অগ্নিঝরা মার্চের কথা কখনোই ভুলতে পারব না: ফকির আলমগীর

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গণসংগীত পরিবেশন করে আসছেন। পেয়েছেন একুশে পদক। ১৯৭১ সালে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারের একজন শব্দ সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন। ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা তিনি।
Farik Alamgir
ফকির আলমগীর। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গণসংগীত পরিবেশন করে আসছেন। পেয়েছেন একুশে পদক। ১৯৭১ সালে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারের একজন শব্দ সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন। ঋষিজ  শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা তিনি।

গুণি এই শিল্পী ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের স্মৃতিচারণ করেছেন ডেইলি স্টারের কাছে।

‘এখনো চোখে ভাসে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের স্মৃতি। কি করে ভুলি সেই স্মৃতি? যতদিন বাঁচব সেইসব স্মৃতি মনে পড়বেই। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ২৩, ২৪, ২৫ ও ২৬ মার্চ খুব কাছ থেকে দেখা। কেননা, তার আগে থেকেই আমি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ১৯৭১ সালে আমি জগন্নাথ কলেজে বিএ পরীক্ষার্থী ছিলাম। তখন তরুণ বয়স আমার। যুদ্ধে যাওয়ার মতো বয়স।’

‘২৩ মার্চ আমরা একটা বড় কাজ করে বসলাম। ওই দিন ঢাকাসহ সারাদেশে পাকিস্তানি পতাকা ফেলে দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়েছিল। আমরাও এই কাজটি করি ২৩ তারিখে। আমরা খিলগাঁওয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়াই। আমার বাসা তখন ছিল খিলগাঁওয়ে। এখনো সেখানেই।’

‘পতাকা উড়ানোয় বেশ সাড়া পাওয়া যায় সব দিক থেকে।’

‘২৪ মার্চ আমরা বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বেড়াই। সেখান থেকেও সবার কাছ থেকে সাড়া পাই। গণশিল্পী গোষ্ঠী ও ক্রান্তি শিল্পী গোষ্টীর হয়ে গান করি তখন।’

‘২৫ মার্চও সারাদিন সাংস্কৃতিক কাজ নিয়ে সময় কাটাই। আমরা কেউ কি জানতাম কি হবে ২৫ তারিখ রাতে? ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হায়েনারা আক্রমণ করে বসবে? কেউ জানতাম না। সন্ধ্যার পর বাসায় আসি। তারপর ঘুমিয়ে পড়ি।’

‘হঠাৎ শুনতে পাই গুলির শব্দ। ঘুমন্ত শহর জেগে উঠে। আমরাও জেগে উঠি। গুলির শব্দে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আমরা কোনরকম ঘর ছেড়ে বাড্ডা উলনের দিকে চলে যাই। ওই দিকটা তখন গ্রাম ছিল। সেখানে থাকি।’

‘২৬ ও ২৭ মার্চ কারফিউ ছিল। কারফিউ উঠে যাওয়ার পর ঢাকা শহর ছেড়ে অসংখ্য শরণার্থীর সঙ্গে বুড়িগঙ্গা পার হই। তারপর মাওয়ার ওদিক হয়ে ক্লান্ত পায়ে হাঁটি। কত ভয়, কত কষ্ট নিয়ে হাঁটতে থাকি। ভয় ছিল কখন মিলিটারি এসে মেরে ফেলে। তারপর টানা  হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি ফরিদপুরে। ফরিদপুরে এসে অনেক তরুণ বন্ধুদের পেয়ে যাই।’

‘তারপর আমরা তরুণরা মিলে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিই। এতে একটা বড় কাজ হয়। রাজাকাররা হাট-বাজার ও বাড়ি ঘর পোড়ানোর সাহস তেমন একটা পায় না। এভাবে সময় কাটাই আমরা মার্চ মাসজুড়ে।’

‘ফরিদপুরে স্থানীয় তরুণরা মিলে বেশ বড় একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলি। রাজাকাররা ভয় পেয়ে যায়। কয়েকমাস এভাবে কাটে।’

‘জুলাই মাসের দিকে যশোর বনগাঁ হয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাই কলকাতা। পথে পথে কতই না মৃত্যুর মিছিল দেখতে পাই। কলকাতায় তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হয়ে গেছে। কলকাতায় গিয়ে কাঁকরগাছীতে উঠি।’

‘স্বাধীন বাংলা বেতারে তখন কত আপনজন, কত চেনাজন। কামাল লোহানী, আবদুল জব্বার, কাদেরী কিবরিয়া, আপেল মাহমুদসহ কত প্রিয়জন। আমিও স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ শুরু করি। গান রেকডিং করি। সেই সব গান প্রচার করা হয়। তা শুনে মুক্তিযোদ্বারা অনুপ্রাণিত হন।’

‘কলকাতায় আমরা শরণার্থী শিবিরে গান গাওয়া শুরু করি। তারপর ওখানে আমরা বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী গঠন করি। আসলে তখন দেশের জন্য কাজ ও দেশকে মুক্ত করা ছাড়া কোনো চিন্তা মাথায় কাজ করেনি।’

‘স্বাধীন বাংলা বেতারের স্মৃতি বলে শেষ করা যাবে না। কলকাতার সবাই আমাকে শিল্পী হিসেবে চিনে যান। আমি গান দিয়েই জয় করি সবার মন। শরণাথী শিবিরে যখন গান করতাম, কী যে শান্তি পেতাম মনে।’

‘যাই হোক, অল্প কথায় সব বলা যাবে না। একদিন এক জায়গায় কোরাস গান করছিলাম। গানটি ছিল ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’। গান শেষ করার পর খবর এলো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কী যে শান্তি পেলাম। আনন্দে আমরা কেঁদে ফেললাম।’

‘আজও মার্চ মাস আসে বছর ঘুরে। খুব করে মনে পড়ে অগ্নিঝরা মার্চের উত্তাল দিনগুলোর কথা। অগ্নিঝরা মার্চের কথা কখনোই ভুলতে পারব না ‘

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago