প্রবাসীর চোখে বৈশ্বিক করোনা সংকট
কোভিড ১৯। বিশ্ব জুড়ে এক আতঙ্কের নাম। বড় বড় শক্তিধর দেশগুলো আজ পরাজিত। অসহায়। এত এত অর্থ, অস্ত্র, গোলাবারুদ কোনো কিছু কাজে আসছে না। কোনো প্রযুক্তি কাজ করছে না। কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না মানুষের করুণ মৃত্যু।
স্মরণকালে পৃথিবী নামক গ্রহের মানুষগুলোকে এত অসহায়, এত শোচনীয় পরাজিত হতে আর কখনো দেখা যায়নি। এক মুহূর্তের মধ্যে ভেঙ্গে পড়েছে সব বন্ধুত্ব। কেউ কারো নয়। দীর্ঘদিনের বন্ধু রাষ্ট্র কোনো প্রকারের আলোচনা ছাড়াই বন্ধ করে দিচ্ছে দুয়ার। ঘরের ছেলেকে ঘরে তুলে নিতে দ্বিধা করছে দেশ, দ্বিধা করছেন আপন মানুষরা। সবাই যেন কিয়ামত দিবসের ‘ইয়া নফসি’ করছেন। এ এক অদ্ভুত সময়। অন্যরকম কাল।
কোথাও হিংসা নেই। বিদ্বেষ নেই। বারুদের নাকপোড়ানো গন্ধ নেই। কেউ কারো উপর আক্রমণ করছে না। বাহুশক্তির বড়াই হচ্ছে না। বাতাসে কার্বন নেই। পানিতে দুষণ নেই। কান ঝালাপালা করা গাড়ির শব্দ নেই। এ এক অন্যরকম পৃথিবী। আলাদা রকম বসুন্ধরা। অথচ কোথাও শান্তি নেই। স্বস্তি নেই। সুখ নেই। গোটা পৃথিবী যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে।
দিনে দিনে মানুষ বিরক্ত হচ্ছে অতি-স্বাধীনতার প্রতি। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক মানুষ ভাবতে শুরু করেছে মানুষের অতি স্বাধীনতা আজকের এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। গ্লোবাল ভিলেজ, মুক্তবাজার নামের চটকদার শব্দগুলো মানুষের কাছে অসহ্য হয়ে উঠছে।
বিশ্ব নেতারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। মানুষের স্বাধীনতায়, গণতান্ত্রিক অধিকারের হস্তক্ষেপ হবে বলে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, করোনা নামের মরণভাইরাস একটুও সময় নষ্ট করছে না। ঝাঁপিয়ে পড়ছে মানুষখেকো নেকড়ের মতো। এসব নিয়ে কথা হয় ক’জন চিন্তাশীল প্রবাসীর সঙ্গে।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ভয়েস অব আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল মাল্টিমিডিয়া জার্নালিস্ট সাফিউল আলম মাসুদ বলেন, ‘আমেরিকা পৃথিবীর সব থেকে বড় অর্থশক্তির দেশ। এ দেশের মানুষ ‘নেই’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত নন। আজ যখন বাজারে গিয়ে তারা দেখছে এটা নেই, ওটা নেই— তখনই তারা বড় ধরনের হোঁচট খাচ্ছে। ‘নেই’ শব্দের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হচ্ছে। মানসিকভাবে মানুষের পরাজয় হচ্ছে।’
তিনি মনে করেন, ‘করোনা সংকট একদিন ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু, এর দগদগে ক্ষত এই বিশ্বকে বহন করতে হবে অনেক দিন। অনেক বছর। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বসে যাবে। ছোট-ছোট ব্যাবসায়ীরা খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। মানুষের সামনে উঠে আসবে এক নতুন পৃথিবী। আজকেই এই ধাক্কা, এই সংকট বহন করতে হবে আমাদের পরের প্রজন্মকে। করোনা নামের এই সংকট পৃথিবীকে প্রায় ১৮০ ডিগ্রি পেছনে নিয়ে যাবে। যা হয়তো সাধারণ মানুষ এখনো অনুধাবন করতে পারছে না।’
তার মতে, ‘ওয়াশিংটন ডিসির অভিবাসীরা বেশ সুবিধাজনক জায়গায় আছেন। আমরা এখন ঘরে বসে কাজ করছি। আমাদের মতো অনেকেই ঘরে বসে অফিস করতে পারছেন। তারা ঘরে থেকে মাইনেও পাবেন। কিন্তু, সমস্যা হয়ে যাবে যারা দৈনিক বেতনের চাকরি করেন বা ছোটখাট কাজ করে জীবন নির্বাহ করেন।’
কথা হয় জার্মানি-প্রবাসী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মারুফ মল্লিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জার্মানির কথা আলাদা করে বলার কিছু নেই। গোটা ইউরোপ এখন অবরুদ্ধ। রাস্তাঘাট ফাঁকা। সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর পরেও আশার বিষয় হলো এখানে মানুষ ভালো চিকিৎসা পাবে, পাচ্ছে। জীবনের জন্য বড় ধরনের কোনো সংকটে পড়তে হবে না। কিন্তু, বাংলাদেশ নিয়ে কোনো আশার আলো দেখছি না। সরকার বলছে, করোনায় নতুন কেউ আক্রান্ত হয়নি, মারা যায়নি। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে মৃত ব্যক্তিদের বিশেষ ব্যবস্থায় দাফন করা হচ্ছে। তাদের রোগের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
‘কেউ কেউ অভিযোগ করছেন— বাংলাদেশে এখন সব থেকে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো কেউ চিকিৎসা পাচ্ছে না। দেশের কোথাও হাসপাতাল ক্লিনিকগুলো রোগীদের গ্রহণ করছে না। চিকিৎসা দিচ্ছে না। এমনকী করোনা লক্ষণের বাইরে অন্য রোগে আক্রান্তরাও চিকিৎসা পাচ্ছে না। দীর্ঘদিনের অসুখ বহণ করা মানুষগুলোও বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরছে বলেও অনেকে মন্তব্য করছেন।’
তিনি মনে করেন, ‘কোভিড ১৯ কোনো দেশের একক বা অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। বৈশ্বিক এই সংকট নিয়ে যদি বাংলাদেশের সরকার রাখঢাক করে সেটা হবে এবং হচ্ছে চুড়ান্ত ক্ষতির কারণ।’
মারুফ বলেন, ‘জার্মানিতে করোনার কারণে বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট শ্রমিক ও শিক্ষার্থীরা। লোকজন কমে যাওয়ায় রেস্টুরেন্ট থেকে শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজ না করলে যারা বেতন পাবেন না তারা আছেন বেশি দুশ্চিন্তায়। বেতন না পেলে এখানে মাসের খরচ ও দেশে অর্থ প্রেরণ নিয়ে ঝামেলা হবে বলে আশঙ্কা তাদের।’
‘এ পর্যন্ত জার্মানিতে ১০ জন অভিবাসী বাংলাদেশির করোনাক্রান্ত হওয়ার সংবাদ পাওয়া গিয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।
যুক্তরাজ্য-প্রবাসী জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী প্রিতম আহমেদ বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের মতো আমরাও মৃত্যুর খুব কাছাকাছি বসবাস করছি। এই বৈশ্বিক মহামারি থেকে আমরা কেউই দূরে নই। তবে সান্তনার বিষয় হচ্ছে যুক্তরাজ্যের সরকার দেশের প্রতিটি মানুষকে অত্যন্ত সচেতনভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছে। সব চেয়ে আতঙ্কে আছেন, বোধ করি, যে সব বাঙালিরা অবৈধভাবে বাস করছেন। তাদের রোজগার যেহেতু সীমিত হয়তো চিকিৎসা বা খাদ্য সহায়তার ক্ষেত্রে তাদের অসুবিধায় পড়তে হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আমার পরিবারসহ বাড়িতেই লকডাউন হয়ে আছি থেকে। দুশ্চিন্তার বিষয় একটাই তা হচ্ছে বাড়িতেও খাবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাইরেও কোথাও তেমন কিছু কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার বলছে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া এখন আর কিছু করার নেই।’
‘বাংলাদেশের সব সংবাদ দেখছি, খোঁজ-খবর রাখছি। কিছু পরিবারকে সহায়তার চেষ্টা করছি, তবুও দীর্ঘ সময় তাদের টিকে থাকা নিয়ে চিন্তা হয়,’ যোগ করেন তিনি।
ফ্রান্স-প্রবাসী সাংবাদিক নিয়াজ মাহমুদ বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পরই বাংলাদেশে আমার জন্ম। যুদ্ধ দেখিনি। তবে দেশে দেড় যুগের বেশি সাংবাদিকতা জীবনে কখনোই মনোবল হারাইনি। এখন অনেকটা বিমর্ষ সময় কাটছে। করোনায় আক্রান্ত প্রতিবেশী ইতালি ও স্পেনের মৃত্যুর মিছিলের পেছনে রয়েছে আমার অভিবাসন দেশ— ফ্রান্স।’
তিনি বলেন, ‘চারদিক থেকে একের পর এক অবস্থার অবনতির সংবাদ আসছে। এই পরিস্থিতিতে কুশলাদি জানতে চাইলে প্যারিসের বাংলাদেশি কমিউনিটির অতি পরিচিত মুখ নাজমুল হক আমাকে জানান— চারদিকে করোনায় আক্রান্তের সংবাদ ও মৃত্যুর মিছিল চলছে। বেঁচে আছি এখনো। জীবনটা বোনাস মনে হচ্ছে।’
