‘আমরা দেশে ফিরে যাই একটু ভালোবাসা-আশ্রয় পাওয়ার জন্য’

ফ্রান্সে বৈধ-অবৈধভাবে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার বাংলাদেশি থাকেন। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সেও ছড়িয়ে পড়েছে নতুন করোনাভাইরাস। দুই জন বাংলাদেশিও আক্রান্ত হওয়ায় সেখানকার বাংলাদেশিরা শঙ্কায় আছেন। ভাইরাস প্রতিরোধে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বার, রেস্টুরেন্ট ও ১০০ জনের জনসমাগম হয় এমন এলাকা বন্ধ করে দিয়েছে ফ্রান্স।
France corona
প্যারিসের একটি রেল স্টেশন। ১৭ মার্চ ২০২০। ছবি: রয়টার্স

ফ্রান্সে বৈধ-অবৈধভাবে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার বাংলাদেশি থাকেন। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সেও ছড়িয়ে পড়েছে নতুন করোনাভাইরাস। দুই জন বাংলাদেশিও আক্রান্ত হওয়ায় সেখানকার বাংলাদেশিরা শঙ্কায় আছেন। ভাইরাস প্রতিরোধে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বার, রেস্টুরেন্ট ও ১০০ জনের জনসমাগম হয় এমন এলাকা বন্ধ করে দিয়েছে ফ্রান্স।

আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় ভোররাত ২টার দিকে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থী তোফায়েল সিপুর সঙ্গে। তার নিজেরও ১০ দিনের মতো জ্বর ছিল। এখন একটু সুস্থ। কিন্তু, তিনি করোনায় আক্রান্ত নন। তবে, নিজের অসুস্থতা নিয়ে একটু ভাবছেন না তিনি। তার ভাবনাজুড়ে বাংলাদেশের মানুষ। তিনি বারবার জানতে চাচ্ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ কেমন আছে, বাংলাদেশের কী পরিস্থিতি?

‘ভাই, প্লিজ বলুন না বাংলাদেশের কী পরিস্থিতি? করোনাভাইরাস আমার দেশে ছড়িয়ে পড়েনি তো। আমরা তো বিদেশে থেকে সব জানতে পারি না। দেশের জন্য খুব খারাপ লাগে…’

বললাম, ‘ভয় পাবেন না, আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। আমরা ভালো আছি।’

তোফায়েল সিপুর গ্রামের বাড়ি সিলেটে। ২০১৮ সালে থেকে তিনি ফ্রান্সে আছেন। সেখানের সেইন্ট ডেনিস ইউনিভার্সিটির ডিপ্লোমা শিক্ষার্থী তিনি। আর থাকেন ইল দ্যু ফ্রান্স রিজনে। এই অঞ্চলে বাংলাদেশিদের প্রায় ৮০ শতাংশ থাকেন বলে জানান তিনি। তার মতে, ইল দ্যু ফ্রান্স দেশটির রাজধানী প্যারিসের কাছাকাছি হওয়ায় অন্যান্য বিদেশিদেরও বেশিরভাগ সেখানে থাকেন।

এই ভাইরাস নিয়ে ফ্রান্সের বাংলাদেশিরা কতটা সচেতন?

‘বাংলাদেশিরা সচেতন হলেও ফ্রান্সের মানুষ এটা নিয়ে একটুও শঙ্কিত নয়। বরং তারা বিষয়টাকে ছুটির মতো করো উপভোগ করছে।’ সিপুর ভাষায়, ‘সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেও ফ্রান্সের মানুষের মধ্যে তেমন সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। সবকিছু বন্ধ থাকায় মানুষ পার্কে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সাপ্তাহিক বাজারেও ছিল প্রচুর ভিড়। কারো মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস ছিল না। তবে, অন্যদের তুলনায় সেখানকার বাংলাদেশিরা অনেক সচেতন। তারা প্রয়োজন ছাড়া একদমই বাইরে বের হচ্ছেন না।’

