করোনা মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ যথাযথ ছিল না: গবেষণা প্রতিবেদন
দেশে করোনা মহামারী প্রাদুর্ভাবের পর থেকে নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নেওয়া সরকারি পদক্ষেপ যথাযথ এবং বিশ্বাসযোগ্য ছিল না বলে মত দিয়েছেন দেশের সাত জন গবেষকের একটি দল।
গত ১ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল, ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১২টি জাতীয় দৈনিক এবং অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা এবং সমালোচনার ভিত্তিতে ‘করোনাকালীন মানবাধিকার পরিস্থিতি’ গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
গবেষণাটি করেন আনু মুহাম্মদ (শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়), শহিদুল আলম (আলোকচিত্রী), ফরিদা আক্তার (নারী অধিকার আন্দোলন কর্মী), জ্যোতির্ময় বড়ুয়া (আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট), রুশাদ ফরিদী (সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সাইদিয়া গুলরুখ (গবেষক ও সাংবাদিক) ও রেজাউর রহমান লেনিন (গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী)।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রথম কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এই মহামারী প্রতিরোধের প্রস্তুতিতে অন্তত দুই মাস সময় পেলেও এই সময়টাতে সরকার যথাযথ সাড়া দেয়নি এবং প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্য, কৃষি, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন খাতের অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই গবেষণাপত্রে।
দেশের স্থল-জল-বিমান বন্দরগুলোতে চলাচলের ক্ষেত্রে নূন্যতম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ করা হয়েছে বলেও এতে অভিযোগ করা হয়।
অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা
গবেষণা প্রতিবেদনে আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল বলে সমালোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, এই মুহূর্তে শুধু করোনার জন্য নিবেদিত আইসিইউ প্রস্তুত রাখা আছে ১০০ থেকে ১৫০টি। গবেষকেরা বলছেন, সংক্রমণের চতুর্থ পর্যায়ে আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য যা যথেষ্ট নয়।
স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য যথাসময়ে পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) সরবরাহ করা হয়নি বলেও এতে জানানো হয়।
গবেষণায়পত্রে বলা হয়েছে, মার্চের ৮ তারিখ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর লক্ষণ নিয়ে অন্তত ১৩০ জন মারা গেছে। এই মৃত্যুগুলোকে ‘নিউমোনিয়া’, ‘সাধারণ জ্বর’ ও শ্বাসকষ্ট’, কিংবা ‘হার্ট অ্যাটাক’ বলা হয়েছে। এমনকি হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার নজিরও আছে।
করোনা পরীক্ষা নিয়ে টাল বাহানা
গবেষকেরা বলেন, করোনা নির্ণয় পরীক্ষা নিয়ে টাল বাহানা করা হয়েছে। শুরু থেকেই রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর ১ হাজার পরীক্ষার সক্ষমতা থাকলেও তা করা হয়নি উল্লেখ করে এতে বলা হয়, ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ৮৩১৩ জনের কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হয়েছে।
পরীক্ষার পুরো বিষয়টি সরকার শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে, এমনকি সরকারি অন্য সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করার অভিযোগ করেছেন গবেষকরা। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বল্প খরচের টেস্ট কিট তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে বলে উঠে এসেছে গবেষণায়।
বলা হয়, গণস্বাস্থ্যের কিট তৈরিতে বাধা দেয়া হলেও, বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া সরকারি দলের নেতারা অবৈধভাবে চীন থেকে অনির্ভরযোগ্য টেস্টিং কিট আমদানি করে বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করেছেন।
কৃষিখাতে দুর্যোগের আশঙ্কা
সারাদেশে প্রায় লকডাউন পরিস্থিতিতে কৃষিখাত ভয়ংকর দুর্যোগের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে উল্লেখ করে গবেষণায় বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব ঘটবে বলে আশঙ্কা জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, ঘরবন্দি মানুষ কিভাবে খাদ্য পাবে কিংবা কিনবে তার কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নাই।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী, গত ৫ এপ্রিল ৭২,৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, কিন্তু কৃষি ও কৃষকের জন্য আলাদা করে কোন প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মুখে, অনেক দেরিতে হলেও, ১২ এপ্রিল কৃষি ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার ‘প্রণোদনা তহবিল’ করার ঘোষণা দেয়া হয় উল্লেখ করে গবেষণায় প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে, এটি আসলে কতটা প্রণোদনা আর কতটা ঋণ এবং তার কত অংশ আসলে কৃষকরা পাবেন?
অমানবিক অবহেলার শিকার শ্রমিকেরা
করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ ছুটির মধ্যে গার্মেন্টস, চা শ্রমিকসহ বিভিন্ন খাতে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয় এই গবেষণায়।
পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে সরকার এবং মালিকেরা মিলে ‘পিংপং’ বলের মতো একবার ঢাকা থেকে বাইরে ও পরে বাইরে থেকে ঢাকাতে ছুঁড়ে ফেলার যে দৃষ্টান্ত রেখেছে তা ‘অমানবিক ও নিষ্ঠুর’ ছিল বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।
মানবিক সহায়তা তছরুপ
করোনার সময়ে মানবিক সহায়তা তছরুপ, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং এ প্রক্রিয়াতে স্বচ্ছতা নেই উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়েছে, ৬৪ জেলায় সরকার চার দফায় ৬৫ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন চাল এবং ২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং শিশুখাদ্যের জন্য তিন কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে কিন্তু এগুলো কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে তা নিয়ে কোন সরকারি ঘোষণা নেই।
সহায়তা নিয়ে দুর্নীতিকারীদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর শাস্তির হুঁশিয়ারী সত্ত্বেও বিভিন্ন জেলায় চাল চুরি, ত্রাণ দেয়ার ছবি তুলে আবার ত্রাণ কেড়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার সাথে জড়িত প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের সদস্য বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে।
সংক্রমণ মোকাবিলায় যেসব আইনের প্রয়োগ করা হয়েছে তার অধিকাংশই কোন সুনির্দিষ্ট আইনের মধ্যে পড়ে না বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই ‘তথ্য প্রবাহ রোধ করার উদ্দেশ্যে চিন্তা, বিবেক, ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বাংলাদেশ সরকার আঘাত করছে’।
এছাড়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির সুরক্ষা এবং পাহাড়ে হাম পরিস্থিতির বিষয়েও উদ্বেগ জানানো হয় এ গবেষণা প্রতিবেদনে।
Comments