দ্য ডেইলি স্টার

২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মধ্যমণি দুই কৃষক

একজন মানুষের একার প্রচেষ্টাতেই কোনো কাজ করে ফেলা সম্ভব, তা হয়তো অনেকেই ভাবেন না। কেউ কোনো ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিলে কিংবা একাই কিছু করতে চাইলে সমাজে তাকে ভিন্ন চোখে দেখা হয়। আসে নানা বাধা, প্রতিবন্ধকতা।

তবে, মোহাম্মাদ সোইনউদ্দিন মিয়া ও আব্দুর রশিদ, এই দুই কৃষকের গল্প ভিন্ন।

টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার চকগদাধর গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ সোইনউদ্দিন মিয়া (৪৫)।  বাজারে যাওয়ার কোনো রাস্তা এ গ্রামের বাসিন্দাদের নেই। কাদামাটি পেরিয়ে যেতে হয় তাদের।

দীর্ঘ বছর ধরে চলা এই বিড়ম্বনা মেনে নিতে পারেননি সোইনউদ্দিন। সরকার রাস্তা তৈরি করে দেবে, এ আশায় বসে থাকেননি তিনি। কোদাল হাতে নিয়ে নিজেই নেমে পড়েন রাস্তা তৈরির কাজে।

মোহাম্মাদ সোইনউদ্দিন মিয়া ও আব্দুর রশিদ, এই দুই কৃষকের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দিচ্ছেন মিডিয়া ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের চেয়ারপারসন রোকিয়া আফজাল রহমান এবং চ্যানেল আইয়ের পরিচালক, বার্তাপ্রধান ও উন্নয়ন সাংবাদিক শাইখ সিরাজ। ছবি: স্টার

চার বছরে শ্রমে-ঘামে-অর্থে দরিদ্র কৃষক সোইনউদ্দিন নির্মাণ করেছেন দেড় কিলোমিটার মাটির রাস্তা। রাস্তাটি পাঁচ ফুট প্রশস্ত এবং উচ্চতা তিন ফুট।

লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ দলগ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ। তার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য। তার গ্রামের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বাবা-মায়েরা কীভাবে নিজেদের সন্তানকে সমাজ ও সাধারণ জীবন থেকে আলাদা করে রাখেন, সেটি তিনি দেখেছেন। ওইসব শিশুরা বাইরের জগতের কিছুই দেখতে পায়না, জানতে পারে না। আব্দুর রশিদের গ্রামের এসব শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় আলাদা কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

তাই নিজের ৩৫ শতাংশ জমির ২০ শতাংশের উপর গড়ে তোলেন ‘কালীগঞ্জ প্রতিবন্ধী স্কুল’। শুরুর দিকে অল্প কয়েকজন শিশু থাকলেও এখন স্কুলটিতে পড়াশোনা করছে দুই শতাধিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী। স্কুলটি চালাতে যে খরচ প্রয়োজন, তাও আব্দুর রশিদ নিজেই জোগাড় করছেন।

স্কুলটিতে অন্ধ শিক্ষার্থীদের ব্রেইল এবং কানে শোনে না, এমন শিক্ষার্থীদের ইশারা ভাষা শেখানো হচ্ছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পোর্ট্রেট উন্মোচন করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এসময় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান রেহমান সোবহানও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। ছবি: স্টার

সোইনউদ্দিন ও রশিদ যা করেছেন, তা অবশ্যই কোনো ছোট কীর্তি নয়। এ কাজের সরলতার মধ্যেই অসাধারণত্ব বিদ্যমান। তাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আমরাও নিজেদের প্রশ্ন করতে পারি যে, আমরা এবং আমাদের চারপাশের সবাই যদি একইরকম কাজ করি, তাহলে কেমন হবে?

গতকাল বুধবার রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার নবরাত্রি হলে ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করে দেশের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার। সেসময় বড় স্বপ্ন দেখা ও তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় এই দুই সাহসী কৃষককে সম্মাননা দেওয়া হয়।

এর আগে, এই দুই কৃষককে নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল।

সম্মাননা পেয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সোইনউদ্দিন ও রশিদ।

জাতীয় সংগীত পরিবেশনকালীন দাঁড়িয়ে সম্মান জানাচ্ছেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিরা। ছবি: স্টার

অনুষ্ঠানে আব্দুর রশিদ বলেন, “আমার একটা ভাগনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। তাকে লালন-পালনের সময় আমি এ ধরনের শিশুদের কী প্রয়োজন সেটি উপলব্ধি করি।”

“আমার জমির তিন ভাগের দুই ভাগ আমি স্কুলের জন্য দিয়ে দিয়েছি। আমার ফসল বিক্রি করে স্কুলের শিক্ষার্থীদের খাওয়াই। আমি যখন শিক্ষার্থী ছিলাম, শিক্ষকদের অর্থ পরিশোধের সামর্থ্য আমার ছিল না। এখন আমি আমার স্কুলের শিক্ষার্থীদের খাওয়া, বই ও স্টেশনারির জন্য মাসে ১৮-২০ হাজার টাকা ব্যয় করি। আমি ফসল বিক্রি করে এ অর্থ জোগাড় করি। অবশ্য, আমার প্রতিবেশীরাও মাঝেমধ্যে আমাকে সহায়তা করেন।

আব্দুর রশিদের বক্তব্যের সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনামও। রশিদের বক্তব্য শেষে উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশে মাহফুজ আনাম বলেন, যদি এই মানুষটি আমাদের অনুপ্রাণিত না করে, তাহলে কে করবে?

