বাংলাদেশের সামাজিক জীবনধারায় নারীর অবদান

PRANESH CHAKMA
মহিলারা যদি তাদের পারিবারিক তথা সাংসারিক জীবনে এ ধরনের জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে তাঁরা উন্নয়নকাজও করতে পারবে সমান দক্ষতায়। ছবি: দ্য ডেইলি স্টার-স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ‘জীবনের জয়গান উৎসব’/ প্রাণেশ চাকমা

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক’র প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা। পরিবার-সমাজ-দেশের উন্নয়নে নারী যে  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা তিনি নারীদের দেখেই জেনেছিলেন- শিখেছিলেন। শেখা-জানার পুরোটা প্রয়োগ করেই গড়ে তুলেছিলেন ব্র্যাক। লেখার এই অংশটি গোলাম মোর্তোজা’র ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক বই থেকে নেওয়া। ফজলে হাসান আবেদ চলে গেছেন ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর, জন্মেছিলেন ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল।

১৯৭৫ সালে রৌমারিতে ব্র্যাকের অফিস খোলা হল। শাল্লার পর ব্র্যাকের দ্বিতীয় প্রজেক্ট হল রৌমারিতে। শাল্লা থেকে আরও দু-একজন গিয়ে যোগ দিল। স্থানীয় অনেক লোককে নিয়োগ দেওয়া হল।

শুরু হল ক্ষুধার্ত মানুষ, বিশেষ করে শিশুদের বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম।

আমরা একটা কর্মসূচি চালু করলাম। পনের বছর বয়স পর্যন্ত যত ছেলেমেয়ে ছিল, তাদের সবাইকে এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত করে নেওয়া হল। পঁয়ত্রিশ হাজার ছেলেমেয়ে সকালে এবং রাতে দুবেলা খাবার পেতে থাকল। প্রথমে আমরা খাদ্যটাই নিশ্চিত করলাম। যাতে অনাহারে কেউ মারা না যায়। আমাদের কর্মসূচি চালু করবার আগে অনাহারে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আর কেউ যাতে মারা না যায় তা-ই হল আমাদের কাজের প্রধান লক্ষ্য। অপুষ্টির শিকার হয়ে যারা মৃত্যুরমুখে এসে দাঁড়িয়েছে, তাদের জন্য অনেকগুলো পুষ্টিকেন্দ্র গড়ে তুললাম। ঐ কেন্দ্রগুলোতে অপুষ্ট, মুমূর্ষু শিশুদের ভর্তি করে তাদেরকে সুস্থ করে তোলার ব্যবস্থা হল। প্রথমে ছয়মাস আমরা তাদের খাদ্যের জোগান দিয়ে গেলাম। এর ফলে ঐ এলাকায় অনাহারে শিশুমৃত্যু বন্ধ হয়ে গেল।

রৌমারিতে কাজ করতে গিয়ে অনেক কিছু শিখলাম। দেখলাম, দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে এলাকার সব পুরুষ রৌমারি ছেড়ে চলে গেছে। স্ত্রীকে বলে গেছে, বাইরে গিয়ে কাজ করে টাকা পাঠাবে। কিন্তু তারা তা করতে পারে নি। অন্যত্র গিয়ে তারা জীবিকার সন্ধান করেছে।

ইচ্ছা বা অনিচ্ছা যে কারণেই হোক পুরুষেরা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আর মহিলারা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। মুমূর্ষু শিশুকে কোলে করে মা কোথাও চলে যেতে পারছে না।

আমার চিন্তায় একটা নতুন বাস্তবতা ধরা পড়ল। আমি দেখলাম, বাংলাদেশের সামাজিক জীবনধারায় মহিলাদের অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের যে কোনো বিপর্যয়ে মহিলারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করে বিপদ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। নিজে না খেয়ে বাচ্চাকে খাওয়ায়। কিন্তু একজন পুরুষ এই কাজটা করে না। আমরা দেখতাম, যে মহিলারা বাচ্চাদের নিয়ে পুষ্টিকেন্দ্রে এসেছে, তারা নিজেরাই অপুষ্টির শিকার। তাদেরকে দেখতাম বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। বাচ্চার খাবার থেকে কোনো মহিলা নিজে একটু খেয়েছে এমন দৃশ্য কোনোদিন দেখি নি। পুরো ব্যাপারটি আমার মধ্যে এক আলোড়ন এনে দেয়। আমি ভাবতে থাকি, কোনো একটি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের এই মহিলাদের যদি সহযোগিতা করা যায়, তাহলে তারা অনেক কিছু করতে পারবে। তারাই পারবে বাংলাদেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে। সে যোগ্যতা তাদের আছে। তবে তাদের সুযোগ করে দিতে হবে।

বস্তুত মহিলারা যে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাঁরা যে অনেক কিছু করতে পারে, আমাদের সমাজ কোনোদিন এটা ভাবে নি।

আমি এ কাজটা করতে চাইলাম।

এরকম ভাবনার পেছনে আরও কিছু বিষয় আমার মধ্যে কাজ করছিল। চার-পাঁচ বছরের একটা মেয়েশিশু তার ছোটবোন বা ভাইকে দেখাশোনা করে, কিন্তু একটা ছেলেশিশু এটা করে না। আসলে ছোটবেলা থেকেই মেয়েরা তুলনামূলকভাবে অনেক দায়িত্বশীল। মেয়েশিশুরা রান্নার কাজে মাকে সহযোগিতা করে, গরুছাগল দেখাশোনা করে। ছয়-সাত বছর বয়স হলে লাকড়ি কুড়োতে যায়। ক্ষেত থেকে শাক তুলে আনে।

দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলে চোদ্দ-পনের বছর বয়সে সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়েও হবে আরেক দরিদ্র পরিবারে। অল্পদিনের মধ্যেই সে দু-তিনটি সন্তানের মা হবে। স্বামীর রোজগারে সংসার চলবে না। পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে বা কাজ করে তাকেই বাচ্চাদের খাবার জোগাড় করতে হবে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে তাদেরও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।

এটাই হল আমাদের সামাজিক চিত্র, কঠোর জীবনবাস্তবতা।

আমি দেখেছি নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারেও অভাবঅনটন মোকাবেলা করে  মহিলারা। এ ধরনের পারিবারিক দায়িত্ব মহিলারা যুগের পর যুগ পালন করে আসছে। আমি গভীরভাবে একটা বিষয় ভেবেছি, মহিলারা যদি তাদের পারিবারিক তথা সাংসারিক জীবনে এ ধরনের জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে তাঁরা উন্নয়নকাজও করতে পারবে সমান দক্ষতায়। এজন্যই ব্র্যাকের সব কর্মক্ষেত্রে আমরা মহিলাদের অগ্রাধিকার দিয়েছি।

Comments

The Daily Star  | English

Former Narayanganj mayor Selina Hayat Ivy arrested

She was arrested around 5:45am today following a night-long raid at her Deobhog residence

1h ago