১০০ বোতল ফেনসিডিল: সীমান্তে ২৮ হাজার, ঢাকায় ৮০ হাজার!

দেশে কীভাবে ফেনসিডিলের চোরাচালান আসে, তা জানতে ভারত সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুটি গ্রামে গিয়েছিলেন দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি মোহাম্মাদ জামিল খান। যেসব সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে দেশে মাদকের চোরাচালান আসে, সেগুলোর মধ্যে এ দুই গ্রামও রয়েছে।
Phensedyl
ছবি: সংগৃহীত

দেশে কীভাবে ফেনসিডিলের চোরাচালান আসে, তা জানতে ভারত সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুটি গ্রামে গিয়েছিলেন দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি মোহাম্মাদ জামিল খান। যেসব সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে দেশে মাদকের চোরাচালান আসে, সেগুলোর মধ্যে এ দুই গ্রামও রয়েছে।

এই দুই গ্রামে গিয়ে আমাদের প্রতিনিধি কী দেখেছেন, জেনেছেন, তা তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে।

ধরুন কেউ নতুন একটি ব্যবসা শুরু করবেন। এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন পরিকল্পনা ও কিছু অর্থ। কিন্তু আজমতপুর গ্রামের চিত্র ভিন্ন। সেখানে কেউ যদি ব্যবসা শুরু করতে চায়, তাহলে শুধু এক লাখ টাকাই যথেষ্ট। স্থানীয়রা এটিকে ‘কমিশনভিত্তিক ব্যবসা’ বলে থাকেন।

এটি হচ্ছে ফেনসিডিল চোরাচালান বাণিজ্য। কাশের এই সিরাপটি ভারতের, যা ২০১৬ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। একসময় যখন দেশে ইয়াবা আসা শুরু হয়নি, তখন ফেনসিডিলই ছিল মাদকাসক্তদের পছন্দের শীর্ষে।

আজমতপুর গ্রামের স্থানীয় দুইজনের সহযোগিতায় সেখানকার এক মাদক চোরাকারবারির সঙ্গে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের। তার বয়স ৩০। তিনি জানান, ১২ বাকশো ফেনসিডিলের দাম ৮৪ হাজার টাকা। প্রতি বাকশে ফেনসিডিল থাকে ২৫ বোতল। এক বাকশের দাম সাত হাজার টাকা।

“তবে, সীমান্ত থেকে গ্রামে যে এগুলো বহন করে আনবে, প্রতি ১০০ বোতলের জন্য তাকে দিতে হয় তিন হাজার টাকা। কেউ যদি ১২ বাকশের (৩০০ বোতল) একটি চালান এনে দেয়, তাহলে তিনি পান নয় হাজার টাকা।”

“এ জন্যেই স্থানীয়রা এটিকে ‘কমিশনভিত্তিক ব্যবসা’ বলে থাকেন,” যোগ করেন তিনি।

মাদকের এ চোরাচালান মূলত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শশানি, মহতপুর ও ঘোষতলা গ্রাম থেকে আসে।

সাধারণত কৃষক, দিনমজুর কিংবা রাখালেরা এসব মাদকদ্রব্যের বাহক হিসেবে কাজ করে থাকেন। তিনজনের একটি দল সীমান্তের পয়েন্টে যান এবং একটি চালান সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। প্রতি চালানে অন্তত ৩০০ বোতল ফেনসিডিল থাকে।

মাদক চোরাচালানের যে চক্র, সেটির সঙ্গে আজমতপুর ও এর পার্শ্ববর্তী গ্রাম তেলকুপির কয়েক ডজন বাসিন্দা জড়িত।

এসব চোরাচালানের বাহকরা যেভাবে কাজ করেন!