দ্য ডেইলি স্টারের ‘বাংলা ও ইংরেজি’ ভাষার নতুন ওয়েবসাইট উন্মোচন করেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ছবি: স্টার

সম্মাননা পাওয়ার পর সোইনউদ্দিন বলেন, “আমার গ্রামে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে,রাস্তা না থাকায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া অসম্ভব ছিল। এ কারণে আমি তাদের কষ্ট কমানোর সিদ্ধান্ত নেই এবং নিজেই রাস্তা তৈরির কাজ শুরু করি।”

এই দুই কৃষকের গল্প হৃদয় ছুঁয়েছে উপস্থিত শ্রোতা, দ্য ডেইলি স্টারের পাঠক, পৃষ্ঠপোষক, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের।

অনুষ্ঠানে এই দুই সাহসী কৃষকের হাতে এক লাখ টাকার করে চেক তুলে দেওয়া হয়। তাদের হাতে সম্মাননা স্মারক ও চেক তুলে দেন মিডিয়া ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের চেয়ারপারসন রোকিয়া আফজাল রহমান এবং চ্যানেল আইয়ের পরিচালক, বার্তাপ্রধান ও উন্নয়ন সাংবাদিক শাইখ সিরাজ।

অনুষ্ঠানে দেশের নাগরিক সমাজ, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, কূটনীতিক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক এবং দেশ-বিদেশের উন্নয়নকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানটি শুরু হয় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে। এরপর মাতৃভাষার গুরুত্ব নিয়ে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।

চলচ্চিত্রের প্রদর্শন শেষে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের একটি পোর্ট্রেট উন্মোচন করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এছাড়া, দ্য ডেইলি স্টারের ‘বাংলা ও ইংরেজি’ ভাষার নতুন ওয়েবসাইটও উন্মোচন করেন তিনি। নতুন ওয়েবসাইটে ইংরেজি ও বাংলা, দুই ভাষাতেই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। মূলত আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছাতে নতুন এই উদ্যোগ নিয়েছে ডেইলি স্টার।

ডেইলি স্টারের সঙ্গে থাকার জন্য পাঠকদের ধন্যবাদ জানিয়ে রোকিয়া আফজাল রহমান বলেন, “গত ২৯ বছর ধরে পত্রিকাটি সর্বোচ্চ নৈতিক সাংবাদিকতার চর্চা করছে।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণের স্বার্থই আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যাই করেছি, যাই করতে চাচ্ছি, সবক্ষেত্রেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

তিনি আরও বলেন, “একটি বিশ্বাস আমরা আমাদের মনে ধারণ করি। তা হলো, কথা বলা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানব মনের বিবর্তনের মূলে অন্তর্নিহিত। এটি ছাড়া বিজ্ঞানের কোনো আবিষ্কার কিংবা সৃজনশীল লেখা, কোনোটিই সম্ভব হতো না।”

মাহফুজ আনাম তার বক্তব্যে স্বাধীন গণমাধ্যমের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

দেশাত্মবোধক গান। ছবি: স্টার

তিনি বলেন, “দেশের জনগণের অনুভূতি সরকারকে জানাতেই সাংবাদিকতার জন্ম। সংবাদমাধ্যম ক্ষমতসীনদের সঙ্গে সাধারণ জনগণের যোগাযোগের মাধ্যম।”

“সরকার যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তা যথাযথভাবে কাজ না করলে সেটি তাদের কে বলবে? শুধু স্বাধীন সাংবাদিকতাই তা তুলে ধরতে পারে।”

“মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন বাংলাদেশ দেখছে, সেটির সঙ্গে মুক্ত সাংবাদিকতাও জড়িত,” যোগ করেন মাহফুজ আনাম।

 

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নবরাত্রি হলের বাইরে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। আলোকচিত্র দেখছেন অতিথিরা। ছবি: স্টার

অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্টজনেরা

দ্য ডেইলি স্টারের ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শাহ হুসাইন ইমাম, বিডিনিউজ২৪.কমের সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান এবং বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক ইনাম আহমেদ।

এছাড়াও ছিলেন, বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ, তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত, সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও রওনক জাহান, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি দাশ, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সি আর আবরার, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজিল মোর্শেদ ও মোতাহের হোসেন সাজু, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুয়ার এবং অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago