একেক দেশে একেক রূপ, বিশ্বে ছড়াচ্ছে ৩ ধরনের করোনাভাইরাস

নতুন করোনাভাইরাস ‘কোভিড-১৯’ এর উৎস ও গতিপ্রকৃতি জানতে হলে এর বিবর্তন জানা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানিয়েছে, গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত ১৬০টি ভাইরাল জিনোম পরীক্ষা করে মানবদেহে সংক্রমণের সময় ‘কোভিড-১৯’ এর বিবর্তন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন কয়েকজন গবেষক।
গবেষণায় কোভিড-১৯ এর তিনটি সংস্করণ শনাক্ত হয়েছে।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা দলটির প্রধান পিটার ফরস্টার বলেন, ‘দ্রুত মিউটেশনের মাধ্যমে কোভিড-১৯ পরিবারটি তিন মাসে অনেক ডালপালা ছড়িয়েছে। স্পষ্টভাবে তাদের শনাক্ত করা বেশ কঠিন। আমরা গাণিতিক নেটওয়ার্ক অ্যালগারিদম ব্যবহার করে ‘কোভিড-১৯’ এর ডালপালা সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ধরনের কৌশল সাধারণত ডিএনএর মাধ্যমে প্রাগৈতিহাসিক সময়ে মানুষের গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ের জন্য পরিচিত। আমরা মনে করি, এই প্রথম কোভিড-১৯ এর মতো কোনো ভাইরাস সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে।’
কোভিড-১৯ এর তিন ধরনের সংস্করণকে তারা টাইপ- এ, বি ও সি নামে চিহ্নিত করেছে।
গবেষকরা জানান, টাইপ-এ করোনাভাইরাসের সঙ্গে বাদুড়ের দেহে পাওয়া ভাইরাসের অনেকটা মিল রয়েছে। তবে, চীনের উহান শহর, যেখানে প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে সেখানে টাইপ-এ কোভিড-১৯ ব্যাপকহারে ছড়ায়নি।
উহানে থাকা এক মার্কিন নাগরিকের দেহে টাইপ-এ কোভিড-১৯ পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ার কয়েকজন আক্রান্তের মধ্যেও টাইপ-এ ভাইরাস পাওয়া যায়।
কোভিড-১৯ এর সাধারণ রূপটি হলো টাইপ-বি। গবেষকরা বলছেন, উহানে মূলত টাইপ-বি’র সংক্রমণ ঘটেছে। তবে, পূর্ব এশিয়ার বাইরে অন্যান্য দেশে টাইপ-বি’র সংক্রমণ তেমনটা ঘটেনি। হতে পারে, উহানের কঠোর প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে টাইপ-বি ভাইরাস এই অঞ্চলের বাইরে যেতে পারেনি।
অন্যদিকে, টাইপ-সি’র সংক্রমণ ঘটেছে ইউরোপে বিভিন্ন দেশ যেমন ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন ও ইংল্যান্ডে। চীনের মূল ভূখণ্ডের রোগীদের কারো শরীরে টাইপ-সি কোভিড-১৯ পাওয়া যায়নি। তবে, সিঙ্গাপুর, হংকং ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্তদের কয়েকজনের শরীরে তা পাওয়া গেছে।
গবেষকরা বলছেন, টাইপ-এ’র সঙ্গে বাদুড় ও বনরুইয়ের শরীরে পাওয়া ভাইরাসের মিল আছে। দুই বার মিউটেশনের পর টাইপ-এ থেকে টাইপ-বি’তে পৌঁছেছে কোভিড-১৯। অন্যদিকে, টাইপ-সি অনেকটা টাইপ-বি’র সন্তানের মতো।
ফরস্টার বলেন, ‘উহানে টাইপ-বি ভাইরাস পরিবেশগভাবে অভিযোজনের মাধ্যমে কিংবা ভাইরাসের দৃঢ় প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে পূর্ব এশিয়ার মানুষের শরীরে ছড়িয়েছে। প্রাথমিকভাবে পূর্ব এশিয়ায় যতো দ্রুত এই ভাইরাসের মিউটেশন হয়েছে অন্যান্য অঞ্চলে সেভাবে হয়নি।’
গবেষণায় মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের সময় ভাইরাসের গতিপ্রকৃতির পরিবর্তনের কথাও বলা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইতালিতে সংক্রমণের শুরুর দিকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি একজন মেক্সিকান পর্যটকের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। তিনি মিউনিখের এক জার্মান নাগরিকের কাছ থেকে সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারেন। ওই জার্মান নাগরিক গত ২৭ জানুয়ারি করোনায় আক্রান্ত হন। এক চীনা সহকর্মীর সংস্পর্শে ওই জার্মান নাগরিক সংক্রমিত হয়েছেন। তার চীনা সহকর্মী উহানে পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটিয়ে কাজে যোগ দিয়েছিলেন।
উহান থেকে মেক্সিকোতে ছড়ানোর সময় কোভিড-১৯ এর দশবার মিউটেশন হয়েছে বলে পরীক্ষায় উঠে এসেছে।
ফরস্টার বলেন, ‘মানবদেহে সংক্রমণের শুরু থেকে ভাইরাসটি কতোবার গতিপ্রকৃতি বদল করেছে তা যেহেতু আমরা কিছুটা হলেও শনাক্ত করতে পেরেছি, তাই এই প্রক্রিয়ায় পরিসংখ্যানের তত্ত্ব প্রয়োগ করে ভবিষ্যতে সংক্রমণ কমানো যেতে পারে। কোভিড-১৯ ভবিষ্যতে আবার ফিরে আসলেও সেটাকে দমন করা যেতে পারে।’
সান ইয়াত-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিশেষজ্ঞ লু জিয়াহাই জানান, এই গবেষণায় কোভিড-১৯’র জিনোম পরিবর্তনের প্রাথমিক বিশ্লেষণ উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, ‘শারীরিক গঠনে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়েছে। এটি মানবদেহে আরও বেশি খাপ খাইয়ে নিয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে। তবে, কোভিড-১৯ এর টাইপগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কতোবার, কতো সময়ের মধ্যে মিউটেশন হয়েছে তা সঠিকভাবে জানতে পারলে ভাইরাসটি উৎস সম্পর্কে জানা যাবে।’
লু আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী এই মহামারিকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। মানুষের উচিত ভাইরাসটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। এটি অত্যন্ত শক্তিশালী ভাইরাস। দীর্ঘসময় পর্যন্ত এটি একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে দ্রুতগতিতে সংক্রমিত হতে পারে।’
Comments