দিল্লি জ্বলল, সবাই তাকিয়ে দেখল

ক্যামেরা ও নোটবুক হাতে মানুষগুলোর সামনে বিলাপ করছেন মা। আর আতঙ্কিত চোখে তা দেখছে শিশুরা। গর্বিত শ্রমজীবী মানুষ বাধ্য হচ্ছে অপরিচিতদের দানের ওপর নির্ভর করে বাঁচতে। কারণ, রাষ্ট্র তাদের জন্য নিরাপদ জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে না। ভয়াবহতার এখানেই শেষ না। বাবা হাসপাতালের মর্গে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার নিখোঁজ সন্তানকে। মা ভয়ে আছেন তার সন্তানের লাশ নর্দমা থেকে বের হয় কিনা।
রয়টার্স ফাইল ফটো

ক্যামেরা ও নোটবুক হাতে মানুষগুলোর সামনে বিলাপ করছেন মা। আর আতঙ্কিত চোখে তা দেখছে শিশুরা। গর্বিত শ্রমজীবী মানুষ বাধ্য হচ্ছে অপরিচিতদের দানের ওপর নির্ভর করে বাঁচতে। কারণ, রাষ্ট্র তাদের জন্য নিরাপদ জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে না। ভয়াবহতার এখানেই শেষ না। বাবা হাসপাতালের মর্গে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার নিখোঁজ সন্তানকে। মা ভয়ে আছেন তার সন্তানের লাশ নর্দমা থেকে বের হয় কিনা।

সরকারের প্রতি নাগরিকের এমন ভয়ঙ্কর রকমের আস্থাহীনতা আমি কখনও দেখিনি। গুলিবিদ্ধ শরীর কিংবা আঘাতে ভেঙে যাওয়া হাড় নিয়ে আক্রান্ত মুসলমানরা সরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন না। তাদের মতে সেখানে গিয়ে অবমাননা আর অবহেলার শিকার হওয়ার চেয়ে তারা বরং মারা যাবেন। ভুক্তভোগীরা মৃত্যু ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির তথ্য নেওয়া কর্মকর্তাদের ফরম পূরণে সাহায্য করছেন না। তাদের সন্দেহ এই কর্মকর্তারা গোপনে জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধনের ফরম পূরণ করছেন।

রাজনৈতিক ব্যর্থতা

হতভাগ্য এই মানুষদের সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের সবার আগে আছে রাজনৈতিক দলগুলো। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতাদের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য কয়েক সপ্তাহ ধরে অন্যায়ভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘৃণা জাগিয়ে তুলেছে। তাদের রাজনৈতিক দর্শন সুস্পষ্ট। একটি কারণ ছিল নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধাচারণ প্রতিরোধ করা। আরও একটি কারণ ছিল সারাদেশে ধর্মীয় ঐক্য ও সংহতি প্রদর্শন। এমন সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড ঘটার অপেক্ষাতেই ছিল। রাজনৈতিক শ্রেণির বাকি অংশ এই সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিতে পারত। কিন্তু, তারা কিছু করেনি। তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাহস ও সংঘাত মোকাবেলার মতো জনশক্তি ছিল না। জম্মু-কাশ্মীরের বাইরে ভারতের যে কোনো রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে বৃহত্তম পুলিশ বাহিনী আছে দিল্লির। তারা ইচ্ছা করলে এই সহিংসতা রোধ করতে পারত বা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা থামিয়ে দিতে পারত। স্পষ্ট ও ভীতিকর সত্য হলো এই সাম্প্রদায়িক গণহত্যার ঘটনাটি দিল্লিতে ঘটে গেল, কারণ আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তা চেয়েছিল এবং পুলিশ তা হতে দিয়েছে। রাজ্য যদি না চায় তাহলে কোনো দাঙ্গা কয়েক ঘণ্টার বেশি চলতে পারে না।

পুলিশের জবাব

এই ঘটনায় পুলিশের অনেকগুলো রূপ আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। মানুষকে জবাই করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন বিপদে পড়া মানুষ উদ্ধারের আশায় থানায় ফোন দিয়েছে। অথচ কয়েক হাজার ফোন কলের উত্তর দেওয়া হয়নি। আহতদের নিয়ে হাসপাতালের দিকে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সগুলোর নিরাপত্তাও পুলিশ দেয়নি। এমন ঘটনা শত্রু রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ হওয়ার সময়ও ঘটে না। মাঝরাতে দিল্লি হাইকোর্ট আহতরা যেন নিরাপদে জরুরি চিকিৎসা নিতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়। তারপরও পুলিশ সদস্যরা গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের পথে থাকা একজন রোগীকে চারটি চেকপোস্টে চার বার ব্যান্ডেজ খুলতে বাধ্য করে এটা নিশ্চিত হতে যে সে আহত।

যখন একটি ধর্মীয় পরিচয়ের মানুষদের বাড়িঘর ও দোকান ভাংচুর করা হচ্ছিল তখন পুলিশ সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেছে। কিছু ক্ষেত্রে তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ ভাংচুরে যোগও দিয়েছে। পুলিশ সদস্যরা একদল নিরস্ত্র মুসলমানকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নির্যাতন করে, তাদের জাতীয় সংগীত গাইতে বাধ্য করে। জাতীয় সংগীত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। তাই স্পষ্টতই পুলিশ তাদের শাস্তি দিচ্ছিল বিক্ষোভ করার জন্য। নির্যাতনের শিকার এই মানুষগুলোর মধ্যে একজন যখন মারা যায় তখন থেকে জাতীয় সংগীত আমার কাছে শুধু দেশ প্রেমের গান না, বেদনার গানও হয়ে উঠেছে।

অ্যাম্বুলেন্সগুলো যাতে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে এবং বিদ্বেষ ছড়ানো বক্তব্যের জন্য বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিক এফআইআর নিবন্ধনের আদেশ দেন দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস মুরালিধার (পরবর্তীতে তাকে বদলি করে দেওয়া হয়)। মধ্যরাতে তার দেওয়া নির্দেশনা দেখিয়ে দিলো একটি ন্যায়বান সাংবিধানিক আদালত এমন সময়ে কী ধরনের ভূমিকা নিতে পারে। আমাদের নাগরিকদের একটি দল ২৪ ঘণ্টা সাড়া দেওয়ার জন্য একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে কলের সংখ্যা বাড়তে থাকে আর পুলিশ অন্যায়ভাবে সেগুলোর উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকে। একটি ছোট বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা গুরুতরভাবে আহত ২২ জনকে জরুরিভিত্তিতে বড় হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু, উচ্ছৃঙ্খল জনতা এর অনুমতি দেয় না এবং পুলিশও নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করে। তাদের মধ্যে দুজন মারা যান।

বিচারপতি এস মুরালিধার পরের দিন যারা বিদ্বেষ ছড়িয়েছিল তাদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশকে ২৪ ঘণ্টার সময় দেন। কিন্তু, তার বদলি হওয়ার পর এই জরুরি আদেশ বাষ্প হয়ে উড়ে যায়।

হাসপাতালগুলোর তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া সমানভাবে উদ্বেগের প্রশ্ন তোলে।

দৃশ্যপটে নেই

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, সংখ্যালঘুদের জাতীয় কমিশন ও শিশু অধিকার সংরক্ষণের জাতীয় কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের কাছে প্রায় স্মৃতিচারণের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। রাষ্ট্র নির্বাহীদের হাতে সংখ্যালঘু ও দুর্বলরা যখন বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হন তখন এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু, দিল্লি যখন জ্বলল, যন্ত্রণায় কাঁতরালো, তখন তারা কেউই দৃশ্যপটে নেই।

এমনও কিছু কাজ যা রাজ্য প্রশাসনের করা উচিৎ ছিল। সহিংসতা শুরুর প্রথম রাত থেকেই উদ্ধারকারী কন্ট্রোল রুম স্থাপন ও সেগুলো পরিচালনা করা, পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে একসঙ্গে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, নিরাপদ জায়গায় দ্রুত ত্রাণ শিবির করা এর মধ্যে অন্যতম।

ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের রাতে কয়েক ঘণ্টা প্রিয়জন, ঘর, ব্যবসা, জিনিসপত্র ও সঞ্চয় লুটের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সেই রাতটি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে যখন জানবেন আপনাকে রক্ষা করার জন্য যারা দায়বদ্ধ তারাই এমনটা করছে? কেমন হবে সেই রাত যখন জানবেন, সেই উচ্ছৃঙ্খল জনতার মধ্যে আপনার প্রতিবেশীদের কেউ আছে যারা লুটপাট করছে?

দিল্লির শ্রমিকদের আবাসস্থলের সরু গলিতে তিন দিন ধরে যে সহিংসতা হলো তা ভারতের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য অবমাননাকর এবং ব্যাপকভাবে পতনের ইঙ্গিত দেয়। জরুরিভাবে যদি এসব দেখা না হয় ও সংশোধন না করা হয়, তাহলে তা সাংবিধানিক রাষ্ট্রের সব প্রত্যাশা, শান্তি, সামাজিক আস্থা, উন্নয়ন ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেবে। সেই সঙ্গে কোনো একদিন আমাদের দয়ালু ও ন্যায়বিচারের দেশ হওয়ার সম্ভাবনাও ধ্বংস করবে।

 

হর্ষ মন্দার একজন মানবাধিকার কর্মী ও লেখক

Comments