নিয়াজ আরও বলেন, ‘ফ্রান্সের বাংলাদেশি কমিউনিটিও এখন আর নিরাপদে নেই। এখন পর্যন্ত অন্তত অর্ধশতাধিক আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুই জন প্রবাসী সাংবাদিক আক্রান্ত হলেও তাদের অবস্থা উন্নতির দিকে।’
‘আশার কথা হলো— করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে ক্লোরোকুইন ও হাইড্রোক্সি ক্লোরোকুইন ব্যবহারে ইতিবাচক ফল পাওয়া গিয়েছে এবং তা প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে ফরাসি সরকার। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের বলা হয়েছে শ্বাসকষ্ট না হলে হাসপাতাল না যেতে। পাশাপাশি চীনের আদলে বড় হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে,’ যোগ করেন নিয়াজ।
‘এখানে আমরা যারা বাংলাদেশি আছি, খাবারদাবার নিয়ে এখনো খুব বেশি বিপাকে না পাড়লেও ভয় কাজ করছে সবার মধ্যে। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শুধুমাত্র ওষুধ ও খাবারের দোকান খোলা থাকবে।’
প্রবাসী সাংবাদিক ও ইউরো ভিশন নিউজ এর সম্পাদক এম. এ. মান্নান আজাদ বলেন, ‘একটি পরিবারে থেকে প্রথমে ছেলে ও পরে তার বাবাও করোনায় আক্রান্ত হন। ছেলে সুস্থ হলেও বাবার অবস্থা এখন অবনতির দিকে। এছাড়াও প্যরিসের একটি ব্যাচেলর বাসায় একজনের মাধ্যমে বাসার অন্য ১০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। পুলিশ সংবাদ পেয়ে তাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়েছে।’
মান্নান বলেন, ‘এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতেও করোনাভাইরাস ফ্রান্সের লিয়ন শহরের সিলেট থেকে আসা এক প্রবাসীর আকদ রুখতে পারেনি। গত শুক্রবার টেলিফোনে বিয়ে হয়েছে তাদের।’
বেলজিয়াম-প্রবাসী ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমরাও লকডাউনের মধ্যে আছি। অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। সচেতন মানুষরা ঘরের বাইরে বের না হলেও অনেকে তা মানছে না। ঘরবন্দি হয়ে থাকতে চাইছেন না।’
‘এতদিন আমরা মনে করতাম শুধুমাত্র এশিয়ানরা আইনকানুন মানতে চায় না, বেয়াড়াপনা করে। এখন দেখছি বহু ইউরোপিয়ানও নিয়ম-কানুনের ধার ধারতে চায় না। তারা দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ বাধা দিলে কোথাও কোথাও পুলিশের উপর চড়াও হতেও দেখা গেছে। সব থেকে অবাক বিষয় হলো- বেলজিয়ামে যখন প্রথম লকডাউন ঘোষণা করা হয় তরুণ-যুবকরা দল বেঁধে লকডাউন পার্টি করতে শুরু করে। তাদের কাছে এটা একটা উৎসবের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।’
তিনি আরও জানান, লকডাউন পার্টিওয়ালাদের দৌরাত্ব এতবেশি হয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত এটা নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছে। তরুণ-যুবকদের বাধা দিতে গেলে তারা বলে করোনাভাইরাসে বয়স্করা আক্রান্ত হয়, যুবকরা হয় না। কেউ কেউ বলে— পুলিশ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে। এসব কথা বলে তারা পুলিশের গায়ে থুতু ছিটায়। বাধ্য হয়ে সেসব পুলিশকেও কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে হয়েছে।
আজিজ বলেন, ‘ইউরোপ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো মানুষের অতি-স্বাধীনতা। এখানে মানুষের স্বাধীনতা ভোগ এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে এখন তাদের ঘরে আটকে রাখা অনেকটা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিকরাও সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় নষ্ট করে ফেলছেন। আর ততদিনে সংক্রমণ মহামারি আকার ধারণ করছে।’
আরও পড়ুন:
ইতালিতে করোনায় আরও এক বাংলাদেশির মৃত্যু, দূতাবাসের ‘তথ্য দেওয়া মানা’
Comments