করোনাভাইরাস মহামারি ঠেকানো সম্ভব ছিল: নোয়াম চমস্কি

পুরো বিশ্ব করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এমন ভয়ংকর ভাইরাসটির সংক্রমণ চাইলেই ঠেকানো যেত বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন বুদ্ধিজীবী ও লেখক নোয়াম চমস্কি।
Noam Chomsky
নোয়াম চমস্কি। ছবি: সংগৃহীত

পুরো বিশ্ব করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এমন ভয়ংকর ভাইরাসটির সংক্রমণ চাইলেই ঠেকানো যেত বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন বুদ্ধিজীবী ও লেখক নোয়াম চমস্কি।

নোয়াম চমস্কির মতে ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধ করার জন্য বিশ্বের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল। এছাড়াও এই মহামারি শেষ হলে বিশ্ব পারমাণবিক যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে তিনি সতর্ক করেছেন।

নিজ কার্যালয়ে সেল্ফ আইসোলেশনে থাকা ৯১ বছর বয়সী নোয়াম চমস্কি ক্রোয়েশিয়ার দার্শনিক ও লেখক সার্কো হর্ভাটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে করা জন্স হপকিনস ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটির ‘ইভেন্ট ২০১’ গবেষণার বরাত দিয়ে নোয়াম চমস্কি বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারি ঠেকানো যেত, এটি ঠেকানোর মতো তথ্য ছিল। এটা তো বেশ পরিচিতও ছিল। আসলে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ঠিক আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে এনিয়ে ব্যাপক কাজও হয়।’

চমস্কি বলেন, ‘তবে কিছুই করা হয়নি। আসন্ন বিপদের কথা জানার পরও সংকট আরও জটিল হয়েছে রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে এসব তথ্যের দিকে নজর না দেওয়ায়।’

চমস্কি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘৩১ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে চীন অজানা উৎস থেকে আসা নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগের বিষয়ে তথ্য জানায়। এর এক সপ্তাহ পর চীনা বিজ্ঞানীরা একে করোনাভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করেন। এরপর তারা এটি নিয়ে আরও গবেষণা করেন এবং তথ্য জানাতে থাকেন। তবে সেসময় ভাইরাস বিজ্ঞানীরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সেসব প্রতিবেদনে খুব একটা পাত্তা দেননি। তারা কেউ কি কিছু করেছেন? বলতে গেলে, কেউ কেউ করেছেন।

চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর কাজ শুরু করেছিল এবং করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকে এই দেশগুলো পরিস্থিতি মোটামুটি সামলে নিতে পেরেছে।’

সংকট মোকাবিলায় পশ্চিমা দেশগুলোর নেওয়া ব্যবস্থা সম্পর্কে চমস্কি বলেন, ‘ইউরোপে কিছু ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছে। জার্মানি রোগ নির্ণয়কেন্দ্রের সক্ষমতা বাড়িয়েছে এবং অনেকটা স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা চালিয়েছে।

অন্য দেশগুলো কিছুই করেনি। যুক্তরাজ্যের অবস্থা খুব খারাপ এবং সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের।’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করে চমস্কি বলেন, ‘একদিন বললেন, “এটা কোনো সংকটই না। এটি সাধারণ ফ্লুর মতো।” পরের দিন, “এখন ভয়াবহ সংকটপূর্ণ সময় এবং আমি এর সবই জানতাম।” এর পরের দিন, “আমাদের সবাইকে কাজে ফিরতে হবে। কারণ, আমাকে নির্বাচনে জিততে হবে।” বিশ্ব যে এমন মানুষদের হাতে পরিচালিত হচ্ছে তা অবাক করার মতো।’

ট্রাম্পকে ‘বিকারগ্রস্থ’ আখ্যা দিয়ে চমস্কি বলেন, ‘করোনাভাইরাস গুরুতর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। আমরা এমন এক বিপর্যয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌঁড়াচ্ছি, যা মানবজাতির ইতিহাসে এখন পর্যন্ত আর আসেনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার সঙ্গীরা এই দৌঁড়ের নেতৃত্ব দিয়ে পরিস্থিতি আরও রসাতলে নিয়ে যাবে। এমনকি, আমরা বড় দুটি হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছি, একটি পারমাণবিক যুদ্ধ অপরটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্রমবর্ধমান হুমকি।’

