সোবাহান মঞ্জিল: শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি

পিরোজপুরের যে কোনো মানুষ হাসপাতাল রোডের পুরনো বিরাট দালানকে চেনেন ‘সোবাহান মঞ্জিল’ নামে, জানেন এর প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আবদুস সোবাহানের নাম। বঙ্গবন্ধু পিরোজপুরে আসলে এ বাড়িতেই উঠতেন। বলা চলে, আবদুস সোবাহান ছিলেন তার আমৃত্যু সহচর।
Sobahan Manjil pirojpur
শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য পিরোজপুরের ‘সোবাহান মঞ্জিল’। ছবি: সংগৃহীত

পিরোজপুরের যে কোনো মানুষ হাসপাতাল রোডের পুরনো বিরাট দালানকে চেনেন ‘সোবাহান মঞ্জিল’ নামে, জানেন এর প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আবদুস সোবাহানের নাম। বঙ্গবন্ধু পিরোজপুরে আসলে এ বাড়িতেই উঠতেন।

বলা চলে, আবদুস সোবাহান ছিলেন তার আমৃত্যু সহচর। আবদুস সোবাহানের সঙ্গে শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। তারা পিরোজপুরে আসলে এই বাড়িতে উঠতেন। শেরে বাংলা তাকে চিঠি দিয়েছেন। পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটি ছিলেন পিরোজপুরবাসীর গর্বের সন্তান। বঙ্গবন্ধু, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দীর এই স্মৃতিবাহী বাড়ি ও ডকুমেন্ট আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

পিরোজপুরে তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি, বিশিষ্ট আইনজীবী আবদুস সোবাহানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। ১৯৪৮ সালে রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে আবদুস সোবাহান পিরোজপুর মহকুমার প্রতিনিধি হিসেবে এই সম্মেলনে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু দক্ষিণাঞ্চল সফরে এলে পিরোজপুরের হাসপাতাল রোডে ‘সোবাহান মঞ্জিল’ নামক দ্বিতল ভবনে উঠতেন। এই বাড়িতে জাতির জনক ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন কালে, ১৯৫৬ সালে ও ১৯৭০ সালে নির্বাচনে সফরের সময় অবস্থান করেন।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের আগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে, ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হয়ে ও ১৯৭০ সালে শেরে বাংলার ছেলে এ কে ফয়জুল হককে নিয়ে বঙ্গবন্ধু এই সোবাহান মঞ্জিলে অবস্থান করেন। এ সময় তার সঙ্গে মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা আবদুস সোবাহান ছাড়াও সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন, বদিউল আলম চৌধুরী, আজিজুর রহমান সিকদার, সফিজউদ্দিন আহম্মেদ, ডা. আমোদরঞ্জন গুহসহ মহকুমা আওয়ামী লীগের নেতারা সার্বক্ষণিক তার পাশে থাকতেন। আবদুস সোবাহান অসুস্থতার কারণে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকিট পাননি, পেয়েছিলেন মহকুমা আওয়ামী লীগের সম্পাদক জয়নুল আবেদিন। তবে দলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে তার সহযোগিতা ছিল। বঙ্গবন্ধু আবদুস সোবাহানকে দুটি টেলিগ্রাম করেন যা আজও পরিবারে পক্ষ থেকে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

৮-১১-১৯৫৬ সালে একটি টেলিগ্রামে তিনি উপনির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার কথা বলেন। পরের দিন ৯-১১-১৯৫৬ তারিখে অভিনন্দন জানিয়ে আরেকটি টেলিগ্রাম করেন। ১৯৭০ সালের ৭  ও ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাতে পিরোজপুরে এসে বঙ্গবন্ধু এই ভবনটিতেই অবস্থান করেছেন। পিরোজপুর শহরের টাউন উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত জনসভায় তিনি ভাষণ দেন। সেসময় জয়নুল আবেদীনের সভাপতিত্বে এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে বলেন, ‘ইনশাল্লাহ এ নির্বাচনে আপনাদের সমর্থনে আমরা বিজয়ী হবো। আর আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি ৬ দফার দাড়ি, কমা, সেমিকোলনও পরিবর্তন করা হবে না। ৬ দফা আদায় করে ছাড়বো।’ জনসভায় আসার আগে তিনি সোবাহান মঞ্জিলে প্রবেশ করলে বাড়ির সদস্যরা বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। সেসময় প্রয়াত আবদুস সোবাহানের ছোট ছেলে অ্যাডভোকেট সলিমুল্লাহ ছয়টি তারা খচিত একটি নৌকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘পাকিস্তানিরা ৬ দফা না মানলে কি করবেন?’ বঙ্গবন্ধু মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘সলিম স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রস্তুত হও।’

‘সোবাহান মঞ্জিল’ এলে বঙ্গবন্ধু শ্বেতপাথরের এই টেবিলে ভাত খেতেন।

বঙ্গবন্ধু  যে সময় কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়ন করেন ও বেকার হোস্টেলে অবস্থান করতেন তখন আবদুস সোবাহানের জামাতা এস এ সালেহ মিয়ার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। এমনকী, তিনি বেকার হোস্টেলে একই সঙ্গে থাকতেন। সেসময় ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু জিএস নির্বাচিত ও সালেহ আহম্মেদ ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।  এস এ সালেহ মিয়ার চাচাত ভাই নুরুদ্দীন সাহেব ১৯৫৮ সালে পিরোজপুরের একটি আসন থেকে আইন সভার সদস্য হয়েছিলেন। (তথ্যসূত্র: অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা ১৮, ২৮, ২৬-৩০, ৩৩, ৪৩, ৬৩-৬৬, ৬৯, ১৩৬; এছাড়াও বঙ্গবন্ধু অন লাইন আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবন-মেজর জিয়া উদ্দিন ও মরহুম আবদুস সোবহানের নাতি অতিরিক্ত ডিআইজি, বরিশাল রেঞ্জ, এ কে এম এহসান উল্লাহ, পিরোজপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র সাদুল্লাহ লিটন, সহকারী অ্যাটির্নি জেনারেল আয়েশা ফ্লোরা, ও লে. কর্নেল এ কে এম কায়েস, ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট)

আবদুস সোবাহানের সঙ্গে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। তারা উভয়েই তাকে চিঠি লিখেছেন। বর্তমানে পিরোজপুর শহরের হাসপাতাল রোডে ৬ বিঘা জমির ওপর সোবাহান মঞ্জিল। এ ছাড়া, বঙ্গবন্ধু যে টেবিলে খেতেন সেই শ্বেত পাথরের টেবিলটি অক্ষত আছে। আছে বঙ্গবন্ধুর দুটি টেলিগ্রাম। রয়েছে শেরে বাংলা এ কে এম ফজলুল হকের ঐতিহাসিক চিঠি। ১৯৪৬ সালে শেরে বাংলার প্রার্থীর কাছে আবদুস সোবাহান পরাজিত হন। ১৯৫৩ সালের ১৪ মার্চ আবদুস সোবাহানকে চিঠি দেন শেরে বাংলা।

আবদুস সোবাহানের নাতি অতিরিক্ত ডিআইজি এ কে এম এহসান উল্লাহ বলেন, ‘আমরা আমাদের বাড়িতেই এই স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নিতে চাই। তবে এ ক্ষেত্রে পিরোজপুরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি যাতে এখনো জাগরুক থাকে, তাই সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দুটা টেলিগ্রামের প্রথমটা ডা. মোজাফরকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানের জন্য, দ্বিতীয়টা শেরে বাংলা তিনটি আসন থেকে নির্বাচিত হলে দুটি ছেড়ে দিতে হবে। একটিতে নুরুদ্দিন ও আরেকটিতে জয়নাল আবেদিন নির্বাচন করে বিজয়ী হন। সভাপতি হিসেবে আবদুস সোবাহানকে নির্বাচনে ভালো ফলের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে এই টেলিগ্রাম করেন।’

স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবদুস সোবাহান এলাকায় অত্যন্ত সজ্জন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার দাদাবাড়ি ছিল তৎকালীন স্বরূপকাঠি (বর্তমান নেছারাবাদ উপজেলা) এর গুয়ারেখা ইউনিয়নে। আবদুস সোবাহান পিরোজপুর মোক্তার বার অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দিলে খুব দ্রুত শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর নজরে আসেন। তিনি প্রথমে মহকুমা মুসলিম লীগেরও আহবায়ক ছিলেন। আওয়ামী গঠিত হলে তিনি পিরোজপুর মহকুমার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৯ সালের ৭ ডিসেম্বর তিনি স্ত্রী রহিমা খাতুন ও ৫ ছেলে ও ৮ মেয়ে রেখে মারা যান।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago