শীর্ষ খবর
চুড়িহাট্টা ট্র্যাডেজির এক বছর

আগুন নিভেছে, বিপদ কাটেনি

চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনের ঝলসে যাওয়া দেয়ালগুলো কালো হয়ে আছে। এর চারপাশে এখনো পোড়া গন্ধ। গত বছর রাসায়নিক দ্রব্যে আগুন লেগে এখানে ৭১ জন নিহত হয়েছিলেন।

চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনের ঝলসে যাওয়া দেয়ালগুলো কালো হয়ে আছে। এর চারপাশে এখনো পোড়া গন্ধ। গত বছর রাসায়নিক দ্রব্যে আগুন লেগে এখানে ৭১ জন নিহত হয়েছিলেন।

নারকীয় ঘটনাটির পর ওই এলাকায় রাসায়নিকের গুদাম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে গুদামগুলো নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে সরকার। এক বছর পেরিয়ে গেলেও রাসায়নিকের গুদাম সেখান থেকে সরেনি। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই আগের মতোই চলছে কারখানাগুলো। ফলে এখানকার কয়েক হাজার মানুষ রয়ে গেছেন আগুনের ঝুঁকিতে।

সরকার আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম এবং কারখানা স্থানান্তরের কাজ করছে। প্রায় ১০ বছর আগে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সরকারের এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।

নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির দেওয়া সুপারিশের একটি ছিল, রাসায়নিক কারখানা এবং গুদাম সরিয়ে নেওয়া। তবে, ভূমি অধিগ্রহণ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা এখনো শেষ হয়নি।

এমনকি, অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে অস্থায়ী কেমিকেল হাব তৈরির কাজও শেষ হয়নি।

চকবাজারের বাসিন্দা আবদুল বারিক বলেন, “অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর অনেক মানুষের হাহাকার ও কান্না শুনেছি। ভ্রাম্যমাণ আদালত রাসায়নিক গুদামগুলো বন্ধ করেছে। কিন্তু, চকবাজার ট্রাজেডি থেকে মানুষের দৃষ্টি সরার পরপরই অনেকেই আবার ব্যবসা শুরু করেছেন।”

তিনি আরও বলেন, “এটা সত্য যে, আপনি চুড়িহাট্টার রাস্তার পাশে কোনো রাসায়নিকের দোকান পাবেন না। ওই ঘটনার পর অনেক ব্যবসায়ী দোকান সরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু, এখনো আশপাশে গোপনে অনেকেই রাসায়নিক মজুত করে রেখেছেন।”

“আমরা সবসময় ভয়ে থাকি। কারণ, রাসায়নিকের গুদামগুলো থেকে আবারও চকবাজারের মতো ঘটনা ঘটতে পারে।”

পুরান ঢাকার রাসায়নিকের গুদাম এবং কারখানার সঠিক সংখ্যা বের করা কঠিন। তবে, বাংলাদেশ ক্যামিকাল ও পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের দাবি, এই সমিতিতে ১ হাজার ৫০০ এর বেশি সদস্য রয়েছে।

তারা জানান, পুরান ঢাকার আবাসিক ভবনে থাকা কমপক্ষে সাত থেকে আট হাজার দোকান তাদের সমিতির অনুমোদনের বাইরে। এসব গুদামে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পারক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কিটোন, থিনার, আইসোপ্রোপাইলের মতো বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। এর সবগুলোই আগুনের সংস্পর্শে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।

এছাড়াও পুরান ঢাকার কয়েকটি এলাকায় প্রচুর রাবার, প্লাস্টিক ও স্যান্ডেল তৈরির কারখানা চালু রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ অনুযায়ী, কোনো আবাসিক এলাকার আশপাশে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার হয় এমন কাখনা থাকতে পারবে না। এছাড়াও, কারখানার মালিকদের এসব উপকরণ ব্যবহারের আগে অবশ্যই পরিবেশ ছাড়পত্র নিতে হবে।

কিন্তু নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী আবাসিক এলাকায় বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ মজুত করছেন।

সম্প্রতি চকবাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার প্লাস্টিক কারখানায় তেমন পরিবর্তন আসেনি।

বাংলাদেশ প্লাস্টিক ব্যাবসায়ী সমিতির যুগ্ম-দপ্তর সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, “আমাদের কেবল প্লাস্টিকের কাঁচামালের দোকান এবং গুদাম রয়েছে। এগুলো দাহ্য নয়।”

কিন্তু, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার সময় এ ধরনের পদার্থ আগুন ছড়াতে সহায়তা করতে পারে।

মেহেদীর ভাষ্য, “আমরা কয়েক প্রজন্ম এখানে ব্যবসা করছি। তহলে আমরা কেন চলে যাব?”

