করোনায় আগামীর সংকট, আজকের ভাবনা
লকডাউনে স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, যাতায়াত, সেবা। ঘরবন্দি বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। দুনিয়াখ্যাত তাবৎ প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাস— করোনাজনিত অতিমারিতে বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারাবে। বন্ধ হয়ে যাবে বহু প্রতিষ্ঠান। নতুন করে দরিদ্র হবে কোটি কোটি মানুষ। মন্দায় ঢুকবে বিশ্ব এবং নেতিবাচক হবে বেশিরভাগ দেশের প্রবৃদ্ধি।
করোনা পরিস্থিতি প্রলম্বিত হলে বিশ্ব পরিস্থিতি কেমন হবে, তা ভাবতেও ভয় হয়। উন্নত দেশগুলোর অবস্থা যেখানে শোচনীয়, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। ফলে আগামী দিন ধনী-গরিব সবার জন্যই কঠিন হবে।
প্রতিদিন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় দেশ আরও কিছুদিন লকডাউন থাকবে ধারণা করা যায়। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতিও বাড়বে। রাস্তায় রাস্তায় ক্ষুধার্তের ভিড়, খাদ্য সহায়তার দাবিতে বিক্ষোভ, ত্রাণের গাড়ি লুটের ঘটনায় প্রমাণিত— দীর্ঘদিন লকডাউন চালিয়ে যাওয়া যাবে না। আবার লকডাউন উঠলেই সব ঠিক হয়ে যাবে তাও নয়। সবাই কাজেও ফিরতে পারবে না। কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় একটা অংশ কাজ হারাবে। বেকারত্ব বাড়বে। চাহিদা কমায় বড়-ছোট সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ভুগবে। এতে বিপদ শুধু বেসরকারি খাতের নয়, সরকারেরও।
তারপরও পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র— সবারই প্রস্তুতি থাকতে হবে। যেন আগামীতে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানো যায়। অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে সম্ভাব্য সব সুযোগ ও বিকল্প কাজে লাগানো যায়।
কৃষি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে
জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে কৃষির অবদান ১৩ শতাংশ। কিন্তু, কর্মসংস্থান করে ৪০ শতাংশের। চলমান সংকটে কৃষির চাহিদা আরও বাড়বে। কাজ হারানো শ্রমিকদের বড় একটি অংশই যুক্ত হবে কৃষিতে। এ অবস্থায় কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রতি ইঞ্চি জমি চাষ করতে হবে। কৃষককে সার, সেচ ও বীজ ভর্তুকি বা বিনা মূল্যে দিতে হবে এবং সময়মতো কৃষি উপাদান প্রকৃত কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এটুকু সহায়তা পেলেই কৃষক জাতিকে দু’বেলা ভাত জোগাতে পারবে। পাশাপাশি, কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য ও পণ্যের চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।
উৎপাদন ও সরবরাহ ঠিক না থাকলে, নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। রোজায় এমনিতেই সবকিছুর দাম বেড়েছে। একদিকে লকডাউন, অন্যদিকে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি গণঅসন্তুষ্টি তৈরি করবে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় আমদানি ঠেকাতে হবে। ভবিষ্যতের প্রয়োজন মেটাতে ডলার বাঁচাতে হবে। আমদানি হতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ। এজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত কোন পণ্যের কী চাহিদা তা এখনই নিরূপণ করা। অন্তত প্রতি তিনমাস ধরে আগামী এক বছরের জন্য প্রাক্কলন করা।
খরচ বাঁচাতে বেতন কমাতে হবে
করোনা-পরবর্তী সময়ে ছোট-বড় সবাইকে খরচ কমিয়েই টিকে থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী ছাঁটাই, প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা লে-অফের মতো উপায় বেছে নিতে পারে। আবার শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা অন্য দেশের অভিজ্ঞতাও নিতে পারেন।
