ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশ

এখন আমরা একটি মহা ক্রান্তিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। পুরো পৃথিবী জুড়ে যে ভয়াবহ ভাইরাস ছুটে বেড়াচ্ছে, তা আমাদেরও গ্রাস করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের সঙ্গে বা মনুষ্য সৃষ্ট কোন দুর্যোগের এই পরিস্থিতির কোনো মিল নেই। এ আরও অনেক ভয়াবহ দুর্যোগ।
ছবি: প্রবীর দাশ

১৯৭৪ এর বন্যা। চারিদিকে হাহাকার, খাবারের অভাব, আশ্রয়ের অভাব। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগেই বন্যার থাবা পুরো দেশকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। তখন এত মিডিয়া ছিল না, ইন্টারনেটও ছিল না। দুএকটি পত্রিকা, রেডিও বাংলাদেশ আর বিটিভি যা খবর দিত তাই ছিল মানুষের তথ্য জানার উৎস। তাতেই বোঝা যাচ্ছিল অবস্থার ভয়াবহতা।

আসাদগেট নিউকলোনিতে ছিল আমাদের কলকণ্ঠ খেলাঘর আসর। কলোনির কিশোর-কিশোরীরা ছিলাম এর সদস্য। বন্যার সেই সময়টাতে আমরা খেলাঘরের উদ্যোগে ঠেলা গাড়িতে করে গান গাইতে গাইতে বের হয়েছিলাম বন্যার্তদের জন্য চাল, ডাল, আলু, ম্যাচ, কেরোসিন তেল এবং পুরনো কাপড় সংগ্রহ করার জন্য। আমরা সেই ছোট ছোট মানুষগুলো গেয়েছিলাম, ‘সর্বগ্রাসী বন্যারে তোর, নেইতো কোন মায়া। করাল গ্রাসে, গ্রাসে গেল বাংলা মায়ের কায়া।’ বন্যার ভয়াবহতা কী বা কতটা সেটা আমরা খুব একটা বুঝিনি, শুধু বুঝেছি আমাদের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। এইভাবে প্রায় কয়েকদিন আমরা বের হয়েছিলাম, মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাত পেতেছিলাম।

কলোনির বড় ভাই-বোনরা আমাদের গাইড করতেন। এর পাশাপাশি চাঁদের হাট, শাপলা শালুক সবাই যে যার মতো করে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। আমাদের উদ্যোগ ছিল সীমিত, প্রাপ্তিও ছিল কম। কিন্তু আমাদের অনুভূতি ছিল আকাশ সমান।

ধীরে ধীরে সময়ের আবর্তে পাড়া-ভিত্তিক এইসব শিশু ও তরুণ সংগঠনগুলো উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু এরপরও সেইসময়ে বড় হওয়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে পাড়া-ভিত্তিক সামাজিকতার কিছুটা রয়েই গিয়েছিল। আর সেই কারণেই ৮৮ এর বন্যার সময় আমরা আবার দেখেছি দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের ছাত্রছাত্রীরা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিল বন্যার্তদের সাহায্য করার জন্য। রানা প্লাজা ধ্বসের সময়ও আমরা দেখেছি সাধারণ মানুষ সমানতালে কাজ করেছে সকল পেশাজীবী ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। এর মানে এটাই প্রমাণ হয় যে এ দেশের সাধারণ মানুষ বিপদের সময় একসঙ্গে হতে পারে।

এখন আমরা একটি মহা ক্রান্তিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। পুরো পৃথিবী জুড়ে যে ভয়াবহ ভাইরাস ছুটে বেড়াচ্ছে, তা আমাদেরও গ্রাস করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের সঙ্গে বা মনুষ্য সৃষ্ট কোন দুর্যোগের এই পরিস্থিতির কোনো মিল নেই। এ আরও অনেক ভয়াবহ দুর্যোগ। এই শত্রু মানুষের অচেনা এবং এখন পর্যন্ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই মহামারি গ্রাস করেছে বিশ্বকে।

উন্নত বিশ্বেই অবস্থা বেগতিক। নিউইয়র্কের মতো জায়গায় ক্ষুধার্ত মানুষ গির্জার সামনে লাইন ধরে আছে খাবারের জন্য। গত এক সপ্তাহে ৩৩ লাখ আমেরিকান তাদের চাকরি হারিয়েছে এবং অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে। যুক্তরাজ্যেও চলতি সপ্তাহে ৩০ লাখ মানুষ সরকারি সুবিধা পাওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছে। এর অর্থ মানুষ দ্রুত কাজ হারাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে চিকিৎসা সুবিধা থাকার পরও দেদার মানুষ মারা যাচ্ছে করোনায়। অন্যদিকে সেসব দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম। সরকারি অনুদানের পরও বেকারত্ব বাড়ছে।

