প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় করোনা যুদ্ধে যেভাবে সফল হচ্ছে কোরিয়া

প্রযুক্তিগত দক্ষতার ওপর নির্ভর করে দক্ষিণ কোরিয়া করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। কোরিয়ার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বা বিগডেটা ভাণ্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স-এআই)। কোরিয়ানরা ক্ষিপ্র গতিতে কাজ করতে অভ্যস্ত।
ড্রাইভ থ্রু ল্যাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

প্রযুক্তিগত দক্ষতার ওপর নির্ভর করে দক্ষিণ কোরিয়া করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। কোরিয়ার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বা বিগডেটা ভাণ্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স-এআই)। কোরিয়ানরা ক্ষিপ্র গতিতে কাজ করতে অভ্যস্ত। ফলে নিজেদের কাজের গতি-দক্ষতা বেড়েছে কয়েকগুণ। এতদিন তারা প্রযুক্তিগত খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপলের সঙ্গে সমান বা একটু এগিয়ে কোরিয়ান স্যামসং প্রতিযোগিতা করছে। জাপানের মতো প্রযুক্তির দেশেও কোরিয়ান স্যামসংয়ের আধিপত্য দৃশ্যমান হয়েছে।

বিগডেটা এনালাইসিস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগাম সতর্কতা সহায়তা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া বেশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে করোনা আতঙ্ক মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।

বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ অধিকাংশ কোরিয়ান বিশ্বাস করে, শুরুতেই যদি বিদেশি বিশেষ করে চীনা ভ্রমণকারীদের কোরিয়ায় আসা নিয়ন্ত্রণ ও চীনে যাতায়াত সীমিত করা যেত, তাহলে কোরিয়া এত বড় বিপদে পড়ত না।

সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘বিগডেটা’র বিশাল তথ্য ভাণ্ডারে কোরিয়ার প্রতিটি নাগরিক ও বসবাসরত বিদেশিদের সব তথ্য থাকে। প্রতিটি সরকারি সংস্থা, হাসপাতাল পরিষেবা, আর্থিক সেবা সংস্থা, মোবাইল ফোন অপারেটসহ সব ধরনের সেবা প্রদানকারীদের সিস্টেমের সঙ্গে ইন্ট্রিগেটেড এই তথ্য ভাণ্ডার।

এই ইন্ট্রিগেটেড ডেটা ওয়্যারহাউসের পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কোরিয়া লড়াই করছে করোনাভাইরাসের সঙ্গে। এই বৈপ্লবিক তথ্য-উপাত্তের নানা রিয়েলটাইম রেসপন্স বা তথ্য দেশবাসীর কাছে পাঠাতে সহায়তা করছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় বানানো নানা অ্যাপ্লিকেশন।

যখনই কোনো করনো পজেটিভ পাওয়া যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যক্তির ভ্রমণ ডিটেইলস, তার বিগত কিছু দিনের কর্মকাণ্ড— কোন কোন রুটে তিনি যাতায়ত করেছেন সেই ম্যাপসহ কাছাকাছি এলাকার সব মোবাইল গ্রাহক নোটিফিকেশনে পেয়ে যাচ্ছেন। এসব নোটিফিকেশন মোবাইলের সিস্টেম পুশ হিসেবে আসছে। আর যখন নোটিফিকেশন আসে তখন মোবাইলের কলসহ অন্য কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নোটিফিকেশন পাঠানো হচ্ছে।

মোবাইল নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সরকারি চিকিৎসা পরিসেবা সংস্থার কাছেও করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি গত দুএক সপ্তাহ কোথায়, কার সঙ্গে মিশেছেন এসব তথ্য চলে যাচ্ছে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করা বা সময় কাটানো বন্ধু-পরিজন বা সহকর্মীদেরও সহজেই করোনা পরীক্ষার আওতায় আনা যাচ্ছে। আর পুরো প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করে দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা এনালিটিক্স। হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স, মোবাইল হাসপাতাল বা মোবাইল টেস্ট ল্যাবসহ প্রতিটি কাজ যথাসম্ভব দ্রুত বা যথাযথ হওয়ার কারণ আইটি সেক্টর তথা প্রযুক্তিগত দক্ষতা।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কোরিয়ার যুগান্তকারী ড্রাইভ থ্রু ধারণা (Drive-thru concept) ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনভাবে করোনা শনাক্তের অস্থায়ী ল্যাব তৈরি করা হয়েছে, যে ল্যাবে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করা যায়। গাড়িতে বসে থাকা অবস্থায় রক্তের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। এমন অনেকগুলো ড্রাইভ থ্রু ল্যাব করা হয়েছে। এসব ল্যাবে মোবাইল অপারেটরা দিচ্ছে উচ্চগতির ৫জি ব্যান্ডউইথ।

রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় মোবাইল ফোনে নোটিফিকেশন আসছে, আশেপাশে কোথায় ড্রাইভ থ্রু ল্যাব আছে।

বড় বিল্ডিং বা কমপ্লেক্স কোনো করোনা আক্রান্তের আবাস বা কর্মস্থল হলে সেখানে স্থাপন করা হচ্ছে অত্যাধুনিক সব সুবিধা সম্মলিত মোবাইল হসপিটাল। ফলে পুরো বিল্ডিংয়ে যত মানুষ থাকেন সহজে তাদের সবার করোনা পরীক্ষা করা যাচ্ছে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ডেটা পর্যালোচনা করে বলে দিচ্ছে সম্ভাব্য কোন স্থানের মানুষের করোনা আক্রান্তের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সেই অনুযায়ী এলাকাগুলোতে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে এবং সতর্কতার অংশ হিসেবে প্রতিরোধের আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

মাস্কসহ প্রয়োজনীয় সব পণ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, যথাযথ বিপণন বা বণ্টনের ক্ষেত্রেও নিশ্চিত করা হয়েছে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার। প্রথম কদিন বিছিন্ন কিছু ঘটনার ফলে সরকার খুব দ্রুত নীতিমালা করে দিয়েছে। আইডি কার্ড দিয়ে কাছের ওষুধের দোকান থেকে দুটি মাস্ক কেনার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে, মোবাইলের সিস্টেম নোটিফিকেশনে এসব তথ্য আসছে বা অ্যাপ দিয়ে দেখা যাচ্ছে— কাছের মাস্ক সহবরাহকারীর বিস্তারিত তথ্য। সর্বোচ্চ কয়টি মাস্ক পাওয়া যাবে সেটাও বলে দেওয়া হচ্ছে।

বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে আতঙ্ক বিরাজ করলেও সিউলে চাল-তেল, শিশু খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো কিছুর দাম বাড়েনি বললেই চলে।

কয়দিন আগে কথা হচ্ছিল, কোরিয়াতে খুব কাছের এক বন্ধুর সঙ্গে— অনেকবার যিনি আমার সঙ্গে বাংলাদেশে গেছেন। তিনি  গর্ব করে বলছিলেন, ‘ডেটা’র এই সহজ প্রাপ্যতার কারণে কোরিয়া মোটামুটি এখন ডিফাইন করতে পারছে বা দ্রুত উদ্যোগ নিতে পারছে বা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। অনেক দেশেই এত বিস্তারিত ও ডিজিটাল ফরম্যাটে ডেটা নেই বা পর্যাপ্ত প্রযুক্তি বা লজিস্টিক সুবিধা নেই। জাতিগতভাবে কোরিয়ানরা যেহেতু দ্রুত গতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও কাজে অভ্যস্ত, তারও একটা সুবিধা তারা পেয়েছে। জাপানের কাছেও নিশ্চয় তার সব নাগরিকের ডেটা আছে। কিন্তু তারা একটু ধীর-স্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। যে কারণে জাপান পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। করোনাভাইরাস যুদ্ধে সম্ভবত এ-ও প্রমাণ হচ্ছে যে, প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জায়গায় কোরিয়া পৃথিবীর বহু দেশকে ছাড়িয়ে গেছে।

কয়েকদিন আগে সিউলের প্রখ্যাত গুরো ডিজিটাল এরিয়ার কল সেন্টারে শতাধিক করোনা আক্রান্তের বাইরে, রোগীর সংখ্যা কমে এসেছে। কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছেন, আমরা কেউ নিরাপদ নই, সবাই বিপদের মধ্যে আছি। ভয় বা আতঙ্ক নয়, সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। সতর্কতার অংশ হিসেবে সরকারি অফিস ডিজিটালি (ওয়ার্ক ফর হোম) পরিচালিত হবে।

এমএন ইসলাম: প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, টিকন সিস্টেম। কোরিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরে দীর্ঘদিন কর্মরত।

Comments

The Daily Star  | English

Schedule of trains bound for western districts, Mymensingh disrupted

Schedule of trains bound for the country's western destinations has almost collapsed today following yesterday's collision, causing immense sufferings to the passengers

12m ago