প্যারোলে মুক্তি ‘দোষ স্বীকার’ ও বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গ

কিছুদিন পরপর প্রায় নিয়ম করে খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রসঙ্গটি সামনে আসে। সেই আলোচনায় এখনকার প্রসঙ্গ ‘প্যারোল’। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের মুখ থেকে ‘প্যারোল’ শব্দটি বেশি শোনা যাচ্ছে।
ছবি: স্টার

কিছুদিন পরপর প্রায় নিয়ম করে খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রসঙ্গটি সামনে আসে। সেই আলোচনায় এখনকার প্রসঙ্গ ‘প্যারোল। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের মুখ থেকে ‘প্যারোল’ শব্দটি বেশি শোনা যাচ্ছে।

বিএনপির নেতা-আইনজীবীরা বলছেন ‘প্যারোলে’ মুক্তি নয়, খালেদা জিয়াকে জামিন দিতে হবে। তাদের বক্তব্য, যেহেতু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলো রাজনৈতিক, ফলে সরকারের সদিচ্ছায় চিকিৎসাজনিত কারণে জামিন হতে পারে। জামিন পেলে তিনি উন্নততর চিকিৎসার জন্যে ইংল্যান্ডে যাবেন।

বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাচ্ছেন না। খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারাগারে দেখা করছেন তার আত্মীয়-স্বজন। বিএনপি মহাসচিব খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও মনোভাব সম্পর্কে জানছেন, দেখা করে আসা আত্মীয়দের থেকে।

খালেদা জিয়ার মুক্তিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি প্রসঙ্গে সামনে আসছে। আইনগতভাবে খালেদা জিয়া জামিন পেতে পারেন কিনা বা জামিন পাওয়ার সুযোগ আছে কিনা? ‘প্যারোল’র আওতায় মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা? ‘প্যারোলে’ মুক্তি পেলে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার সুযোগ আছে কিনা?

প্রথমে আসি ‘প্যারোল’ প্রসঙ্গে।

‘প্যারোল’ বিষয়ে সংসদ প্রণীত কোনো আইন নেই। প্যারোল সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়। ২০১৬ সালের ১ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা নীতিমালা অনুযায়ী প্যারোলে ‘শর্তাধীনে সাময়িক সময়’র জন্যে মুক্তির সুযোগ আছে। গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যান্য শ্রেণির হাজতি বন্দিদের কাছের কেউ মারা গেলে সাধারণত প্যারোলে মুক্তি পেয়ে থাকেন।

‘সাময়িক সময়’ ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না, নীতিমালায় বলা হয়েছে। তবে বিশেষ বিবেচনায় সরকার সময় কমাতে বা বাড়াতে পারে। কতদিন, মাস বা বছর বাড়াতে পারে তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই।

‘সাময়িক সময়’ কমবেশি যাই হোক পুরো সময় তাকে পুলিশি প্রহরা বা নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী, প্যারোলে মুক্ত বন্দিকে পুলিশ কারাগারের ফটক থেকে বুঝে নিবে এবং নির্দেশিত সময়সীমার মধ্যে আবার কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আরিফ খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “প্যারোলে মুক্ত কোনো বন্দি বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী চিকিৎসা বা অন্য কোনো বিবেচনায় বিদেশে যেতে পারবেন না। এছাড়া প্যারোলে মুক্তির সঙ্গে বন্দির দোষ স্বীকার করা বা না করার কোনো সম্পর্ক নেই।”

“প্যারোলে মুক্তি পাওয়া বন্দির বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আছে”-দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক এবং বর্তমান মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, “বিদেশে গিয়ে সেই বন্দিকে সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসকে বিষয়টি জানাতে হবে। তিনি কোথায় থাকছেন, কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সবকিছু দূতাবাসকে জানিয়ে রাখতে হবে।”

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহাসচিব আবদুল জলিল প্যারোলে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্যে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন।

প্যারোলে মুক্তির পর বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই, আবদুল জলিলকে কীভাবে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো? তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি।

২০০৮ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আট সপ্তাহের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন।

এবার আসি জামিন প্রসঙ্গে।

বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা চলমান এবং দুটি মামলায় তিনি দণ্ড পেয়েছেন। দণ্ডপ্রাপ্ত দুটি মামলা অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাৎ মামলার পুরো কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এই দুটি মামলার সম্পূর্ণ কার্যক্রম শেষ হয়ে যাওয়ায় জামিনের কোনো সুযোগ নেই। কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যাওয়া মামলায় আদালত জামিন দিতে পারেন না। খালেদা জিয়া জামিন পেতে পারেন চলমান মামলাগুলোতে। চলমান সবকয়টি মামলায় যদি খালেদা জিয়া জামিন পান, তবুও তার কারামুক্তির সুযোগ নেই।

‘প্যারোলে’ মুক্তির বাইরে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ আছে। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দোষ স্বীকার করে নিয়েই ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন অগ্রাহ্য করতে পারেন। বিবেচনায় নিয়ে সম্পূর্ণ দণ্ড মাফ করে দিতে পারেন। দণ্ডের মেয়াদ কমিয়ে দিতে পারেন। নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে দণ্ড স্থগিত রেখে মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারেন।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন খালেদা জিয়া কী চাইছেন? কয়েক মাস আগে বিএনপির সংসদ সদস্যরা কারাগারে দেখা করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। বিএনপির একজন সংসদ সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি প্যারোল বা মুক্তির প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ‘কোনো লাভ নেই’-বলে খালেদা জিয়া তাকে আলোচনা করতে না করে দিয়েছিলেন।

তার মতে, তখনই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না।

কয়েক দিন আগে খালেদা জিয়ার বোনসহ আত্মীয়রা দেখা করেছেন। বিএনপির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আত্মীয়রা দেখা করে এসে বলেছেন খালেদা জিয়ার অবস্থা খারাপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তার দুই হাত বাঁকা হয়ে গেছে। খেতে পারছেন না। জামিন বা প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে এই প্রথম তিনি বলেছেন ‘যা ভালো মনে করো’ করতে পারো। ধারণা করছি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বলেই হয়তো তিনি একথা বলেছেন। তবে বেগম খালেদা জিয়া কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন না। কারণ তিনি কোনো অপরাধ করেননি।

একটি সূত্র অনুযায়ী, বিএনপি দলীয়ভাবে প্যারোলে মুক্তি চাইবে না। পরিবার সরকারের থেকে নিশ্চয়তা পেলে প্যারোলে মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। তখন বিএনপি বলবে, আত্মীয়রা মানবিক কারণে প্যারোল চেয়েছে। রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

বিএনপি নেতাদের প্রায় সবাই এখন মনে করছেন, অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে খালেদা জিয়ার সুস্থ থাকা বা বেঁচে থাকা জরুরি। প্যারোলে মুক্তি চাইলে বা পেলে খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন’ ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও তারা মনে করছেন না। সরকার এমন প্রচারণা চালালেও, বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকারের কথা দেশের মানুষ বিশ্বাস করবেন না। মানবিক বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি পেলে বিএনপির রাজনীতির জন্যে তা মঙ্গলজনক হবে। কিন্তু তাদের ভেতরে একটি সংশয় বা সন্দেহ তীব্রভাবে বিরাজ করছে, সরকারপ্রধান কী ভাবছেন তা তারা জানেন না। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলে মির্জা ফখরুলের সংশয় বা সন্দেহ কাটেনি। আদালত নয়, খালেদা জিয়ার মুক্তি নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। এবং সেই সিদ্ধান্ত মূলত সরকারপ্রধানের।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

9h ago