করোনাভাইরাস

ইউরোপের অন্যতম উন্নত হাসপাতালটিও মৃত্যুপুরী

হাসপাতাল কর্মীরা ক্রমাগত হাত নেড়ে পথ থেকে মানুষ সরাচ্ছেন, স্ট্রেচারে করে দ্রুতগতিতে একের পর এক রোগীকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালের পরিবেশকে ঠিক ‘বিশৃঙ্খল’ বলা চলে না। তবে, সবাই অসম্ভব রকমের ব্যস্ত, ছোটাছুটি করছেন এক রোগী থেকে অন্য রোগীর বিছানায়।
italy-coronavirus.jpg
ইতালির মিলানের ল্যাম্বার্ডি এলাকার বারগেমো হাসপাতাল যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। ছবি: স্কাই নিউজ

হাসপাতাল কর্মীরা ক্রমাগত হাত নেড়ে পথ থেকে মানুষ সরাচ্ছেন, স্ট্রেচারে করে দ্রুতগতিতে একের পর এক রোগীকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালের পরিবেশকে ঠিক ‘বিশৃঙ্খল’ বলা চলে না। তবে, সবাই অসম্ভব রকমের ব্যস্ত, ছোটাছুটি করছেন এক রোগী থেকে অন্য রোগীর বিছানায়।

হাসপাতালের ওয়ার্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা বিছানাগুলোতে রোগীরা কষ্টে কাতরাচ্ছেন। কেউ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ার কথা জানাচ্ছেন, অক্সিজেন খুঁজছেন। কেউ আবার মুখে অক্সিজেন টিউব থাকা সত্ত্বেও বুক চাপড়ে তীব্র যন্ত্রণার কথা বলতে চাইছেন।

আমি বারগেমোর প্রধান একটি হাসপাতালে দাঁড়িয়ে আছি। ইতালিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত অঞ্চল ল্যাম্বার্ডির সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত শহর বারগেমো এখন যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। 

মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস ও গায়ে হ্যাজমেট স্যুট পরে আমরা হাসপাতালের এক করিডোর থেকে অন্য করিডোরে সংবাদ সংগ্রহের জন্য ছুটছিলাম।

একজনের কাছে জানতে চাইলাম, ‘এটা কোন ওয়ার্ড?’

হাসপাতাল প্রেস উইংয়ের প্রধান ভানা টনিনেইলি উত্তরে বললেন, ‘এটা কোনো ওয়ার্ড না। এটা ওয়েটিং রুম। আমাদেরকে এখন হাসপাতালের সব স্থান ব্যবহার করতে হচ্ছে।’

হাসপাতালে কর্মীরা দিনরাত এখানে ভয়াবহ যুদ্ধ করছেন, জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করছেন। সেই যুদ্ধে তারা বারবার পরাজিত হচ্ছেন!

এই একটি হাসপাতালের পরিস্থিতি থেকেই গোটা ইতালির হাসপাতালগুলোর চিত্র অনুমান করা যায়। কর্মীরা রাতদিন নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে রোগীদের কষ্ট দূর করতে চাইছেন, তাদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।

একেক জন রোগী এসে হাসপাতালে ঢোকার পরপরই দলবেঁধে তার কাছে ছুটে যাচ্ছেন কর্মীরা। দ্রুত স্যালাইন ও অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন, গায়ে মনিটরসহ নানা যন্ত্রপাতি বসাচ্ছেন।

বিপুল যন্ত্রপাতি ও কর্মীদের উদ্বেগ দেখে মনে হয় এটা যেন কোনো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), কিন্তু এটা একটা জরুরি বিভাগের প্রবেশ পথ। আইসিইউতে কোনো জায়গা নেই। শারীরিক অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ হওয়া সত্ত্বেও নতুন আসা রোগীদেরকে বাইরেই রাখতে হচ্ছে।

অন্য কোনো সময় হলে ওই রোগীদের আইসিউতেই রাখা হতো। কিন্তু, এই হাসপাতালের আইসিউতে জায়গা পেতে হলে কেবল গুরুতর অসুস্থ না, আপনাকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে থাকতে হবে।

মহামারির সময়ে আমরা এতোটাই খারাপ অবস্থায় আছি যে, গুরুতর অসুস্থতা নিয়েও আইসিইউর বাইরে থাকাটা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিছুক্ষণ পরপরই নতুন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। মহামারি সম্পূর্ণভাবেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

আমাদের আগে এখানে আর কোনো সাংবাদিককে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়নি। বারগেমো শহরে ঢোকার অনুমতি আমরা পেয়েছি, যা আগে কোথাও কখনো ঘটেনি এমন বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে থাকবার জন্য।

গোটা বিশ্বকে এই মহামারি যে কতটা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে, তা জানানোর জন্য। তারা চাইছে, অনেকেই যারা ইতালি সরকারের আন্তরিকতা, দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন করছেন, তারা এখানকার করুণ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানুক। 

হাসপাতাল জুড়ে হার্ট মনিটর, অক্সিজেন পাম্পের শব্দ এক মুহূর্তের জন্যও থামার উপায় নেই। একেক জন রোগীর সারা শরীরে প্লাস্টিক মোড়ানো। চিকিৎসকের কথা রোগী ঠিক মতো শুনতে পাচ্ছেন না। রোগীদের কথাও পৌঁছাচ্ছে না চিকিৎসকের কানে।

এটা মোটেও সাধারণ ফ্লু না। এটা কোনো নিউমোনিয়া না। একইরকম উপসর্গ নিয়ে ভাইরাসটি প্রতিদিন হাজারো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। 

জরুরি বিভাগের প্রধান ডা. রোবের্তো কোসেটিনি বলেন, ‘এরকম মহামারি আমরা আগে কখনো দেখিনি। হাসপাতালের কেউ কখনো এটা কল্পনাও করেননি যে, এতো রোগী একসঙ্গে সামলাতে হবে।’

যেসব দেশে ভাইরাসটি এখনো মারাত্মক আকারে ছড়ায়নি তাদেরকে সাবধান হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলেন।

রোবের্তো কোসেটিনি বলেন, ‘সাধারণত এই ঋতুতে আমাদের এখানে ৫০-৬০ জনের মতো নিউমোনিয়ার রোগী আসেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। আর এ কারণেই আমরা জরুরি বিভাগ এবং অন্যান্য ওয়ার্ডগুলোকে পূর্ণবিন্যস্ত করে তিন স্তরের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র তৈরি করেছি।’

এখানকার অনেক কর্মী এর আগে যুক্তরাজ্যে কর্মরত ছিলেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ডা. লরেঞ্জো গ্রাজিওলি যুক্তরাজ্যের লেস্টারের একটি হাসপাতালে একবছর কাজ করেছেন।

তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের চিকিৎসক বন্ধুরা আমাকে প্রতিদিন ফোন করছেন। ভাইরাসটির ব্যাপারে জানতে চাইছেন। তারাও একই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি তাদের জন্য চিন্তিত।’

নতুন করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়ে গেছে ইতালি। দেশটিতে এখন পর্যন্ত মৃতের ৩ হাজার ৪০৫, আক্রান্ত হয়েছেন ৪১ হাজার ৩৫ জন। হাসপাতালগুলোতে প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা, চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। ইউরোপের সবচেয়ে উন্নত হাসপাতালগুলোর একটি দ্য পাপা জিওয়ান্নি টোয়েন্টি থ্রি। বারগেমো শহরের এই মেগা হাসপাতালটির করুণ পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক স্টুয়ার্ট র‍্যামসি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির বাংলা অনুবাদ।

Comments

The Daily Star  | English
Chief Adviser Muhammad Yunus

Chief Adviser Yunus's UNGA trip a critical turning point

Now is the best chance for Bangladesh to strengthen international cooperation.

2h ago