ধর্ষণ প্রমাণের পরীক্ষা নিপীড়নমূলক

ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর শারীরিক পরীক্ষায় ২০১৮ সালে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করেন হাইকোর্ট। এই পরীক্ষাকে অমানবিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে অযৌক্তিক বলেন আদালত।
rape_survivor.jpg
ছবি: কাজী তাহসিন আগাজ অপূর্ব

ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর শারীরিক পরীক্ষায় ২০১৮ সালে 'টু ফিঙ্গার টেস্ট' নিষিদ্ধ করেন হাইকোর্ট। এই পরীক্ষাকে অমানবিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে অযৌক্তিক বলেন আদালত।

তবে 'টু ফিঙ্গার টেস্ট' নিষিদ্ধ হলেও, ধর্ষণ পরবর্তী শারীরিক পরীক্ষা এখনো অপমানজনক এবং অসংবেদনশীল।

কামরাঙ্গীর চরের ১৩ বছর বয়সী শিশুটির কথা মনে আছে- এক বছর ধরে বাবার ঋণদাতার কাছে ধর্ষণের শিকার হয়েছে সে। ৬ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে নিজের মেয়েকে ঋণদাতার হাতে তুলে দিয়েছিলেন শিশুটির বাবা।

শিশুটির বাড়িতে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদকের তার সঙ্গে কথা হয়। শিশুটি জানায়, কোনো গোপনীয়তা ছাড়াই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার শারীরিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে।

"হাসপাতালে ঢোকার পর আমাকে দোতলার একটি ওয়ার্ডে নিয়ে যায়। সেখানে অনেক মহিলা বিছানায় শুয়েছিলেন", জানায় শিশুটি।

"জামা খুলে চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়তে বলা হয়। আমি বলেছিলাম পর্দাটা টেনে দিতে। তারা বলে, ভয়ের কিছু নেই, দু'জন পুলিশ আন্টি এখানে আছে"।

যখন প্রশ্ন করি, "ভয় পেয়েছিলে?" হঠাৎ করেই চুপ হয়ে যায় শিশুটি।

মাথা নিচু করে চুপ করে তাকিয়ে থাকে।

খারাপ লেগেছিল? মুখ নিচু করেই কেবল মাথা নেড়ে জানায়... হ্যাঁ।

তোমাকে কি তারা জানিয়েছিল কীভাবে পরীক্ষা করা হবে?

"না। তারা শুধু আমাকে চোখ বন্ধ করে থাকতে বলেছিল।"

ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি, বিশেষ করে শিশুরা তাদের মানসিক আঘাতের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। এমন অনেক শিশুর সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে 'তুমি কি ভয় পেয়েছিলে' কিংবা 'তোমার কি খারাপ লেগেছিল' এমন প্রশ্নের উত্তরে তারা নিশ্চুপ থাকে।

১৩ বছর বয়সী এই শিশু শারীরিক পরীক্ষা নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। তার মানে এই নয়, যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সে গিয়েছে তার মনের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়েনি।

ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দু'টি ধাপে পরীক্ষা করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রথমে গাইনি ওয়ার্ডে পরে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার –ওসিসিতে।

হাসপাতালের ওসিসি'র সমন্বয়ক বিলকিস বেগম যিনি এর আগে গাইনি ওয়ার্ডের প্রধান ছিলেন, বলেন, "প্রথমে তাদের গাইনি ওয়ার্ডে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দেন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে। তবে ভিকটিমের অবস্থা যদি গুরুতর থাকে তবে শুরুতেই জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়।"

sensivity_text-1.jpg

তিনি আরও বলেন, "তারা যদি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, যদি রক্তক্ষরণ হয় কিংবা অপারেশন থিয়েটারে পাঠানোর প্রয়োজন থাকে তবে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। কারণ এগুলো ওসিসিতে নেই।"

"ওসিসিতে সব রকম গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। জরুরি বিভাগে বা ওয়ার্ডে গোপনীয়তা রক্ষা করা যায় না। আমরা ওসিসিকে বলি 'বেইলি ব্রিজ'। এখানে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবে ওসিসিতে পৌঁছানোর পর আপনি নিরাপদ", বলেন বিলকিস।

তিনি বলেন, "ওসিসিকে সংবেদনশীল করার জন্য আলাদাভাবে সাজানো হয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া আর কারো প্রবেশের অনুমতি নেই। শারীরিক এবং ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য আলাদা একটি কক্ষ রয়েছে"।

যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন হাসপাতালই তাদের প্রথম নিরাপদ আশ্রয়। যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তারা গিয়েছে এরপর হাসপাতালে তাদের জন্য দরকার সংবেদনশীল পরিবেশ।

তাঁতিবাজারের আট বছর বয়সী এক শিশুর অভিজ্ঞতা থেকে গাইনি ওয়ার্ড ও ওসিসির ডাক্তারি পরীক্ষার পার্থক্য স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বারান্দায় আদালতে ঢোকার আগে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা হয় তার।

"দোতলার ওয়ার্ডে ছয় জন আমাকে দেখছিলেন। আমার মা সেখানে ছিলেন না। তারা আমাকে কাপড় খুলতে বলে। এরপর তারা একটা চিকন বোতল থেকে তিনটা কাঠি নিয়ে কিছু একটা করেছিল।"

থেমে থেমে বর্ণনা করছিল শিশুটি। এমন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা কঠিন। পুরোটা সময় একবারও সে আমার চোখের দিকে তাকায়নি। শক্ত করে এক হাতে বাবার জামা আঁকড়ে ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল।

তুমি কি ভয় পেয়েছিলে- প্রশ্নের উত্তরে মাথা নেড়ে জানায়, পেয়েছিল। বলে, "পরের দিন ডাক্তার আমাকে আবার দেখতে আসেন। এবার নিচতলার একটি ঘরে আমি ছিলাম। সেখানে মা আমার সঙ্গে ছিল।"

সেদিন কি তুমি ভয় পেয়েছিলে জানতে চাইলে শিশুটি স্পষ্ট উত্তর দেয় 'না'।

জরুরি বিভাগে ডাক্তারি পরীক্ষা ঠিক কতটা অস্বস্তিকর সেটা শিশুরা হয়তো স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে পারে না। তবে ধর্ষণের শিকার ২০ বছরের এক তরুণী কঠিন সমালোচনা করেন,

"কেউ আমার প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখায়নি। বরং যে ধর্ষণের আলামত সংগ্রহ করছিলেন তিনি আমাকে তিরস্কার করে বলেন, আমার পোশাকের কারণেই নাকি আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে"।

"যখন তিনি আমাকে এ কথা বলছিলেন, তখন আমি তার সামনে বিবস্ত্র শুয়ে আছি। আমার মনে হচ্ছিল এক দৌড়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাই। কেন আমি সেখানে গেলাম, কেন সাহায্য চাইতে গেলাম, বারবার একথা মনে হচ্ছিল।" জানান তরুণীটি।

জরুরি বিভাগ সম্পর্কে তিনি জানান, পর্দাগুলো এত ছোট যে গোপনীয়তা রক্ষা হয় না। সেখানে ওয়ার্ড বয়দের অবাধ যাতায়াত। কখন কে উঁকি দেবে, পুরোটা সময়ই সে আতঙ্ক থাকে। পরীক্ষার সময় একজন পুলিশ এবং একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক পুরোটা সময় গোপনাঙ্গের দিকে তাকিয়েছিলেন। ক্ষতস্থান থেকে আলামত সংগ্রহের সময় দুজন নারী দুই দিক থেকে শক্ত করে পা চেপে ধরেছিলেন তার।

"তাদের আচরণ খুবই রুক্ষ। আমি যদি জানতাম এমন হবে, তাহলে আমি কখনো হাসপাতালে যেতাম না", বলেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে ডা. বিলকিস জানান, জরুরি বিভাগে চিকিৎসকের তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই চিকিৎসার সময় সংবেদনশীল হওয়াটা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, "সময় হয়েছে ওসিসিতে একটি অপারেশন থিয়েটার স্থাপনের বিষয়টি বিবেচনা করার। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং বিশেষ যত্ন নিশ্চিত করা হবে"।

যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশে 'রেইপ কিট' ব্যবহার করে আলামত সংগ্রহ করা হয়। বারবার হয়রানি না করে এক জায়গায়, একবারেই সব পরীক্ষার করা হয়। ভুক্তভোগীর মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসকরা দীর্ঘ সময় নিয়ে পরীক্ষা করেন। শুরুতেই তাদের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানানো হয়। নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়। শারীরিক পরীক্ষার আগে তাদের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়। যাতে করে তাদের বার বার একই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে না যেতে হয়।

অনুবাদ করেছেন সুচিস্মিতা তিথি

 

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago