‘যদি মেরেও ফেলি, আমাদের কিছু হবে না’
গত মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতের দিল্লির সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমস। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সহিংসতা ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি দিল্লি পুলিশ। উল্টো মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন ও হামলায় সহায়তা করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি ভিডিও প্রকাশ করে, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সহিংসতায় অংশ নিয়েছে পুলিশও।
প্রতিবেদনে বলা হয় রঙমিস্ত্রি কাউসার আলি, সহিংসতার সময় বাড়ি ফিরছিলেন। যে রাস্তা পার হয়ে কাউসারের নিজের বাচ্চার কাছে ফেরার কথা সেটি বন্ধ করে পরস্পরের দিকে পাথর ছুড়ছিল হিন্দু-মুসলিম। নিরুপায় কাউসার পুলিশের সাহায্য চাইলেন। আর সেটাই ছিল এক বিরাট ভুল।
পুলিশ সদস্যরা তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় এবং মাথায় আঘাত করতে থাকে। তিনিসহ অন্য মুসলিমদের ওপরেও চড়াও হয় পুলিশ। চলতে থাকে বেধড়ক পিটুনি।
সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরা মানুষগুলো প্রাণভিক্ষা চাইছিলেন। তাদের একজন শরীরের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে দুদিন পরে মারা যান। পুলিশ কর্মকর্তারা এ সময় হাসছিলেন, লাঠি দিয়ে পেটাতে পেটাতে আহতদের বাধ্য করেন ভারতের জাতীয় সংগীত গাইতে। ঘটনাটি গত ২৪ ফেব্রুয়ারির, যা এক ভিডিওতেও ধরা পড়েছে।
‘পুলিশ আমাদের নিয়ে যেন খেলছিল। তারা আমাদের বলে, তোমাদের যদি মেরেও ফেলি, আমাদের কিছুই হবে না,’ বলেন কাউসার।
গত কয়েক বছরের মধ্যে ভারত সবচেয়ে বাজে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখল। অনেকেই বলছেন, এটি অনিবার্য ছিল। কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের সময়ে হিন্দু চরমপন্থার যে বিকাশ ঘটেছে তারই ফল দিল্লির ঘটনা। তার দল হিন্দু জাতীয়তাবাদের মৌলবাদি রূপ হাজির করেছে। আর এই দলের নেতারা প্রকাশ্যেই মুসলিমবিরোধী বক্তব্য দেন। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মুসলমান-বিরোধী বেশ কয়েকটি নীতি নেয়া হয়েছে। যার একটি হলো- ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য- জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক বিশেষ মর্যাদা বাতিল।
দিল্লি সহিংসতার সময় এমন অনেক প্রমাণ সামনে আসছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে-- মোদি সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লি পুলিশ, কীভাবে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে সচেতনভাবে কাজ করেছে। একই সঙ্গে তারা মুসলমানদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে ও মুসলিম পরিবারের ওপর হামলা চালাতে হিন্দু উগ্রবাদীদের সাহায্য করেছে।
· বেশ কয়েকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ সদস্যরা মুসলিম বিক্ষোভকারীদের মারধর ও তাদের লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ছে। হামলায় অংশ নিতে তারা হাত নেড়ে উগ্র হিন্দুদের ইশারাও করছে।
· একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, যেসব জায়গায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে সেখানকার পুলিশ সদস্যদের থানায় অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক জানান, সহিংসতার সময় অনেক পুলিশ সদস্য বন্দুক না থাকায় বিপদজনক পরিস্থিতিতে পরেছিলেন। সহিংসতা ঠেকাতে পুলিশের হাতে ছিল শুধু লাঠি। কয়েকজন পর্যবেক্ষক জানিয়েছেন, পরিকল্পনামতো অপর্যাপ্ত আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে অল্প সংখ্যক পুলিশ সদস্যকে সে সময় মাঠে নামানো হয়েছিল।
· দিল্লি সহিংসতায় নিহত ৫০ জনের দুই তৃতীয়াংশই মুসলিম। মানবাধিকার কর্মীরা একে সংগঠিত হত্যা বলে অভিহিত করেছেন।
· ভারতের জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ এবং নয়াদিল্লির ১৩ শতাংশ যদিও মুসলিম, দিল্লি পুলিশ বাহিনীতে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব ২ শতাংশেরও কম।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের পুলিশ সংস্কৃতি দীর্ঘকাল ধরেই নির্মম, পক্ষপাতদুষ্ট, সংখ্যালঘুবিরোধী এবং চরিত্রগতভাবে প্রায় ঔপনিবেশিক।
তবে এখন আরো একটি বিষয় যুক্ত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ভারতীয় জনতা পার্টি এবং মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার—আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির রাজনীতিকরণ করছেন।
মোদির দল শাসিত রাজ্যে পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয় পছন্দ অনুযায়ী। তাদের লক্ষ্য নির্দিষ্ট। কর্ণাটকের এক মুসলিম স্কুল অধ্যক্ষকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় কারাভোগ করতে হয়। তার দায়, স্কুলের শিক্ষার্থীরা মোদির সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের ওপর একটি নাটকে অভিনয় করেছিল। পুলিশের অভিযোগ সেখানে মোদির সমালোচনা করা হয়েছে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদ আঘাত হেনেছে বিচারবিভাগেও। দিল্লির এক বিচারক মোদির দলের কয়েকজন সদস্যদের বিরুদ্ধে দিল্লি সহিংসতায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে, তদন্তের নির্দেশ দিলে তাকে অন্য রাজ্যে বদলি করে দেওয়া হয়।
আবার একই সময়ে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের অনুকূলেও রায় দিয়েছে। বিচারপতি অরুণ মিশ্র প্রকাশ্যে নরেন্দ্র মোদিকে ‘দূরদর্শী বিজ্ঞ’ বলে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন।
আর এ সবই হিন্দু উগ্রবাদীদের সহিংসতায় ঘি ঢেলেছে।
জনবহুল ও বহু ধর্মের সমাবেশ যেখানে সেই উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সহিংসতার আগুন নিভেছে। তবে কিছু হিন্দু রাজনীতিবিদ মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ জড়িয়ে তথাকথিত শান্তি মিছিল করেছেন। যার প্রধান উদ্দেশ্য, সহিংসতার ভুক্তভোগি হিসেবে নিজেদেরকেই উপস্থাপন করা। যা আরও বেশি মুসলিম বিদ্বেষ তৈরি করছে।
মুসলিম নেতারা এই সহিংসতাকে দেখছেন, তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র-অনুমোদিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে।
মুসলিম অধিকার কর্মী উমর খালেদ বলেন, ‘সরকার চায় মুসলিম সম্প্রদায় তাদের কাছে হাঁটু গেড়ে জীবন ও জীবিকার জন্য ভিক্ষা চাইবে।’
সহিংসতা নিয়ে কয়েকটি টুইটে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানানো ছাড়া খুব কম কথা বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দিল্লির পুলিশ কর্মকর্তারা মুসলিমবিরোধী পক্ষপাতিত্ব অস্বীকার করে বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। অথচ ওই এলাকার মুসলমান ও হিন্দু প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, পুলিশের এই দাবি সত্য নয়।
পুলিশের একজন মুখপাত্র এম এস রান্ধাওয়ার লিখিত জবাবে জানান, ধর্মের ভিত্তিতে বা কারো প্রতি পক্ষপাত না করে পুলিশ কাজ করেছে।
তিনি বলেন, কাউসার ও অন্য মুসলমানেরা—বিক্ষোভকারীদের পিটুনিতে আহত হন এবং পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। অথচ ভিডিওগুলোতে পরিষ্কার দেখা গেছে, পুলিশ সদস্যরাই তাদের নির্মমভাবে পেটাচ্ছে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, সহিংসতায় এক পুলিশ কর্মকর্তা মারা গেছেন এবং ৮০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
তাদের দাবি, ভিডিওতে বিপুলসংখ্যক মুসলিম বিক্ষোভকারীকে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, নয়াদিল্লির এই সহিংসতা একটি নির্দিষ্ট ছকে হয়েছে। সংখ্যালঘুদের হত্যায় কয়েকদিন ধরে এই সহিংসতা চলতে দেয়া হয়েছে।
একাধিক অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধে সর্বোচ্চ সংখ্যক আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা দরকার ছিল। যার কোনোটিই দিল্লিতে দেখা যায়নি।
সাবেক কমিশনার অজয় রাজ শর্মা এই অবস্থাকে ‘ব্যাখ্যাতীত’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘এটি ক্ষমার অযোগ্য।’
নিউইয়র্ক টাইমসের একজন প্রতিবেদক সেদিন যখন পুলিশ সদস্যদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন, উগ্র জনতা তাকে ঘিরে ফেলে এবং তার নোটবুক হাত থেকে নিয়ে ছিড়ে ফেলে। প্রতিবেদক পুলিশের সাহায্য চাইলে তাদের একজন বলেন, ‘আমি পারব না, এই যুবকেরা ভীষণ সহিংস।’
দিল্লির পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, যিনি বিজেপি প্রধানও, পুলিশের এমন ব্যর্থতার জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। দিল্লি পুলিশ কর্মকর্তারা সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনা পাননি বলে জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বারবার নির্দেশ চাওয়া হলেও তারা কোনো জবাব দেয়নি।
ভারতের সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ সিদ্দিকী বলেছেন, ‘ভারতীয় পুলিশ চূড়ান্তভাবে ঔপনিবেশিক এবং বর্ণবাদী। পুলিশের আচরণ সবসময় দুর্বলের ওপর আরও সহিংস এবং আক্রমণাত্মক।‘
Comments