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছি ফ্রান্সে এখন পর্যন্ত দুই জন বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।

‘হ্যাঁ, এই দুই জনকে ফ্রান্সের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেছেন। ফ্রান্সে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের সম্পূর্ণ চিকিৎসার দায়িত্ব নিচ্ছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া, যাদের মধ্যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছে। ফ্রান্সের বেশিরভাগ বাড়ি সরকারি। এসব সরকারি বাড়িতেই সম্ভাব্যদের কোয়ারেন্টিন করে রাখা হচ্ছে। সরকারের এই উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়।’

‘অসুস্থতার কারণে কেউ কাজে যেতে না পারলে তার বেতন সরকার বহন করে। সরকারি-বেসরকারি সব চাকরিজীবীদের জন্য একই নিয়ম। শুধু মেডিকেল ডকুমেন্টস জমা দিলেই সরকার বেতন দিয়ে দিবে। তাই করোনার কারণে যেসব বাংলাদেশির কাজ বন্ধ আছে তারা সবাই বেতন পাবেন।’

‘বর্তমানে ফ্রান্সের দোকান, রেস্টুরেন্ট, বাজার, বার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই খাবার নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন বাংলাদেশিরা। শুধু বাংলাদেশি নয় সবাই খাবারের সঙ্কটে আছেন। ফার্মেসি ও দু-একটি সুপারশপ খোলা আছে। তবে, সেখানে ছিল উপচে পড়া ভিড়। মানুষ এসব সুপারশপে হুমড়ি খেয়ে খাবার সংগ্রহ করছে। যা পাচ্ছেন তাই কিনে মজুদ করে রাখছেন।’

বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন কি?

‘যদিও এখানে দূতাবাসের কিছু করার নেই। কারণ এটা ফ্রান্স সরকারের বিষয়। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশ দূতাবাস সেটাকেই বাংলাদেশিদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।’

‘বাংলাদেশে ইতালি ফেরতদের কোয়ারেন্টিনে রাখার ঘটনা নিয়ে ফ্রান্সের প্রবাসীরাও ক্ষুব্ধ’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইতালি ফেরতদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা হয়েছে তাতে আমরা এই মুহূর্তে দেশে ফেরার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। তাদের কোয়ারেন্টিনের নামে এক ধরনের নির্যাতন কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। যে পথ দিয়ে লাশ বের করা হয় সেই পথ দিয়ে তাদের বের করা হয়েছে। এভাবে প্রবাসীদের অপমান করা হয়েছে। অথচ আমরা মা, মাটি ও দেশকে ছেড়ে এই প্রবাস জীবনে থাকি।’

‘দেশে যখন দুর্নীতি আমরা প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছি। সরকার আমাদের নিয়ে গর্ব করে অথচ আমাদের জায়গা দিতে পারছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরাও চাই আমার দেশ নিরাপদ থাকুক। তাই বলে কোয়ারেন্টিনের নামে এমন জায়গায় রাখা উচিৎ নয় যেখানে গেলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যায়। রাখতে হলে ভালোভাবেই রাখা উচিৎ। নিয়ম মেনেই রাখা উচিৎ। আমরা সামাজিক মাধ্যমে অনেক ধরনের ছবি দেখছি। দেখলাম একজন মা তার সন্তান নিয়ে বসে আছেন। আর তার হাত মশার কামড়ে ফুলে গেছে। এভাবে কাউকে কোয়ারেন্টিনে রাখা উচিৎ নয়। সরকার যদি এ অবস্থায় প্রবাসীদের গ্রহণ না করতে চায় তাহলে ফ্লাইট বাতিল করে দিলেই পারতো। তাহলে আর কেউ ফিরতে পারতো না।’

‘সরকারের অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত আমরা দেশে ফিরে যাই একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য, একটু আশ্রয় পাওয়ার জন্য।’

Comments