একজন ব্যবসায়ী বন্ধু জানিয়েছেন, কর্মচ্যুতি ঠেকাতে সিঙ্গাপুর দুটি পদ্ধতি নিয়েছে। প্রথমত: প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যালু অ্যাডেড ও নন-ভ্যালু অ্যাডেড কর্মীদের আলাদা করেছে। এরপর নন-ভ্যালু অ্যাডেড কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, যেন তারাও নানাভাবে ভ্যালু অ্যাড করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত: সর্বস্তরের কর্মীদের যোগ্যতা ও পদ অনুযায়ী বেতন কমিয়েছে।
বাংলাদেশেও সবচেয়ে নিচের স্তরে ৫ শতাংশ, তার উপরে ৭ থেকে ১০ শতাংশ, এর উপরে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ, এভাবে একদম মাথার দিকে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেতন কমানো যেতে পারে। এভাবে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ খরচ কমানো সম্ভব। এতে বহু প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রয়োজনই হবে না। বিশেষ এই পরিস্থিতিতে খরচ কমানো ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান টিকবেই না। প্রতিষ্ঠান বাঁচলে, চাকরি থাকবে। বেতন হবে, সংসার চলবে। পাশাপাশি সবাইকে বাড়তি শ্রম দিতে হবে। কিন্তু, বাড়তি পাওনা (ওভার টাইম) দাবি করা যাবে না। তবে, সুদিন ফিরলে এই ত্যাগের প্রতিদান পাওয়া উচিত কর্মীদের।
চাপে পোশাক খাত
পোশাক খাত, করোনাকালীন দুর্যোগে ভয়াবহ গণসমালোচনা ও চাপে আছে। লকডাউনের মধ্যেও প্রায়ই শ্রমিক বিক্ষোভের খবর আসছে। অনেক কারখানায় লে-অফ হয়েছে শোনা যাচ্ছে। খাতটি ইতোমধ্যেই কয়েক বিলিয়ন ডলারের নিশ্চিত ক্রয়াদেশ হারিয়েছে। অনেক ক্রয়াদেশ স্থগিত। আপাতত কোনো সুখবর নেই পোশাক খাতে।
বাংলাদেশি পোশাকের বড় দুই বাজার আমেরিকা ও ইউরোপ করোনার আঘাতে জর্জরিত। দীর্ঘ লকডাউনে সেখানকার শোরুম বা দোকানগুলো বন্ধ। যার অর্থ হচ্ছে— সেখানে পোশাকের বাড়তি মজুদ হবে। ক্রেতারা অর্থ সংকটে থাকবে। ব্র্যান্ডগুলো বহু শোরুম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। ফলে ক্রেতারা সহসা পাওনা পরিশোধ করতে পারবে না। বরং নতুন ক্রয়াদেশ দিতে সময় নেবে।
কিন্তু, গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের বেতন দিতে হবে। কাঁচামালের অর্থ ও সাপ্লাইয়ারদের পাওনা পরিশোধ করতে হবে। ব্যাংকের কিস্তি, ইউটিলিটি বিল দিতে হবে। এ অবস্থায় সব মালিকই চাইবে ব্যয় কমাতে। ফল হিসেবে, লে-অফ বা ছাঁটাই, অসন্তোষ ঘটতে পারে। যদি না খাতটি এখন থেকেই সংকট নিরসনের উপায় খোঁজে।
সরকার এরইমধ্যে পোশাক খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। সংকট প্রলম্বিত হলে হয়তো আরও সহায়তা দেবে। কিন্তু, প্রণোদনা দিয়ে কতদিন টিকিয়ে রাখা যাবে? আশার কথা হচ্ছে— ক্রয়াদেশ কমলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। অনেক ক্রেতা বাংলাদেশের সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার করেছে। অতিমারি ও মন্দায় আগামীতে ইউরোপ-আমেরিকায় বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন কোনো কোনো ব্যবসায়ী।
পোশাক খাত যা করতে পারে
বর্তমান শ্রম-আইন পরিপালন করে কারখানা লে-অফ করা অনেক ব্যয়বহুল। সেক্ষেত্রে পোশাক খাতও অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য বেতন কমানোর পদ্ধতি নিতে পারে। অথবা শ্রম রেশনিং করা যেতে পারে। কাজটি কঠিন হলেও এতে প্রতিষ্ঠানের ব্যয় কমবে, আবার ছাঁটাইয়েরও প্রয়োজন হবে না। ধরা যাক, কোনো কারখানায় দুই হাজার শ্রমিক আছে। এক্ষেত্রে মাসের প্রথম ১৫ দিন এক হাজার, বাকি ১৫ দিন এক হাজার শ্রমিক কাজ করবেন এবং প্রত্যেকেই ১৫ দিনের বেতন পাবেন। অনেকে মোট শ্রমিকের একটা অংশকে বিদায় করেও খরচ কমাতে পারেন।
তবে, ছাঁটাইয়ে চেয়ে শ্রমিক ভাই-বোনদের রেখে প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে পারলে সেটাই উত্তম। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের কাছে মানুষ সেটাই আশা করে। বেতন কিছুটা কম হলেও, বেকারত্বের চেয়ে চাকরি ভালো। এতে কষ্ট হলেও টিকে থাকা যাবে। একইসঙ্গে এ খাতে বিদেশিদের সংখ্যা কমিয়েও ব্যয় কমানোর কথাও ভাবতে পারেন উদ্যোক্তারা।
