মূল্যস্ফীতি-খেলাপি ও নয়-ছয় সুদনীতি

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে নয়-ছয় সুদনীতি প্রণয়নের পেছনে সরকারের ভাবনাটি আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হয়। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের বর্তমান ঋণের হার অত্যন্ত চড়া। বর্তমান কালের ১১% থেকে ১৫% হারের ঋণ নিয়ে ব্যবসায় মুনাফা করা দুরূহ। ফলে ব্যবসায়ীরা এখন ঋণ নিতে আগ্রহী নন।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে নয়-ছয় সুদনীতি প্রণয়নের পেছনে সরকারের ভাবনাটি আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হয়। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের বর্তমান ঋণের হার অত্যন্ত চড়া। বর্তমান কালের ১১% থেকে ১৫% হারের ঋণ নিয়ে  ব্যবসায় মুনাফা করা দুরূহ। ফলে ব্যবসায়ীরা এখন ঋণ নিতে আগ্রহী নন।

দেখা গেছে, ২০২০ সালের মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ দশমিক ২ শতাংশ লক্ষ্য মাত্রার পরিবর্তে মাত্র ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। তাই সরকার মনে করে, ঋণ প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হলে সুদের হার কমানোর কোনো বিকল্প নেই।

তুলনা হিসেবে নীতিনির্ধারকেরা বিভিন্ন সময় ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেন। প্রকৃতই আমরা দেখতে পাই, ইউরোপে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার ১ শতাংশের নিচে এবং ঋণের সুদের হার ২ শতাংশের নিচে যা আমরা ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে নেওয়া ইউরোপিয়ান ব্যাংকের গৃহস্থালি ও ব্যবসায়ীক ঋণের সুদ হারের চিত্র থেকে দেখতে পাচ্ছি।

সূত্র: ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক

এই অবস্থায় সরকার আমানত ও ঋণের সুদের সর্বোচ্চ সীমা নয় শতাংশ এবং ছয় শতাংশে নির্ধারণ করে দিয়েছে যা ঋণ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে বলে সরকার প্রত্যাশা করে।

আপাতদৃষ্টিতে সরকারের সিদ্ধান্তটি খুবই যৌক্তিক এবং তথ্যভিত্তিক বলে মনে হয়। কিন্তু, আমরা একটু খতিয়ে দেখবো সরকারের যুক্তিটি যৌক্তিক শোনালেও বাস্তবসম্মত ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করবে কিনা।

সরকারের নেওয়া ঋণের সুদের হার কত

শুধুমাত্র ব্যবসায়ীরা নয়, সরকার নিজেও ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। পরিমাণ হিসাব করলে, ব্যাংকিং সিস্টেমের বৃহত্তম গ্রাহক সরকার। চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত নিলাম অনুসারে ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে সরকারের খরচ মেটাতে নেওয়া বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের জন্যে নেওয়া ঋণগুলোর সুদের হার ছিল ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ।

সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক

বিশ্বের অন্যান্য দেশে সরকার কত হারে ঋণ নেয়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের খরচ মেটাতে নেওয়া ১ বছর থেকে ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের ঋণ প্রদানের সময় সুদ দিচ্ছে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে। এটি জাপানে দশমিক ০২১ শতাংশ থেকে দশমিক ৩৪ শতাংশ, জার্মানিতে দশমিক -৭৩% থেকে -দশমিক ০২% (ভুল হচ্ছে না। বেশকিছু দেশের বন্ডের সুদের হার ঋণাত্মক হয়ে পরেছে)

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, আমানত ও ঋণ সুদের হার কমানোর জন্যে যে দেশগুলোর উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে, সরকার সেই দেশগুলোর মতো কেনো ১ শতাংশ বা ২ শতাংশ হারে সুদ প্রদান করে বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নিচ্ছে না? কেনো বাংলাদেশ  সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই ৯ শতাংশের উপরের হারে সুদ প্রদান করছে?

