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী মো. হাসানের এজেন্টও।
সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের প্রার্থী শামসুন্নাহারের সঙ্গে দেখা হয় ইউসেপ নলগোলা স্কুলে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “অনেক প্রার্থীর এজেন্টকেই বের করে দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। একটি কেন্দ্রে আমারও এজেন্টকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো। আমি অনেক অনুরোধ করে তাকে আবার বসাতে পেরেছি।”
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ কেন্দ্রে সকাল আটটা থেকে ধীরলয়ে ভোটগ্রহণ চলছিলো। ভোটারদের উপস্থিতি প্রায় ছিলো না বললেই চলে। আটটি কেন্দ্রে সকাল নয়টা পর্যন্ত ভোট পড়ে ৬১টি। প্রতি ঘণ্টায় তা বাড়ার পরিমাণ ১০টায় ১১৮টি, ১১টায় ২৫০টি, ১২টায় ৪৫১টি, ১টায় ৫৮৪টি, ২টায় ৭৩০টি, ৩টায় ৮২০টি ও সর্বশেষ ৪টায় ৮৯৫টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রতীক মিষ্টিকুমড়ায় ১১১টি ও বিদ্রোহী প্রার্থীর টিফিন ক্যারিয়ারে ৭৩০টি ভোট পড়েছে। অন্য কেন্দ্রগুলোর ভোটের ফল জানা না গেলেও টিফিন ক্যারিয়ার বিজয়ী হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
দুপুর আড়াইটার দিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. হাসান দ্য ডেইলি স্টারের কাছে অভিযোগ করেন, “হাজী সেলিমের লোকজন বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করছে, শোডাউন করছে।”
স্যার সলিমুল্লাহ কলেজ কেন্দ্রে সকাল আটটার দিকে ভোটগ্রহণ শুরু হলে উপস্থিত এজেন্টদের বাইরেও কেউ কেউ ভোটকেন্দ্রে থাকার জন্য প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে বাদানুবাদ শুরু করেন। কিন্তু শুরুতে তারা একটু রূঢ় ছিলেন। ভোটার ও এজেন্ট ছাড়া বাইরের কাউকে কেন্দ্রে থাকার অনুমতি দেননি।
কিন্তু সকাল সাড়ে আটটার দিকে হাজী সেলিম কেন্দ্রে আসার পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। তিনি ভোটকক্ষগুলো ঘুরে দেখেন। আলাদা করে কথা বলেন দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে। পরে তিনি বের হয়ে যাওয়ার পরেও তার সঙ্গে থাকা কিছু নেতাকর্মী ভোটকেন্দ্রের ভেতরে রয়ে যান। এরপর সারাদিনে হাজী সেলিমের বড় ছেলে অন্তত একবার ও ছোট ছেলে প্রার্থী ইরফান সেলিম অন্তত তিনবার লোকজন নিয়ে এসে কেন্দ্র পরিদর্শন করেন।
সোয়ারিঘাটের ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের তিন তলায় এই ওয়ার্ডের তিনটি কেন্দ্র ছিলো। সেখানে নিচতলার মাঠে সকাল থেকে নেতাকর্মীদের নিয়ে চেয়ার পেতে বসেছিলেন ইরফান সেলিম। পরে তিনটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারদের দীর্ঘ অনুরোধের পর তিনি কেন্দ্র ছাড়েন। কিন্তু সকাল ১০টার দিকে হাজী সেলিমও সেখানে আসেন।
বাবা ও ছেলেদের এই মহড়া দিনভর কেন্দ্রগুলোতে চলতে থাকে। বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে কোথাও দেখা যায়নি। বিরোধী পক্ষগুলোর অভিযোগ সম্পর্কে বিকেলে ইরফান সেলিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “সব ঠিক আছে। সব পজিটিভ।”
‘সহায়তাকারী’দের তৎপরতা
এজেন্টদের বাইরেও আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের ছবি সম্বলিত কার্ড গলায় ঝুলিয়ে কেন্দ্রে কেন্দ্রে নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন। তারা প্রতিনিয়ত এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে যাতায়াত করছিলেন, এজেন্টদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। ভোটাররা কেন্দ্রে ঢোকার পর থেকে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এজেন্টদের কাছে ‘বুঝিয়ে’ দিচ্ছিলেন। এজেন্টরাও ‘সহায়তা’ নামে কালো কাপড় ঘেরা গোপন ভোটকক্ষেও চলে যাচ্ছিলেন। এক কক্ষের এজেন্টের অন্য কক্ষে ছিলো নিত্য যাওয়া আসা।
এমনই একজন ওই এলাকার ব্যবসায়ী এম এম নেহাল। তিনি দিনভর কেন্দ্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ভোটারদের সঙ্গে নিয়ে ভোট দেওয়ানোর নামে গোপন কক্ষে ঢুকেছেন। জানতে চাইলে বলেছেন, “ওরা তো জানে না ইভিএমে কীভাবে ভোট দিতে হয়। তাই দেখিয়ে দিচ্ছিলাম।”
ভোটাররা কক্ষে প্রবেশ করতেই এজেন্টরা কাছে টেনে নিয়ে জানতে চাচ্ছিলেন, ভোটারের বাসা কোনটা বা কার বাসায় ভাড়া থাকেন বা ওই বাসার মালিকের কী হন, কোন মার্কায় ভোট দেবেন ইত্যাদি।
সকাল ১০টার দিকে একইভাবে ‘সহায়তা’ পাওয়া একজন ভোটার গ্যারেজ ব্যবসায়ী তাজুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তেমন কিছু না। এলাকার ছোটভাই তো, তাই একটু দেখিয়ে দিচ্ছিলো। আমি ভোট নৌকাতেই দিতাম।”
আটটি ভোটকক্ষে ভোটাররা যখন ইভিএমে ভোট দিচ্ছেন তখন পাশে এজেন্ট দাঁড়িয়ে আছেন, ১৩ বার তা প্রত্যক্ষ করেছি, চারটি নারী ভোটকক্ষেই এমন দৃশ্য দেখেছি ৯ বার।
এজেন্ট ছাড়াও বাইরের লোক থাকা সম্পর্কে সকালে প্রিসাইডিং অফিসার মো. আরিফুর রহমান বলেন, “আমরা তাদেরকেও পরিচয়পত্র দিয়েছি। কিন্তু সেগুলো গলায় ঝুলানোর ব্যবস্থা নেই বলে হয়তো আপনারা দেখতে পারছেন না।”
বিকেলে ফল প্রকাশের পর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, “ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু তা উল্লেখ করার মতো না।”
Comments