করোনাভাইরাসের ভয়াবহ পরিস্থিতি একসময় স্বাভাবিক হলেও অন্যান্য হুমকির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ থাকবে না, সব শেষ হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন চমস্কি।

করোনাভাইরাসে ইরানে তিন হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এমন দুর্যোগকালীন সময়েও ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্পের সমালোচনা করে চমস্কি বলেন, ‘এই একটা মাত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেই এটি করা সম্ভব। অন্যান্য দেশ তা মেনে চলতে বাধ্য। তা না হলে তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বের করে দেওয়া হবে।’

মাহামারির পর কেমন হবে বিশ্বের অবস্থা?

এই বিষয়ে গত ২৮ মার্চ ক্রোয়েশিয়ার দার্শনিক ও লেখক স্রেকো হরভাটের সঙ্গে অনলাইনের আলাপচারিতা প্রকাশ করা হয় আল জাজিরায়। এই আলাপচারিতায় স্লোভেনিয়ার দার্শনিক স্লাভোজ জিজেক এবং জার্মান-ক্রোয়েশিয়ান থিয়েটার পরিচালক ও লেখক অ্যাঞ্জেলা রিখরও অংশ নিয়েছিলেন।

সেখানে চমস্কি বলেন, ‘মানুষ এখন চিন্তা করবে যে আমরা কেমন পৃথিবী চাই, এটা করোনাভাইরাসের একটা ভালো দিক হতে পারে। সংকটের গুরুত্ব বুঝতে হবে আমাদের, ভাবতে হবে কেন এই করোনাভাইরাস সংকট? এটি বাজারের এক বিরাট ব্যর্থতা। মহামারিটি খুব কাছাকাছি জেনেও একে খুবই হালকাভাবে নেওয়া হয়েছে। ১৫ বছর আগের সার্স ধরন পাল্টে করোনাভাইরাস মহামারিতে রূপ নেবে, এটা খুব ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছিল। ওই সময় সমস্যা সমাধান করা গিয়েছিল। ভাইরাস চিহ্নিত করা হয়েছিল, ভ্যাকসিনও বের হয়েছিল।’

‘বিশ্বজুড়ে ল্যাবগুলো তখনই করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় কাজ করতে পারত। কেন করেনি? বাজার ভুল ইঙ্গিত দিয়েছিল। বিশেষ করে ওষুধ কোম্পানিগুলো। আমরা আমাদের ভাগ্য স্বৈরশাসকের মতো করপোরেশন নামক প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর হাতে দিয়ে রেখেছি, যারা সাধারণ মানুষের কাছে দায়বদ্ধ নয়। তাদের জন্য মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা ভ্যাকসিন বের করার চেয়ে শরীরে মাখার ক্রিম বানানো বেশি লাভজনক।’

যুক্তরাষ্ট্রে পোলিও মহামারির কথা মনে করিয়ে চমস্কি বলেন, ‘সেই মহামারি আটকানো গিয়েছিল সাল্ক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ফলে, যা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান আবিষ্কার করেছিল। ১৯৫০ সালের শুরুর দিকে এটি বাজারে সহজলভ্য হয়। এর কোনো পেটেন্ট নেই, সবার জন্য উন্মুক্ত, যা এবারও সম্ভব।’

বর্তমান সময়কে দেখা হচ্ছে যুদ্ধকালীন সময় হিসেবে, যেখানে চিকিৎসকরা সম্মুখ যোদ্ধা। জাতিসংঘের মহাসচিব এই সময়কে বর্ণনা করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে ভয়াবহ সময় হিসেবে। যুদ্ধ ছাড়াই পৃথিবীকে যুদ্ধকালীন সময়ের মতো বিবেচনা করাকে কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে চমস্কি জানান, জনগণকে সংগঠিত করার জন্য এটি ঠিক আছে।

Comments

The Daily Star  | English

Displaced bearing pad disrupted metro rail service: DMTCL official

Both local and Japanese workers and engineers were seen working to lift the pad back onto the pier

58m ago