করোনাভাইরাস: সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে ঢাবির হল-গণরুম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ১০১৩ নম্বর রুম। চার বিছানার এই রুমটিতে এখন ঠাঁই হয়েছে প্রায় ৩০ জন ছাত্রের। এদের মধ্যে বেশিরভাগই নতুন কিংবা সবে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠা শিক্ষার্থী। প্রতি রাতে বিছানায় যে কজন পারে গাদাগাদি করে ঘুমায় আর বাকিদের জায়গা হয় রুমের মেঝেতে।
এই গণরুমে ঘুমের মধ্যে চাইলেই কেও পাশ ফিরতে পারে না। এতটাই গাদাগাদি করে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্যে তাদের বসবাস। এমন পরিস্থিতি তাদের যে কোনো ধরণের সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
এই রুমেই থাকে অনিক। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন এক পরিবেশে থাকি, যেখানে যে কোনো ধরণের ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সচেতন থাকার চেষ্টা করি। তবে এত মানুষ এক সঙ্গে থাকায় এমন একটি রুমে স্বাস্থ্যকর অবস্থা বজায় রাখা বেশ কঠিন কাজ।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের গণরুমে সাড়ে তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এভাবেই আছে। দেশে নভেল করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাওয়ায় এভাবে তাদের বসবাস বেশ উদ্বেগের।
সূর্য সেন হলে সবচেয়ে বেশি গণরুম আছে। সেখানে ২১টি গণরুমে ৫০০ এর বেশি শিক্ষার্থীর বসবাস।
করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য বিস্তার রোধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষার্থীরা সহজেই সংক্রামিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন। শিক্ষার্থীরা কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতির ঘাটতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে জানান, কর্তৃপক্ষের নেওয়া ব্যবস্থা সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
ছেলেদের ১২টি হলে সরেজমিনে পরিদর্শন করে গণরুমগুলোর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দৃশ্যমান হয়। বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর দাবি, করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য সংক্রমণ রোধে কর্তৃপক্ষের উচিত সব একাডেমিক কার্যক্রম এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা।
হাজি মুহাম্মদ মহসিন হলের এক নতুন শিক্ষার্থী বলেন, ‘আপনি তো গণরুমের অবস্থা জানেন। রাতে এতজনের ভিড়ে এখানে ঘুমানোর জন্য বলতে গেলে যুদ্ধ করতে হয়। এরই মধ্যে আবার নতুন এই ভাইরাস আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অনেকেই বাড়ি চলে যেতে চায়। যেতে পারছে না পরীক্ষা চলার কারণে।’
তিনি আরও জানান, হল কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র নোটিশ বোর্ডে নোটিশ টানিয়ে দেয় আর সতর্কতামূলক লিফলেট বিতরণ করে।
প্রথম বর্ষের আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সোহানুর রহমান বলেন, ‘আমরা এর আগেও দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এবার যদি কোনো শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় তাহলে এটা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন কাজ হবে। এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিচ্ছে। ঢাবির কর্তৃপক্ষেরও উচিত নিরাপত্তার স্বার্থে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা।’
বৃহস্পতিবার রাতে প্রভোস্ট কমিটির এক বৈঠকে ঢাবি কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পরলে তা রোধের জন্য একাধিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানগুলোতে দর্শকের সংখ্যা কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
তারা আরও বলেছেন, সব হলে পর্যাপ্ত ও নিরবচ্ছিন্ন পানি এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহ করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সম্ভাব্য ভাইরাসের আক্রমণের জন্য ঢাবির মেডিকেল সেন্টার প্রস্তুত রাখা হবে এবং যাদের ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা আছে তাদের সেখানে বিশেষ চিকিৎসা দেওয়া হবে।
বিদেশে গবেষণা বা উচ্চতর পড়াশুনা করার জন্য যেসব শিক্ষক দেশের বাইরে আছেন আপাতত তাদের দেশে ফিরে আসতে নিরুৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সভায়।
স্যার পিজে হার্টগ আন্তর্জাতিক হলে থাকে বিদেশি আবাসিক শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে তারা বাংলাদেশে নেই। পরবর্তী বিজ্ঞপ্তি না দেওয়া পর্যন্ত তাদের বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের কেউ সম্প্রতি বাংলাদেশে এসে থাকলে সেল্ফকোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সবগুলো হলের কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে সতর্কতামূলক পোস্টার ঝুলিয়ে রাখতে।
কর্তৃপক্ষ এখনও চিন্তিত নয়
ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান জানান, তারা শিক্ষার্থীদের আতঙ্কিত না হয়ে কোনো জরুরি প্রয়োজনে হল প্রভোস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন।
একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত করার বিষয়ে বিবেচনা করছেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রাব্বানী বলেন, তারা আপাতত এ বিষয়ে ভাবছেন না।
অধ্যাপক রাব্বানী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যদি কোনো শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে আমরা যেকোনো ধরণের সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছি। যদি কোনো শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে সংক্রামিত হয় বা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতি হয় সেক্ষেত্রে আমরা এটা (বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা) বিবেচনা করব।’
আরও পড়ুন:
শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া উচিত: ভিপি নুর
Comments