আশা, ফুটবল, করোনাভাইরাস এবং একজন ইয়োহান ক্রুইফ

cruyff
ছবি: সংগৃহীত

‘আমার বাবা ইয়োহান ক্রুইফ চার বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি আমাদের হৃদয়ে এবং মনের মধ্যে আছেন। প্রতিকূলতার মুখেও তিনি ছিলেন আশাবাদী, যা এই কঠিন সময়ে আমাদের খুব মনে পড়ছে।’

ইয়োহান ক্রুইফ কেবল একজন বিখ্যাত ফুটবলার বা কোচই ছিলেন না, ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। মঙ্গলবার ছিল নেদারল্যান্ডসের সাবেক এই তারকার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। তার স্মরণে স্প্যানিশ ক্রীড়া বিষয়ক দৈনিক ‘স্পোর্ত’- এ বিশেষ কলাম লিখেছেন তার ছেলে জর্দি ক্রুইফ।

প্রাণঘাতী মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে যখন গোটা বিশ্ব যখন স্থবির, তখন জর্দির ভীষণভাবে মনে পড়ছে তার বাবাকে, যিনি যে কোনো বিরুদ্ধ পরিস্থিতির ইতিবাচক দিক খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন এবং শেষ পর্যন্ত জয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।

জর্দি লিখেছেন, ‘আমার মনে আছে বাবা একদিন আমাদের সবাইকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন। কারণ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় তিনি যে ক্লিনিকে নিয়মিত চিকিৎসা নিতে যেতেন, সেখান থেকে বাসায় ফিরতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় নিচ্ছিলেন।

তিনি বাড়ি ফেরার পর আমার মা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কিছু ঘটেছে কি-না। ‘আমার কাছে সুসংবাদ আছে। তারা আরও একটি টিউমার খুঁজে পেয়েছেন,’ অট্টহাসি দিয়ে বলেছিলেন তিনি।

মা তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এটা কেমন ধরনের সংবাদ?’ উত্তরে বাবা শান্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, তারা এটা খুঁজে পেয়েছে এবং যেহেতু তারা এটা পেয়েছে, তারা এর চিকিৎসা দিতে পারবে এবং নিরাময়ের উপায় খুঁজে বের করতে পারবে।’

তার জায়গায় অন্য যে কোনো ব্যক্তি হলে পরাজিত অবস্থায় বাড়িতে ফিরত, কিন্তু আমার বাবা সবসময়ই যে কোনো আঘাতের ইতিবাচক দিক দেখার চেষ্টা করতেন। এমনকি, তিনি কেমোথেরাপিকেও তার সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করতেন।

তিনি বলতেন, ‘আমি জানি, পরে আমার খারাপ লাগবে, তবে আমি (ক্লিনিকে) যাব এবং এটাকে (কেমোথেরাপি) বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করব। কারণ এটা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাকে সহায়তা করছে।’

এই শান্ত আচরণ, এমনকি আমার বাবার আনন্দের বহিঃপ্রকাশও, তার চিকিৎসার সময় তাকে ঘিরে থাকা আরও বেশি হতাশাবাদী রোগীদের জন্য ছিল এক মরূদ্যান, আশার আলো।

আমার বাবা জন্মগতভাবে প্রতিকূলতার মুখেও আশাবাদী মানুষ ছিলেন। মাত্রাতিরিক্ত রকমের, অনেকে ভাবত। কিন্তু তিনি আসলে এমনই ছিলেন।

অনিশ্চয়তা আর হতাশায় মোড়ানো বর্তমান দিনগুলোতে, যেভাবে আমি সাধারণত নিজেকে জিজ্ঞাসা করি যখন আমার মনে সন্দেহ জাগে, সেভাবে আরও অনেকেই করতে পারে, ‘ইয়োহান থাকলে কী করতেন?’

অবশ্যই, অন্য অনেক কিছুর মতো তিনি এই কঠিন সময়ের ইতিবাচক দিকটি খুঁজতেন এবং পরবর্তীতে যে সমাধান বের করে নিয়ে আসতেন, তা আমাদের অবাক করে দিত।

আমি স্মৃতি হাতড়ালেই দেখতে পাই যে, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে বার্সেলোনার বাড়ির বারান্দায় বসে বাবা তার সবচেয়ে বড় দুটি শখের কাজ করে নিজেকে বিনোদন দিচ্ছেন: ধাঁধা এবং ক্রসওয়ার্ডস (শব্দজট)। কিংবা বাগানের জিনিসপত্র ঠিকঠাক করছেন।

আমি যে বিষয়ে নিশ্চিত তা হলো, কখনোই কোনো ঘটনা তাকে ভারাক্রান্ত করতে পারত না। কারণ অন্য সবার মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা তো দূরে থাক, এমনকি মোবাইল ফোন না থাকা সত্ত্বেও বিষণ্ণতা দূর করার নানা ধরনের গোপন কৌশল তার জানা ছিল।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তার ‘বাচ্চা’দেরকে দেখতে পেলে তিনি ব্যথিত হতেন। কারণ প্রতি সপ্তাহে খেলাধুলা অনুশীলন করা দুই লাখেরও বেশি শিশু-কিশোরকে, যাদের অনেকে প্রতিবন্ধী, ঘরে আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে। সাময়িকভাবে কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে ক্রুইফ ফাউন্ডেশন এবং ক্রুইফ কোর্টগুলো (মাঠ)।

কিন্তু সেদিনের কথা ভেবে তিনি হয়তো আবার আনন্দ খুঁজে পেতেন, যখন ‘বাচ্চা’রা সবাই আবার বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে। তিনি হয়তো ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তাদের জন্য একটি বিশাল অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করতেন।

বাবা আমাদেরকে ছেড়ে যাওয়ার পর যদি এমন কোনো কিছু থেকে থাকে যা আমাদের গর্বিত করে, তা হলো তিনি বেঁচে আছেন ক্রুইফ ফাউন্ডেশন, এফসি বার্সেলোনা এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের মধ্য দিয়ে।

মঙ্গলবার তার মৃত্যুর চার বছর পূর্ণ হয়েছে এবং তাকে স্মরণ করতে পুরো পরিবার মিলে আমরা যে বার্ষিক রাতের খাবারের আয়োজন করে থাকি, এবার আমরা তা পারছি না। এটা একেবারেই ব্যতিক্রম কারণ নিজেদেরকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখায় আমার মা, আমার ভাই-বোন এবং আমি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় আছি। আমরা হয়তো একে অপরকে ফোন করব এবং পরিস্থিতি অনুসারে সেরাটা চেষ্টা করব।

কিন্তু আমরা এই প্রতিকূলতার মুখোমুখি হব সাহসের সঙ্গে। আমরা জানি যে, একটা অনিশ্চিত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তা দূর হয়ে যাবে।

ইয়োহানও তা-ই করত।

Comments

The Daily Star  | English

Finance adviser sees no impact on tax collection from NBR dissolution

His remarks came a day after the interim government issued an ordinance abolishing the NBR and creating two separate divisions under the finance ministry

3h ago