আমাদের দেশের অধিকাংশই মানুষই খেটে খায়। দিন এনে দিন খায়। করোনার কারণে তারা কাজ হারাতে বাধ্য হয়েছে। যদি ঢাকার কথাই ধরি, দেখব অগণিত মানুষ মুহূর্তে বেকার হয়ে গেছে। ফুটপাতের অসংখ্য খেটে খাওয়া মানুষ তাদের কাজ বন্ধ করে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এই মানুষগুলো করোনাকে ভয় পায় না, ভয় পায় দারিদ্র্যকে, ক্ষুধাকে, বেঁচে থাকার লড়াইকে। দৈনন্দিন আয় যাদের একমাত্র সম্বল তারা কোথায় খাবার পাবে, কোথায় সাবান পাবে, কে-ই বা তাদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা মাস্ক দেবে? আর চিকিৎসা সুবিধার কথাতো ছেড়েই দিলাম।

এই ছিন্নমূল, দরিদ্র মানুষ বা বিভিন্ন দোকানে, হোটেলে, অফিসে, মার্কেটে কাজ করা স্বল্প আয়ের মানুষগুলো শুধু জীবিকার প্রয়োজনে এই ভালোবাসাহীন শহরে পড়ে থাকে। সেই জীবিকার পথই যখন তাদের বন্ধ হয়ে গেছে, তখন তারা কেন এই শহরের পথে, অলিতে-গলিতে, বস্তিতে পড়ে থাকবে? তাই যখন সরকার ছুটি ঘোষণা করে সবাইকে ঘরে থাকতে বলল, তখনই তারা ছুটল তাদের ফেলে আসা ঘরের টানে। ঢাকায়তো আসলে তাদের কোনো ঘর নেই, নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। তাই আমাদের আশঙ্কা উপেক্ষা করে তারা ছুটে গেছেন গ্রামে।

এই ছুটে যাওয়ার ফল কী হতে পারে, তা তাদের কাছে মূল বিচার্য নয়। একজন ফেরিওয়ালা আমাকে বলল, ‘মা আমার বিক্রি না থাকলে এখানে পরিবার নিয়া খামু কী? তাই সবাই মিল্লা কালকে বাড়ি চইলা যামু।’ একইভাবে কথা বলল আমার পরিচিত একজন দোকান কর্মচারী। সে বলল ‘আপা আমরা চার জন সেলসম্যান একসঙ্গে থাকি। দোকানের মালিক বলছে সেও জানে না তার ব্যবসা চালাতে পারবে কি না। ঘর ভাড়া দিয়ে কিসের আশায় ঢাকায় পড়ে থাকব? তার চেয়ে গ্রামে যাই। শাক পাতা-তো পাব। আর সবাই বলতেছে আমরা গ্রামে গেলে ওদের বিপদ হবে। কিন্তু আমরাতো এখানেও কিছু বুঝতে পারতেছি না। আমাদের হাতে আর কোন উপায় নাই, বাড়িতে ফেরা ছাড়া।’

আরও একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলো। তার কথা অনুযায়ী তারা পরিবারের চার জন একটাই ঘরে থাকেন রাজধানীর বসিলা এলাকায়। সেই আধা পাকা বস্তিতে ১২টি পরিবার একটি বাথরুম ব্যবহার করে। একটা কলতলা সেখানে, গোসলের জায়গাও একটা, রান্নার জায়গাও একটা, তবে চুলা চারটা। যেহেতু তার ব্যবসা বন্ধ, তার স্ত্রীরও বাসাবাড়ির কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, কাজেই তাদের আর ঢাকায় থাকার কোন মানে নেই। দেশের বাড়ি নেত্রকোনায় চলে যাবে। আসলে এটাই আমাদের দেশের বাস্তবতা।

আমরা বলছি ঘরে থাকুন, সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে কিছুক্ষণ ধরে। এসব কথা এই মানুষগুলোর কাছে মূল্যহীন। আগে পেট ও মাথা গোজার ঠাঁই—তারপর সাবান, হাত ধোয়া। দেখলাম করোনা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই। সে প্রসঙ্গেও তার একটা মতামত আছে। বলল, তারা যেই বাসায় থাকে, সেই বাসার চারিদিকে ড্রেন। মাঝেমাঝে পচা পানির গন্ধে নাকি তাদেরই ঘুম আসে না। মশার অত্যাচারে মশারির বাইরে থাকা যায় না। সেখানে আর কোন রোগ এসে তাদের ধরবে। এদেশের অধিকাংশ খেটে খাওয়া মানুষের এই হচ্ছে মানসিকতা। যাদের ঢাকায় ঘরই নেই, তারা কোথায় ঢুকে নিজেকে বাঁচাবে?