এছাড়া, সরকারকে দেওয়া এই ঋণগুলোর জন্যে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকে সঞ্চিতি রাখতে হয় না। ফলে এই ঋণের তহবিল ব্যয় সাধারণ গ্রাহককে দেওয়া তহবিল ব্যয় থেকে অনেক কম। সরকার যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে টাকা ছাপাতে পারে তাই এই ঋণগুলো সবচেয়ে ঝুঁকি-মুক্ত ঋণ যার খেলাপি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

ব্যাংকিং সিস্টেমে ঝুঁকিরও মূল্য আছে। যে গ্রাহককে ঋণ দিতে ঝুঁকি বেশি নিতে হয়, সে গ্রাহকের জন্য  ঋণের সুদের হার বেশি হবে— এইটিই সাধারণ দিব্যজ্ঞান থেকে আসা নিয়ম যার উপরে পুরো বিশ্বের ব্যাংকিং সিস্টেম দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়, সরকারকে দেওয়া ঋণ সবচেয়ে ঝুঁকিমুক্ত কারণ দেউলিয়া হয়ে গেলেও টাকা ছাপিয়ে এই ঋণের টাকা সরকার ফেরত দিতে পারে। এবং ঝুঁকিমুক্ত ঋণ হওয়ার কারণে, সরকারের ঋণের সুদের হার সাধারণ গ্রাহককে দেওয়া ঋণের হার থেকে কম হবে।

অথচ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার নিজে ৯ দশমিক ১ শতাংশ হারে ঝুঁকিহীন সঞ্চিতির ঋণ নিচ্ছে, অন্যদিকে আইন করে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করছে ব্যবসায়ীদেরকে ৯ শতাংশ হারে ঋণ দিতে যেখানে ব্যবসায়ীদেরকে দেওয়া ঋণের ঝুঁকি ও তহবিল ব্যয় অনেক বেশি।

তাই এই আইনটি মোটেও যৌক্তিক নয়। বড় রকম অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বাজার অর্থনীতিতে চাল ডাল অথবা ডাক্তারি সেবার মতো টাকাও এক ধরনের পণ্য

পার্থক্য হচ্ছে টাকা এক ধরনের বিনিময় পণ্য যার মাধ্যমে অন্য পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় করা যায়। বিনিময় পণ্য হলেও অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অন্যান্য পণ্য এবং সেবার সঙ্গে টাকার তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বিভিন্ন পণ্য যেমন ক্রয়-বিক্রয় করা যায় বা ভাড়া খাটানো যায় ঠিক তেমনি, টাকাকেও ক্রয়-বিক্রয় করা যায় বা ভাড়া খাটানো যায়। ব্যাংকগুলো মূলত টাকা ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা করে যাকে আমরা ভাড়া খাটানোও বলতে পারি।

ব্যাংকগুলোকে টাকা বেচে বা ভাড়া খাটায় মূলত গ্রাহকেরা।

গ্রাহকেরা কোন ব্যাংককে কী মূল্যে অর্থ বেচবে (বা ভাড়া খাটাবে) তা মূলত নির্ভর করে উক্ত গ্রাহকের টাইম প্রেফারেন্স অফ মানি বা অর্থ ও সময়ের তুলনামূলক অগ্রাধিকারের উপর।

এই অগ্রাধিকার বেশকিছু শর্তের উপরে নির্ভর করে। যার মধ্যে আছে ঝুঁকি, অন্যান্য বিনিয়োগের সুযোগ ও একজন গ্রাহকের নিজের ভোগের চাহিদা। গ্রাহকের সময় ও অর্থের এই তুলনামূলক অগ্রাধিকারের সিদ্ধান্তের প্রধান একটি নিয়ামক হচ্ছে বাজারের তৎকালীন ও প্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতি।

টাইম প্রেফারেন্স অফ মানি ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আমানতের সুদের হারের সম্পর্ক

মূলত, টাইম প্রেফারেন্সের অন্যান্য শর্ত পূর্ণ করে একজন গ্রাহক যখন একটি ব্যাংকে টাকা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তার প্রধান ভাবনা থাকে মূল্যস্ফীতির হার। একজন আমানতকারী হিসাব করে যে টাকা তিনি ব্যাংকে রাখবেন নির্ধারিত সময়ে  মূল্যস্ফীতির কারণে তার মানের যে পতন হবে উক্ত ব্যাংক তাকে সেই হারের চেয়ে বেশি হারে সুদ দেবে কিনা।

যদি  আমানতের সুদের হার সরকার কৃত্রিমভাবে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হারে নির্ধারণ করে তবে গ্রাহক বা অর্থের এই বিক্রেতার বিনিয়োগ ক্ষতির মুখে পড়বে। আবার সুদের হার যদি মূল্যস্ফীতি থেকে বেশি হয় তবে একজন গ্রাহক মুনাফা অর্জন করতে পারবেন। যা তাকে পুনরায় ব্যাংকে আরও আমানত রাখতে উৎসাহিত করবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, গত জানুয়ারি মাসে, পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। যদিও বেসরকারি গবেষণায় সরকার ঘোষিত এই হার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গত ৮ জানুয়ারি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাব জানিয়েছে, ২০১৯ সালে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ।

এরপর, ১ মার্চ থেকে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানো হয়েছে ফলে এই মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। একই সঙ্গে সাম্প্রতিককালে অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যানের মনিটারিজম তত্ত্ব অনুসারে একটি মুদ্রাস্ফীতি তাড়িত মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কারণ, বাজেট ঘাটতি মেটাতে টাকার খোঁজে দিশেহারা সরকার ছয়মাসের মধ্যেই তার পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি ঋণ নিয়েছে।

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপিয়ে তার খরচ সংকুলান করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুসারে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার ৫,১১৩.৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে যা মূলত নতুন টাকা। এই টাকা ছাপানোর হার বৃদ্ধি পেলে আগামীতে মনিটারিজম তত্ত্ব অনুসারে একটি মুদ্রাস্ফীতি তাড়িত মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা থাকছে যার ফলে মূল্যস্ফীতির হার বর্তমান ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ হার ছাপিয়ে যেতে পারে।

তাই, আশঙ্কার কারণ আছে ব্যাংকের বিভিন্ন চার্জ ও আমানতের পরিমাণের ওপরে ঘোষিত ভ্যাট প্রদানের পরে মূল্যস্ফীতির কারণে আগামীতে ব্যাঙ্কে রাখা গ্রাহকের আমানতের পরিমাণ বছর বছর কমতে থাকবে।

আমানতের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার দায় জনগণের উপরে চাপানো হচ্ছে

২০১৮ সালে জাপানের মূল্যস্ফীতি ছিল দশমিক ৯৮ শতাংশ। জার্মানির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১ দশমিক ৮ শতাংশ।

ফলে দেখা যাচ্ছে  সরকার যে দেশগুলোর সুদের নিম্নহারের উদাহরণ দেয়, সেই দেশগুলোর আমানত, ঋণ ও বন্ডের সুদের হার কম হওয়ার প্রধান কারণ তাদের মূল্যস্ফীতির হার কম।

উল্টোদিকে ৬ শতাংশের কাছাকাছি মূল্যস্ফীতি হওয়ার কারণেই বাংলাদেশের ঋণ, আমানত ও বন্ডের সুদের হার বেশি। এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায় কিন্তু ব্যাংক বা নাগরিকের নয়— এই দায় সরকারের।

ডুইং বিজনেস ইনডেক্স থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ব্যবসা পরিস্থিতি বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ দেশগুলোর মধ্যে একটি। এর ফলে সঞ্চয়ের অর্থ ব্যাংকে রাখা ছাড়া জনগণের হাতে তেমন কোনো উপায় নেই।

এই অবস্থায় আমাদের সন্দেহ: আমানতের সর্বোচ্চ সীমানা ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়ার মাধ্যমে সরকার মূলত, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তার ব্যর্থতার দায় ব্যাংকের গ্রাহকদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। গ্রাহকদেরকে ক্ষতি মেনে নিতে বাধ্য করছে।

