১ লাখ রোহিঙ্গা ভাসানচরে নেওয়ার পরিকল্পনা থেকে সরে আসছে সরকার?

আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর আপত্তির কারণে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাটি সরকার পুনরায় বিবেচনা করছে।
গত বুধবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “আমরা স্থানান্তর পরিকল্পনা স্থগিত করার চিন্তাভাবনা করছি। কারণ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই পরিকল্পনায় সম্মতি দেয়নি।”
তিনি বলেন, এই সংস্থাগুলোর সহযোগিতা না থাকলে ভাসানচরে এক লাখ মানুষের জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংস্থান করতে সরকার অসুবিধার মুখে পড়তে পারে।
জাতিসংঘ এবং সহযোগী সংস্থাগুলো বলছে, এই দ্বীপটি বিচ্ছিন্ন এবং বন্যার ঝুঁকিপ্রবণ। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের আশঙ্কার কারণে দ্বীপটি রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য বিপজ্জনক হবে।
কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে রয়েছেন প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের মধ্য থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য এরই মধ্যে ৪০ বর্গকিলোমিটার দ্বীপটিতে ১২০টি গুচ্ছ গ্রাম তৈরি করেছে সরকার। দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে এই আবাসন প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় এই প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত রোববার বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা হলে তারা ভবিষ্যতে জায়গাটি ছাড়তে নাও রাজি হতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমরা চাই রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে যাক। আমরা তাদের ফিরিয়ে দিতে চাই। এটাই অগ্রাধিকার।”
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে নৃশংস সামরিক অভিযানের পর দেশটি ছেড়ে আসা প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ কক্সবাজারে আশ্রয় নিলে এই আবাসন প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের খরচ বহন করা হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। রাখাইনে এর আগে সহিংসতার সময় পালিয়ে বাংলাদেশে আসা তিন লাখ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এই নতুন সাড়ে সাত লাখ মানুষ যোগ দেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন ও পাহাড় ধ্বংস এবং কক্সবাজার ভূমিধসের ঝুঁকি এড়াতে কর্তৃপক্ষ ভাসানচরে অস্থায়ী আবাসন তৈরি করেছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বাস্তবায়িত প্রকল্পটিতে ১২০টি গুচ্ছ গ্রাম রয়েছে। যেখানে এক লাখ রোহিঙ্গার থাকার ব্যবস্থা হতে পারে।
প্রকল্পে বানানো ঘরগুলো মাটির চার ফুট ওপরে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। পুরো প্রকল্পটি ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা সুরক্ষা বাঁধের ভেতরে। এ ছাড়াও এখানে আছে ১২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র। যা স্কুল, মেডিকেল সেন্টার এবং কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, সেখানে স্থানান্তরিত করা হলে পশুপালন ও মাছ চাষের জন্য রোহিঙ্গারা অনেক জায়গা পেতেন। কক্সবাজার আশ্রয় শিবিরে খুবই সামান্য কাজের সুযোগ আছে শরণার্থীদের জন্য ।
জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা প্রথম থেকেই স্থানান্তর পরিকল্পনার বিরোধিতা করে আসছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচও বলেছে দ্বীপটি মানুষের বসবাসের জন্য মোটেই টেকসই নয় এবং সমুদ্রের পানির স্তর বাড়লে ও ঝড় হলে তা মারাত্মকভাবে এখানকার বাসিন্দাদের ক্ষতি করতে পারে।
গত বছরের অক্টোবরে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মাহবুব আলম তালুকদার বলেছিলেন, ছয় থেকে সাত হাজার শরণার্থী ভাসান চরে যাওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
জাতিসংঘের সংস্থাগুলো দ্বীপে একটি প্রযুক্তিগত মিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা বলেছেন, তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পানির সরবরাহ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ প্রাথমিক সেবার প্রতুলতা এবং মূল ভূখণ্ড থেকে ভাসানচরে যাতায়াত ও চরের ভেতরের যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন।
সরকার জাতিসংঘের এই প্রযুক্তিগত মিশনের জন্য কিছু শর্ত আরোপ করার পর তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং কর্মকর্তারা এখন বলছেন, তারা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর না করার বিষয়টি বিবেচনা করছেন এবং বিকল্প পরিকল্পনার কথা ভাবছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যন্ত এই দ্বীপে স্থানান্তরের পরিকল্পনাটি স্থগিত করার জন্য সংশ্লিস্ট মন্ত্রণালয়গুলো একমত হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে।
“রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ অনেক প্রশংসা পেয়েছে। রোহিঙ্গা এবং সাহায্য সংস্থাগুলোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে স্থানান্তর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে দুর্নাম কুড়ানো উচিত হবে না,” তিনি বলেন।
এই পরিকল্পনা থেকে সরে আসলে আবাসন প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ কী হবে তা জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা এখনও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তিনি অবশ্য মনে করেন, দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে গৃহহীন মানুষের আশ্রয় হতে পারে এই দ্বীপ। দ্বীপটি মানুষের বসবাসের জন্য নিরাপদ।
চট্টগ্রামের আরেকটি দ্বীপ সন্দ্বীপ থেকে ভাসানচরের দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। “দ্রুত পলি জমা হওয়ায় সন্দ্বীপ এবং ভাসানচর অদূর ভবিষ্যতে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। শেষ পর্যন্ত এটা আমাদের জন্য একটি বড় এলাকায় পরিণত হবে। সেখানে আমরা অনেক কিছুই করতে পারি,” যোগ করেন মন্ত্রী।
Comments