কাজেই এদের পাশেই আমাদের দাঁড়াতে হবে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে আমরা কী করতে পারি, তা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর মধ্যে অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেছে। আমরা দেখছি আমাদের নেই চিকিৎসা সরঞ্জাম, নেই চিকিৎসকের সুরক্ষা, নেই মানুষের সচেতনতা, নেই ধনী মানুষের সাহায্য করার মানসিকতা।

চীনের উহানের লেইশেনশান হাসপাতালের মতো ঢাকার তেজগাঁওয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও আকিজ গ্রুপ যৌথভাবে। এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হবে। খুব দ্রুত কাজ শেষ হবে। খুব ভালো উদ্যোগ। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এখানে বাধা এসেছে। হাসপাতাল বানানোর বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে। দেশবাসীর এই কঠিন সময়ে, এমন মহৎ উদ্যোগের বিরোধিতা কারা করছেন, কেন করছেন? প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি।

যারা ছোট আকারে পিপিই বা কিট বানানোর চেষ্টা করছেন, তাদের উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন।

সরকার টাকা ও খাদ্য দেবে বলে কথা দিয়েছে দুস্থদের মাঝে। জানি না কীভাবে, কতদিনে এর বন্দোবস্ত হবে। কার ভাগ, কে খাবে তাও জানি না। গরিবের টাকা মেরেও খাওয়া সবচেয়ে সহজ। এদিকে গত শুক্রবারের খবর অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে সরকারিভাবে দুই লাখ ৮৫ হাজার পিপিই বিতরণ করা হয়েছে কিন্তু ডাক্তাররা বলছেন, তারা এসব পাননি। তাহলে গেল কই? আমাদের অভিজ্ঞতা বলে সরকারি উদ্যোগের অনেককিছুই কাগজে কলমে থাকলেও, বাস্তবে হাওয়া হয়ে যায়।

সেজন্যই সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ এরকম আপদের কালে বেশি কাজ দেয়। আমাদের ক্রিকেট তারকা মাশরাফি এগিয়ে এসেছেন। আরও অনেক তারকা আছেন আমাদের শিল্প জগতে, খেলার জগতে, সুশীল-বুদ্ধিজীবীদের জগতে। আছে বড় বড় পাঁচ তারকা হাসপাতাল, ধনী চিকিৎসকরা, পাঁচ তারকা হোটেল, গণমাধ্যমের মালিক, কর্পোরেট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও। তারা যদি সংঘবদ্ধ হয়ে এই দুর্যোগে পাশে দাঁড়ান তাহলেতো গরিব খেটে খাওয়া মানুষগুলোর এত দুশ্চিন্তা থাকে না, চিকিৎসা ব্যবস্থাও এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে না। সব প্রতিষ্ঠানকে বলি, কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন দিবস পালনের চেয়ে বিপদে টাকা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া অনেক জরুরি। শুনেছি কোনো কোনো কারখানা তাদের কর্মীদের বেতন ভাতা দেবে।

একজনের কথা দিয়ে লেখা শেষ করতে চাই যিনি ক্ষুধা পেটে রাস্তায় হাঁটতেন আর দেখতেন বিত্তবানরা দামী খাবার খাচ্ছে। তিনি তাকিয়ে থাকতেন, যদি কখনো একজন তাকে দেখে খাবার তুলে দেয়। কিন্তু কেউ দেয়নি। তিনি উপলব্ধি করতেন জন্মগত কারণে তিনি গরিব ও বঞ্চিত। আশেপাশের ধনী মানুষগুলোকে দেখে তিনি অবাক বিস্ময়ে ভাবতেন ওদের অনেক আছে, তবুও কেন ওরা আমাদের টেনে তুলছে না? খুব ছোট বয়সেই তিনি বুঝে যান ধনী-গরিবের বৈষম্য।

শারীরিক কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে স্কুলে কেউ তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেনি, পরিবারেও তিনি ছিলেন আলাদা, একাকী। কিন্তু পরে তিনি নিজের চেষ্টায় শিক্ষিত হয়েছেন, টাকাও কামিয়েছেন। এরপর জীবনের অর্থ খুঁজেতে তিনি পথে বের হন। মাত্র পাঁচ জনকে নিয়ে গড়ে তুলেন একটি সংগঠন। সেই সংগঠনটি আজ লাখ লাখ অভুক্ত, বঞ্চিত, আশাহীন মানুষের বেঁচে থাকার ভরসা, আশার প্রদীপ। জীবনের প্রতি তার কোন চাওয়া নেই। এই মানুষটি হলেন কিশোর কুমার দাস।

তার হাতে গড়া সংগঠনটির নাম বিদ্যানন্দ—এক টাকায় আহার দিচ্ছে দরিদ্র মানুষকে। করোনার কারণে বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। সেই সঙ্গে বস্তিতে বস্তিতে জীবাণু নিরোধক ওষুধ ছিটাচ্ছে। আমরা আজকে যদি সবাই যার যার সাধ্য মতো বিদ্যানন্দ বা এরকম একটি সংগঠনের পাশে দাঁড়াই, তাহলেই ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।

শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগকর্মী

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

3 quota protest leaders held for their own safety: home minister

Three quota protest organisers have been taken into custody for their own safety, said Home Minister Asaduzzaman Khan

12m ago