বাজার অর্থনীতিতে মূল্য নির্ধারণে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না এমন কোনো কথা নেই। অবশ্যই সরকার জনস্বার্থে বাজারের বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। কিন্তু, কোনো পণ্যের বিক্রেতাকে তার উৎপাদন মূল্যের নিচে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করার অধিকার পৃথিবীর কোনো সরকারের নেই।

একজন কৃষককে সরকার ২৫ টাকা উৎপাদন মূল্যের ধান ১৮ টাকায় বিক্রয় করতে বাধ্য করতে পারে না ঠিক তেমনি মূল্যস্ফীতি ও বিভিন্ন চার্জের পরে ব্যাংকে অর্থ রাখার খরচ যদি ৬ শতাংশের ওপরে চলে যায় তবে আমানতের সর্বোচ্চ হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে ডিপোজিটরদের সুনিশ্চিত ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতেও পারে না কোনো সরকার— এই হারটি অবশ্যই বাজারের চাহিদা ও যোগান দ্বারা নির্ধারিত হওয়া উচিত।

তাই, ৬ শতাংশ হারে গ্রাহকদের ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে বাধ্য করার এই আদেশটি শুধু অযৌক্তিক নয় অনৈতিক ও গণবিরোধীও বটে।

তদুপরি বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির চরিত্র ডিমান্ড পুল নয় বরং কস্ট পুশ— যা সরকারের ব্যর্থতা

এখানে আরও একটি বিষয় হচ্ছে, অর্থনীতিবিদেরা দাবি করে থাকেন বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির চরিত্র ডিমান্ড পুল বা চাহিদাজনিত নয় বরং কস্ট পুশ মানে ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি। কস্ট পুশ ইনফ্লেশনে মূলত সরকারের ভুল পলিসি ও বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার কারণে তৈরি হয়ে। ফলে বলা যায়, বাংলাদেশ সরকার নিজের ব্যর্থতার কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির প্রভাবে আমানতের হার বেড়ে যাওয়ার দায়টি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ব্যাংকের গ্রাহকদের ওপরে চাপিয়ে দিচ্ছে।

নৈতিকতার প্রশ্নের পরে আমরা দেখব, কৃত্রিমভাবে চাপিয়ে দেওয়া এই সুদের হার বজায় রাখা সম্ভব কি না।

নয়-ছয় সুদের হারের প্রধান সমস্যা সরকার নির্ধারিত ৩ শতাংশ নির্ধারিত স্প্রেডে ব্যাংক পরিচালনা সম্ভব নয়

৬ শতাংশ হারে আমানত ও ৯ শতাংশ হারে ঋণের সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়ার মাধ্যমে সরকার নির্ধারণ করে দিচ্ছে ব্যাংকগুলোর স্প্রেড ৩ শতাংশের ভেতরে রাখতে হবে। এর মধ্যেই ব্যাংকগুলোকে মুনাফা বের করে নিতে হবে।

অথচ, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ৪০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৮ ব্যাংকের কষ্ট অফ ফান্ড বা তহবিল পরিচালনা ব্যয় ৬ শতাংশের ওপরে। ৫ শতাংশের নিচে কস্ট অফ ফান্ড রয়েছে মাত্র চারটি ব্যাংকের।

ফলে কোনো মতেই এই ২৮টি ব্যাংকের পক্ষে ৩ শতাংশ স্প্রেড রক্ষা করা সম্ভব নয়। কারণ, তাদের পরিচালনা ব্যয় সরকার নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি।

তহবিল ব্যয় বেশির মুল দায় খেলাপি ঋণ ও পুরাতন কালপ্রিট মূল্যস্ফীতি

প্রশ্ন হচ্ছে কেনো ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যয় ৬ শতাংশের ওপরে? এর প্রধান কারণ মূল্যস্ফীতির কারণে উচ্চহারে নেওয়া আমানত।

কিন্তু, তারপরে বড় একটি কারণ খেলাপি ঋণ। ব্যাসেল থ্রি গাইড লাইন অনুসারে ব্যাংকগুলোকে যেহেতু খেলাপি ঋণের জন্যে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হয় এবং খেলাপি ঋণ যেহেতু ব্যাংকের মূলধন খেয়ে ফেলে তাই খেলাপি ঋণের দায়ে ব্যাংকগুলোর আয় কমে আসে এবং কস্ট অফ ফান্ড বেড়ে যায়। খেলাপি ঋণের কারণে বাংলাদেশের ব্যাংক সহ সব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।

একই সঙ্গে ব্যাংকের তহবিল ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ সরকারের বিভিন্ন রকম চার্জ।

আমানতের ওপরে খেলাপি ঋণের প্রভিশন খরচ, মূলধন হারানোর দায়, মূল্যস্ফীতি জনিত ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যবসা সম্প্রসারণ খরচ, পরিচালনা ব্যয়, ঝুঁকির মূল্য ইত্যাদির সঙ্গে থেকে মুনাফা যোগ করলে কোন কোন ব্যাংকের ঋণ ও কোন কোন খাতের ঋণ বর্তমানে ১৫ শতাংশের ওপরেও চলে যাচ্ছে। এটি মোটেও কাম্য নয় কিন্তু বাস্তবতা।

বিশেষত এসএমই ঋণের ক্ষেত্রে তহবিল পরিচালনা খরচ অনেক বেশি পড়ে এবং কম ঝুঁকি ও বড় পরিমাণের কারণে সরকারকে দেওয়া ঋণের খরচ কম পড়ে। তাই, নয়-ছয় সুদনীতি বাস্তবায়িত হলে এসএমই খাতের ঋণ প্রদান বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছেন।

এই ব্যাংকগুলোকে ৯ শতাংশ হারে ঋণ দিতে বাধ্য করলে হয় ব্যাংকগুলো এসএমই খাতের ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিবে অথবা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে।

আর্থিক ক্ষতির দায় চাপবে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের ওপর

কারণ, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে পরিচালকেরা নামেমাত্র মালিক। শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারীরাই অধিকাংশ ব্যাংকের প্রধান মালিক।

তার মানে ৬ শতাংশের ওপরে পরিচালনা ব্যয় থাকার পরও, সরকারের আদেশ মেনে ৯ শতাংশ হারে ঋণ দিতে গেলে অধিকাংশ ব্যাংক ক্ষতির মুখে পড়বে যার দায়ে ব্যাংকের মূল মালিক শেয়ার বাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ফলে দেখা যাচ্ছে, একদিকে ৬ শতাংশ হারে আমানত নিতে বাধ্য করায় মূল্যস্ফীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যাংকের কোটি কোটি গ্রাহক। অন্যদিকে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুঁজিবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারী।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও খেলাপি ঋণ— এই দুটি নিয়ন্ত্রণের মূল দায় সরকারের। কারণ বাংলাদেশে এই সমস্যা দুটি সরকার-সৃষ্ট। বাংলাদেশে সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, আইনের শাসন রক্ষা করার ব্যর্থতা, অতিরিক্ত মুদ্রাপ্রবাহ, দলীয় নেতা-কর্মীদের অবাধে ব্যাংক লুটের সুযোগ কারণেই মূল্যস্ফীতি ও খেলাপি ঋণ বেড়েছে যার প্রভাবে সব ধরনের সুদের হার বেড়ে গিয়েছে।

কিন্তু, এই প্রধান দুটি সমস্যার গোঁড়ায় হাত না দিয়ে নির্বাহী আদেশে নয়-ছয় সুদের হারের মতো একটি কৃত্রিম অযৌক্তিক মূল্য চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সরকার মূলত ব্যাংকের গ্রাহক ও মূল মালিক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতি মেনে নিতে বাধ্য করছে।

মহামান্য সুলতান তুঘলকের আমলে এমন কাণ্ড ঘটেছে কি না ইতিহাস থেকে জানা যায় না।

জিয়া হাসান, প্রাবন্ধিক এবং উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Fashion brands face criticism for failure to protect labour rights in Bangladesh

Fashion brands, including H&M and Zara, are facing criticism over their lack of action to protect workers' basic rights in Bangladesh, according to Clean Clothes Campaign (CCC)..One year after a violent crackdown by state actors and employers against Bangladeshi garment workers protesting

Now