সরেজমিনে দেখা যায়, পুরান ঢাকার মিটফোর্ড, আরমানিটোলা, ইসলামবাগ, বংশাল, সিদ্দিক বাজার ও বাবু বাজার এলাকায়ও রাসায়নিকের গুদাম আছে।

ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে একটি রাসায়নিকের গুদাম আছে। ওখানে পাঁচ থেকে ছয়টি ঘরে রঙ তৈরির কাঁচামাল মজুত রাখা হয়েছে।

ভবনটির দারোয়ান জানান, গুদামের মালিক এলাকায় থাকেন না। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

ওই এলাকার মাংস বিক্রেতা চান মিয়া বলেন, “আমরা শুনেছি রাসায়নিকের গুদামগুলো অন্য জায়গায় সরানো হয়েছে। এর পরও আবাসিক ভবনের ভেতরে কিছু গুদাম রয়েছে।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, “দমকল বাহিনী মাঝে মাঝে এখানে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু, ব্যবসায়ী ও বাড়ির মালিকদের কাছে নিরাপত্তার চেয়ে মুনাফা গুরুত্ব পাচ্ছে। এজন্য সরকারের উদ্যোগ খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি।”

তিনি অভিযোগ করেন, ওই অগ্নিকাণ্ডের আগে রাসায়নিক পদার্থ দিনের বেলা পরিবহন করা হতো। এখন হচ্ছে রাতে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, অনেক আগে থেকেই এই ব্যবসা চলে আসছে। তাই এটি রাতারাতি সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।

তিনি জানান, “কিছু গুদাম ডেমরা এবং নারায়ণগঞ্জে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যদিও তা পরিকল্পনামাফিক হয়নি। এসব গুদাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং এগুলোর ওপার আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।”

তিনি আরও বলেন, সরকারের নির্ধারিত হাব এখনো তৈরি না হওয়ায় সেখানে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি।

সরকার দীর্ঘদিন ধরে একটি স্থায়ী কেমিকেল হাব তৈরির কথা বলে আসছে। তার অভিযোগ, এটা শুধু কথার কথা হয়েই আছে।

“সরকার যা করুক, আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। কারণ, আমরা জানি কীভাবে এসব রাসায়নিক সংরক্ষণ করতে হবে,” যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, “চকবাজারের ঘটনার পর আমরা লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। পুরান ঢাকার সব রাসায়নিক গুদাম এখনো সরিয়ে নেওয়া হয়নি। এখনো অনেকেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।”

শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুল হালিম জানান, চলতি বছরের জুন এবং ডিসেম্বরের মধ্যে এসব রাসায়নিকের গুদাম অস্থায়ীভাবে শ্যামপুর ও টঙ্গীতে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তারা আশাবাদী।

তিনি বলেন, “স্থানান্তরের কাজ পুরোদমে চলছে।”

স্থায়ী সমাধানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জুনের মধ্যেই জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হবে। “আগামী দুই বছরের মধ্যে আমরা পুরো রাসায়নিক শিল্প স্থানান্তর করতে পারব।”

হতাশা প্রকাশ করে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “আমরা যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ বিবেচনা করি তাহলে দেখতে পাব, কিছু ক্ষেত্রে সচেতনতা কার্যক্রম ছাড়া সেখানে বাস্তবিক অর্থে কোনো পরিবর্তন হয়নি।”

তিনি আরও বলেন, “ছোট আকারে হলেও নিয়মিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। তার মানে আরও একটা বড় ট্র্যাজেডি ঘটতে পারে।”

Comments

The Daily Star  | English
Islami Bank's former managing director Abdul Mannan

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago