করোনাভাইরাস

সম্পূর্ণ অরক্ষিত ঢাকার বস্তিবাসী

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পরা রোধ করতে প্রতিদিন দেশব্যাপী ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা’ ও ‘দূরত্ব’ বজায় রাখার ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। রাজধানীর একটি বড় জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বস্তিতে বাস করে। তাদের দেখে মনে হয় এই ভাইরাস এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা সম্পর্কে তারা জানেনই না।
কড়াইল বস্তির এরিয়াল ভিউ। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পরা রোধ করতে প্রতিদিন দেশব্যাপী ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা’ ও ‘দূরত্ব’ বজায় রাখার ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। রাজধানীর একটি বড় জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বস্তিতে বাস করে। তাদের দেখে মনে হয় এই ভাইরাস এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা সম্পর্কে তারা জানেনই না।

গত কয়েকদিনে শহরের কয়েকটি বস্তি ঘুরে দেখা যায়, দুই সিটি করপোরেশনের সচেতনতামূলক প্রচারণার পর্যাপ্ততার অভাবে বস্তিবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে।

কড়াইল বস্তির ৫৫ বছর বয়সী বাসিন্দা শাহিনূর বেগমের কথাই ধরা যাক। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি জানান, করলা (সবজি) থেকে ‘করলাভাইরাস’ছড়ায় বলে ভেবেছিলেন তিনি।

কসাইদের কাছ থেকে গরুর ভুঁড়ি কিনে নিয়ে তা মহাখালী কিচেন মার্কেটে বিক্রি করে সংসার চালান শাহিনূর। তিনি বলেন, ‘কদিন ধরে সবাই এই ভাইরাসের কথা বলছে। আমি ভেবেছিলাম এটা করলা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে, তাই আমি আমার বাড়ির সবাইকে নিষেধ করেছি করলা কিনতে।’

শাহিনূরের মতোই বস্তিতে থাকা বেশিরভাগ মানুষ করোনাভাইরাসের কথা শুনেছেন। তবে তাদের এই ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য কি করতে হবে বা কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই।

শাহিনূর বলেন, ‘আমি ঝুঁকি সম্পর্কে কীভাবে জানব? বস্তিতে থাকি, আমার টিভি নেই, পত্রিকাও পড়ি না। এই ভাইরাসের কারণে কী হচ্ছে তা আমাকে কেউ বলেনি। এটা কতটা মারাত্মক, কারা ঝুঁকিতে আছে, রোগের লক্ষণ কী, লক্ষণ দেখা দিলে কোথায় যাব, কিছুই জানি না।’

একই বস্তির ৬৫ বছর বয়সী একজনকে দেখা গেল উদ্বিগ্ন। তিন বছর ধরে তিনি হাঁপানিতে ভুগছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমি একটু ভয়ের মধ্যেই আছি। কিন্তু পরীক্ষা করতে কোথায় যেতে হবে তা তো জানি না। আমার বিশ্বাস, আমার করোনাভাইরাস সংক্রামণ হয়নি। কিন্তু তারপরও নিশ্চিত হওয়া দরকার।’

তেজগাঁও বাউলবাগ বস্তির গৃহিনী রানু আক্তার জানান, তারা আশায় আছেন কি করতে হবে আর কি করা থেকে বিরত থাকতে হবে তা জানানোর জন্য কেউ যাবেন। তিনি বলেন, ‘তা না হলে, আমরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ব।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ সংক্রামণের প্রধান কারণ অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন, অতিরিক্ত জনাকীর্ণতা এবং স্বাস্থ্যকর উপকরণের অভাব। তবে বেশিরভাগ দিনমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কারখানার শ্রমিক বা গৃহকর্মী বস্তিবাসী জানান, তাদের পক্ষে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা বা ভিড় এড়িয়ে চলা কঠিন।

কড়াইল বস্তির বাসিন্দা রিকশাচালক নিয়ামত আলী বলেন, ‘আমি যদি মুখোশ পরে কিছু না করে ঘর বসে থাকি তাহলে আমার পরিবারকে খাওয়াব কীভাবে? এখানে থাকা সবাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে পেটের ভাত যোগাড় করতে।’

কড়াইল বস্তির আবর্জনায় ভরা সরু গলিতে সবিতা রানীকে দেখা গেল আরও নয় জন নারীর সঙ্গে বসে থাকতে। ‍তিনি বলেন, ‘দেখুন, এখানে আমরা ৪০ হাজারের বেশি মানুষ থাকি। এত ঘন বসতির মধ্যে কি মানুষ এড়ানো সম্ভব? আমার দুটি ঘর আছে। পরিবারের নয় জন সদস্য নিয়ে আমি সেখানে থাকি। প্রতি ঘণ্টায় আমার ঘরের সামনে অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জনের সঙ্গে আমার দেখা হয়।’

১৮ বছর বয়সী গৃহিণী অনু রানী তার তিন বছরের ছেলেকে সব সময় পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি, সব সময় ওকে কোলে রাখতে পারি না। এখন আমার ছেলে হাঁটতে শিখেছে, ঘরের ভিতরে থাকে না। বের হয়ে গলিতে গিয়ে আবর্জনায় খেলে।’

তার মতোই অবস্থা ৩৫ বছর বয়সী নাজমা বেগমের। একটি বায়িং হাউজের পরিচ্ছন্নতাকর্মী নাজমা যখন বাসায় থাকেন তখন তিন ছেলে ও মেয়েকে পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু যখন কাজে যান, তখন তার বাচ্চারা এলাকার অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে গলিতে গিয়ে খেলা করে। তিনি বলেন, ‘আপনি যখন এইরকম ছোট্ট জায়গায় এত ভিড়ের মধ্যে থাকবেন তখন নূন্যতম স্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি বজায় রাখাও কঠিন।’

কাজের জন্য বাইরে বের হওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করেন? জানতে চাইলে নাজমা বলেন, ‘আমি গত সপ্তাহে একটি মাস্ক কিনতে চেয়েছিলাম। দোকানদার দাম চাইল ৫০ টাকা, তাই আর কিনিনি।’

তেজগাঁও বাউলবাগ বস্তির বাসিন্দারা জানান, তারা এই ভাইরাস নিয়ে চিন্তিত। যদিও এখন পর্যন্ত তারা জানেন না কিভাবে ভাইরাসের সংক্রামণ রোধে প্রস্তুতি নেবেন।

সেখানে মিলন মিয়াকে দেখা গেল রক্ত মাখা হাতে হাঁস-মুরগি বিক্রি করছেন। তার কাছাকাছি বসে শাক-সবজী বিক্রি করছেন প্রায় ৫০ জন। পাশের রেললাইনে খালি গায়ে খেলধূলায় ব্যস্ত শিশুরা।

বস্তির বাসিন্দা বিশ বছর বয়সী শাহিদা জানান, তিনি অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল সাবান কিনেছেন এবং বাড়ির প্রতিটি কাজ শেষে হাত ধুচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভাইরাসের কথা জেনে সত্যিই ভয়ে আছি। চেষ্টা করছি বাচ্চাদের ঘরের ভিতরে রাখার।’ মজার বিষয় হচ্ছে, তিনি যখন এসব বলছেন, তখন তার দুবছরের মেয়েকে দেখা গেল রেললাইন থেকে একটা পাথর তুলে মুখে দিতে।

মিরপুরের বাউনিয়া বাধ বস্তির ইকবাল হোসেনের মতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা এই ভাইরাস নিয়ে বেশি সচেতন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাবা-মায়ের মতো বয়সীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। তবে তারা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন নন। তাদের বেশিরভাগই জানেন না কি নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে।’

বেশ বড় সংখ্যক বস্তিবাসী এটাও বিশ্বাস করেন যে মানুষকে ‘সঠিক পথে ফেরাতে’ করোনাভাইরাস ‘স্রষ্টা প্রদত্ত শাস্তি’।

তেজগাঁও বস্তির ৭২ বছর বয়সী মো. শাহজালাল বলেন, ‘আজকাল মানুষ ধর্মীয় বিধি-নিষেধ মেনে চলে না। আল্লাহ তাদের জন্যেই করোনাভাইরাস পাঠিয়েছেন।’

রিকশাচালক মো. হৃদয় বলেন, ‘করোনাভাইরাস গরীব মানুষের ক্ষতি করবে না। আমরা ভালো থাকব, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’

প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহর মতে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি দরকার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। তবে বস্তিবাসীদের জন্য এটা খুব কঠিন। তিনি বলেন, ‘যেহেতু প্রতিদিন তারা প্রচুর মানুষের সংস্পর্শে আসেন এবং ঘন বসতির মধ্যে থাকেন, তাই তাদের হাত, ঘর, ঘরের চারপাশ যতটা সম্ভব পরিষ্কার রাখা উচিত। কারণ, সেখানেও যদি কেউ আক্রান্ত হয় তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সিটি করপোরেশন সচেতনতা বাড়াতে দায়বদ্ধ। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা খাতে যে এনজিওগুলো কাজ করছে তারা এ সম্পর্কে প্রচারনা চালাতে পারে।’

নগর কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা

যোগাযোগ করা হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শরীফ আহমেদ জানান, ৭৫টি ওয়ার্ডে কমিশনার ও নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ প্রকল্পের (ইউপিএইচসিএসডিপি) পাঁচটি এনজিওর মাধ্যমে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ‘এ ছাড়াও সচেতনতা বাড়াতে উঠান বৈঠকের আয়োজন করা হচ্ছে।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মমিনুর রহমান মামুন জানান, তারাও ইউপিএইচসিডিপি প্রোগ্রামের পাঁচটি এনজিওকে লিফলেট বিতরণের নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা গত সপ্তাহে তাদের সঙ্গে বসেছিলাম এবং এই সপ্তাহে কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি। আশা করি তারা খুব শিগগির সব জায়গায় পৌঁছে যাবে।’

তবে, বস্তিগুলোতে গিয়ে এবং বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে সচেতনতামূলক কর্মসূচিগুলো তাদের কাছে পৌঁছাতে এখনও অনেক দেরী।

Comments