করোনা পরীক্ষা করবে কারা, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদে নিয়োগ নেই ১১ বছর

করোনাভাইরাসের পরীক্ষা পর্যাপ্ত হচ্ছে কী না, টেস্টিং কিটের স্বল্পতা আছে কি নেই, পর্যাপ্ত ল্যাব হয়েছে কী না, তা নিয়ে শত আলোচনার ফাঁকে একটি প্রশ্ন- এই পরীক্ষা করবে কারা?
Ministry Of Health-1.jpg
ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাসের পরীক্ষা পর্যাপ্ত হচ্ছে কী না, টেস্টিং কিটের স্বল্পতা আছে কি নেই, পর্যাপ্ত ল্যাব হয়েছে কী না, তা নিয়ে শত আলোচনার ফাঁকে একটি প্রশ্ন- এই পরীক্ষা করবে কারা?

প্রশ্ন ওঠার কারণ, রোগ নির্ণয়ে যারা পরীক্ষা করবেন, সেই মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ১১ বছর ধরে নিয়োগই বন্ধ। যারা আছেন, তারাও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ অনুযায়ী যেখানে প্রতি চিকিৎসকের বিপরীতে ৫ জন করে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকা উচিত, সেখানে বাংলাদেশে এই হার প্রতি চারজন চিকিৎসকের বিপরীতে একজন। আর প্রতি ১০ হাজার মানুষের বিপরীতে শূন্য দশমিক ৩২ জন।

সর্বশেষ হেলথ বুলেটিনের (নভেম্বর, ২০১৮) তথ্য বলছে, বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদ রয়েছে ৭ হাজার ৯২০টি। কিন্তু আছেন ৫ হাজার ১৮৪ জন। ২ হাজার ৭৩৬টি পদে কোনো লোকবল নেই। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ফার্মেসি) পদ সবচেয়ে বেশি ফাঁকা রয়েছে। এর পরই রয়েছে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) এর পদ।

বুলেটিনের তথ্য অনুযায়ী, ২ হাজার ২৩৭টি পদের বিপরীতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) আছেন ১ হাজার ৪৮৮ জন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেডিকেল টেকনোলজি বিষয়ে কে পড়াবে— স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে এই টানাপড়েনেই কেটে গেছে ১১ বছর। এর মধ্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয়দের দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে, নতুন দুটি আইন হয়েছে, উচ্চ আদালতে মামলা চলেছে, রায়ও হয়েছে সাড়ে তিন বছর আগে— কিন্তু হয়নি শুধু নিয়োগ।

ফলে বর্তমানে করোনাভাইরাসের এই সংক্রমণের মধ্যে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট ১৭টি ল্যাবরেটরিতে দিনে সাড়ে চার হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা থাকলেও করা সম্ভব হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ল্যাবরেটরির সক্ষমতার বেশিরভাগই অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।

মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে গত বছরের ১৯ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রইছ উদ্দিনকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ২ ডিসেম্বর ওই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডকে তাদের আইন সংশোধন ও ভর্তি বন্ধ করতে বলে।

কমিটি জানায়, ওয়ান আম্রেলা কনসেপ্ট বাস্তবায়ন করতে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আইন সংশোধনের পর ‘বাংলাদেশ এলাইড হেলথ শিক্ষা বোর্ড’ গঠন করে স্বাস্থ্য শিক্ষার সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে এর অধীনে নিয়ে আসা হবে।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি কারিগরি বোর্ড এক বিজ্ঞপ্তিতে ভর্তি বন্ধ ঘোষণা করে। বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মোরাদ হোসেন মোল্লা ওইদিনই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এক চিঠিতে আইন সংশোধন করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠান। কিন্তু এখন পর্যন্ত গেজেট প্রকাশিত হয়নি।

বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব মো. সেলিম মোল্লা সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জনস্বার্থে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা প্রায় ১৫ হাজার বেকার মেডিকেল টেকনোলজিস্টকে (ল্যাবরেটরি) এ কাজে নিযুক্ত করলে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সহজ হবে।’

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘করোনা রোগী শনাক্তকরণে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করার জন্য সরকারি পর্যায়ে কমসংখ্যক জনবল দিয়ে কোনো অবস্থাতেই কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।’

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান খান। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের লোকবল সংকট রয়েছে। এখন পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহে বেশ চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে। সেজন্য অনলাইনের মাধ্যমে আমরা স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাচ্ছি।’

কেন নিয়োগ আটকে ছিল

আন্তঃমন্ত্রণালয়ের ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৫ সালে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেডিকেল টেকনোলজি পড়ানো শুরু হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর বহু আগে থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের অধীন কোর্সটি পরিচালিত হচ্ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এই দ্বন্দ্ব নিরসনে ২০০৭ সালের আগস্টে তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধিরা এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘ওয়ান আম্রেলা কনসেপ্ট’র আওতায় মেডিকেল টেকনোলজি কোর্স পরিচালিত হবে।

কিন্তু গোল বাধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৩ সালের এক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে। সেখানে বলা হয়, এই পদে নিয়োগ পেতে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ থেকে তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করতে হবে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ডিগ্রি নেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন।

বিপরীতে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ থেকে ডিপ্লোমা করা শিক্ষার্থীদের কয়েকজন তৃতীয় পক্ষ হিসেবে মামলায় অংশ নেন। বন্ধ হয়ে যায় নিয়োগ। ২০১৬ সালের মে মাসে হাইকোর্টের রায়ের পর ২১ নভেম্বর আপিল বিভাগের রায় দেন। এরপরও আরেকটি রিট হয়। আদালত কারিগরি বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশ করা ‘ওয়ান আম্রেলা কনসেপ্ট’ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন।

এরপরই আন্তঃমন্ত্রণালয়ের নতুন এই কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি জানায়, উচ্চ আদালতের রিট চলাকালে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি আইন এবং ২০১৮ সালে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরস্পর সাংঘর্ষিক দুটি আইন হয়। ‘ওয়ান আম্রেলা কনসেপ্ট’ বাস্তবায়ন করতে আগে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আইন সংশোধন করতে হবে। এ বিষয়টি দেখভাল করতে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে একটি মনিটরিং কমিটি করে দেয়।

কী ভাবছে মন্ত্রণালয়

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যেকোনো কারণেই হোক ওয়ান আম্রেলা কনসেপ্টটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। বিষয়টি ফলোআপ করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এখন নিয়োগের বিষয়ে সরাসরি কিছু করা যাচ্ছে না। এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কোনো ডিসিশন না। জনপ্রশাসন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে। তবে আমরা প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের তালিকা করার জন্য বলতে পারি। তবে তাদের কীভাবে সমন্বয় করা হতে পারে, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এখন আমরা একটি সমস্যার মধ্যে আছি। কিন্তু যদি কাউকে টেম্পোরারি নিয়োগ দেওয়া হয়, সমস্যা কেটে গেলে তাদের কী করা হবে, সেগুলোও ভাবতে হবে।’

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka stares down the barrel of water

Once widely abundant, the freshwater for Dhaka dwellers continues to deplete at a dramatic rate and may disappear far below the ground.

6h ago