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছেই আজমতপুর গ্রাম। সেখানে অপরিচিত কাউকে দেখলেই সন্দেহ করেন স্থানীয়রা। তারা ভাবেন, অপরিচিতজন হয়তো পুলিশের সোর্স।

গ্রামের একজন জানিয়েছেন, অপরিচিত কাউকেই দেখলেই গ্রামের লোকজন হয়তো ঘিরে ধরে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করে।

স্থানীয় এক পত্রিকার প্রতিনিধির সহায়তায় আজমতপুরের দুইজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের সঙ্গেই মাইক্রোবাসে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে আজমপুরের উদ্দেশে রওনা দেই।

দিনটি ছিল ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রওনা দিয়ে দুই ঘণ্টায় ৩৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আজমতপুরের একটি ছোট বাজারে পৌঁছাই। বাজারটি একটি নদীর তীরে। স্থানীয়দের কাছে নদীটি ‘পাগলা’ নামে পরিচিত। নদীর অপর পাশে ভারত।

সেখানে পৌঁছানোর পরেই একদল গ্রামবাসী আমাদের পিছু নেয়। পরে, সঙ্গে থাকা স্থানীয় দুইজনের আশ্বাস পেয়ে চলে যায় ওই দল।

মাদকের চোরাচালানের বাহক হিসেবে কাজ করেন স্থানীয় এক কৃষক। ওই দুই স্থানীয়র সহযোগিতায় তার সঙ্গে কথা হয়।

ওই কৃষক জানান, সারাবছরই তিনি ফেনসিডিল আনার কাজ করেন।

তিনি বলেন, “ভারত থেকে কখন এসব চোরাচালান সরবরাহ করা হবে, সেই ব্যাপারে এখানকার চোরাকারবারিরা আমাদের বিস্তারিত জানিয়ে দেয়। ভারতীয় চোরাকারবারিরা মূলত সীমান্তের বেড়া দিয়ে বাকশোগুলো ছুড়ে ফেলে।”

“আমরা একবারে ৩০০ বোতলের কম কোনো চালান আনিনা। সাধারণত তিনজনের একটি দল হয়ে আমরা যাই। তবে যদি বড় চালান হয়, অর্থাৎ তিন হাজার কিংবা পাঁচ হাজার বোতল, তাহলে বেশি লোক নিয়োগ দেওয়া হয়,” বলেন ওই কৃষক।

এ কাজের পারিশ্রমিকের ব্যাপারে তিনি বলেন, “প্রতি ১০০ বোতলের চালানের জন্য আমরা তিন হাজার টাকা নেই। তিনজনের দলে যে নেতৃত্বে থাকে, সে পায় ১,৪০০ টাকা। বাকি দুইজন ৮০০ টাকা করে পায়।”

এগুলো কত টাকায় বিক্রি করা হয়, এমন প্রশ্নে তিনি জানান, ফেনসিডিল সীমান্ত এলাকা থেকে প্রতি কিলোমিটার দূরত্বে নিয়ে গেলেই দাম এক হাজার টাকা করে বাড়তে থাকে। যেমন, সীমান্তবর্তী আজমতপুরে ১০০ বোতল ফেনসিডিলের দাম ২৮ হাজার টাকা। সেখান থেকে ১১ কিলোমিটার দূরের শিবগঞ্জ গ্রামে ওই ১০০ বোতলই বিক্রি হয় ৩৮ হাজার টাকায়। একইভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে বিক্রি হয় ৪৮ হাজার টাকায়।

এ সূত্র আরও জানায়, এই ১০০ বোতল ফেনসিডিলের দামই ঢাকায় এসে হয়ে যায় প্রায় দ্বিগুণ। রাজধানীতে ১০০ বোতল ফেনসিডিলের দাম ৭০-৮০ হাজার টাকা।

মাদক চোরাচালানের বিষয়টি জানে পুলিশও

এই দুই গ্রামে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা সংগ্রহ করে দ্য ডেইলি স্টার। শিবগঞ্জ থানার তৈরি করা এই তালিকায় প্রায় ২৭ চোরাকারবারির নাম পাওয়া যায়।

ওই তালিকায় আরও ২৭ জনের নাম পাওয়া যায়। যাদের ‘আদায়কারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ওই আদায়কারীরা পুলিশের পক্ষে ‘টোল আদায়কারী’ হিসেবে কাজ করে থাকেন।

সূত্র জানায়, টোল আদায়কারীরা প্রতি মাসে মাদক চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে ১০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকে।

তবে, এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামসুল আলম। তিনি বলেন, “দুই মাস আগে আমি এই থানায় এসেছি। এই তালিকার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।”

গত ১৬ জানুয়ারি ওসি শামসুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছি। মাদক চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত কাউকে পেলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

Comments

The Daily Star  | English
Pro-Awami League journalist couple arrested

The indiscriminate arrests and murder charges

Reckless and unsubstantiated use of murder charges will only make a farce of the law, not bring justice to those who deserve it.

8h ago