পোশাক খাতের উৎপাদন দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শুধুমাত্র নামি ব্র্যান্ডের কাপড় বুনলেই হবে না, খাত সংশ্লিষ্টদেরও নিজেদের বিশ্বমানে নিয়ে যেতে হবে। ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ প্রয়োজন। যেন তারা যেকোনো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে থাকে। প্রয়োজনে সরকারকে দিয়ে ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলাতে হবে। পাশাপাশি, বিজিএমইএ ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা নিতে হবে, যেন ব্র্যান্ডগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের একটা অংশ এদেশ পায়।
সরকারি ব্যয়ও কমাতে হবে
শুধুমাত্র বেসরকারি খাতে নয়, সরকারি ব্যয়ও কমাতে হবে। মনে রাখতে হবে, করোনায় অর্থনীতির যে ক্ষতি তা সহজে পূরণ হবে না। এজন্য সব পর্যায়ে কৃচ্ছতার নীতি নিতে হবে। লকডাউনের কারণে এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা দিতে হয়েছে। সম্ভবত আরও কিছু প্রণোদনা দিতে হবে। এমনিতেই সরকার টাকার সংকটে আছে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার প্রশ্নই নেই। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগও কম। উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ ছাড়া টাকা পাওয়ার উৎস সরকারের সামনে সত্যিই খুব কম। আবার লকডাউনের কারণে আয়ের চেয়ে ব্যয় করতে হবে বেশি।
এমতাবস্থায়, দুর্নীতি কমিয়ে টাকা পাচার ঠেকিয়ে বহু টাকার সংস্থান করতে পারে সরকার। তা হবে সর্বোত্তম। পাশাপাশি, সরকার তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমাতে পারে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বকেয়া হিসেবে এই অর্থ আবার ফিরিয়ে দেবে। মন্ত্রী-এমপিরাও কম বেতন নিতে পারেন। ভারতে মন্ত্রী-এমপিদের বেতন কমেছে ৩০ শতাংশ। এ ছাড়াও, মন্ত্রী, আমলাদের অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করতে হবে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে রাজনৈতিক ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে হবে। প্রয়োজনে কিছু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নও পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কোথাও ন্যূনতম অপচয়ের সুযোগ আছে, এমন সব পথ বন্ধ করতে হবে। এতে খরচ করার মতো বহু টাকা সরকারের হাতে আসবে।
সমাধান সরকারের হাতে
এ দেশের অর্থনীতি টিকে আছে গরিব কৃষক, পোশাক ও প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ত ও ঘামের ওপর। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুই খাত— পোশাক ও শ্রমবাজার— এখন বিপর্যস্ত প্রায়। সঙ্গত কারণেই সামনের বছরগুলোতে রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয় কমবে। প্রবাসী শ্রমিকরা ফিরে এলে স্থানীয়ভাবে তাদের সমর্থন যোগাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো শ্রমবাজারগুলো রক্ষায় সর্বোচ্চ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। নতুন শ্রমবাজারের সন্ধান করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় দক্ষ শ্রমিক তৈরি ও রপ্তানির উদ্যোগ নিতে পারলে।
ভয়ানক এই সংকটে সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। ফলে প্রণোদনার পাশাপাশি কৃপা আর শক্তি নিয়ে সরকারকে দাঁড়াতে হবে জনগণের পাশে। সবশেষ, পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে একটি আইনও করতে পারে সরকার। যারা টাকা ফিরিয়ে এনে বিনিয়োগ করবে, তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না। নিশ্চয়তা পেলে, অনেকেই হয়তো টাকা ফিরিয়ে এনে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন।
আরেকটি জরুরি কাজ হচ্ছে— অর্থনীতি উদ্ধারে এখনি একটি টাস্কফোর্স গঠন করা উচিত। দেশি-বিদেশি অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। যেটা পশ্চিমবঙ্গ সরকার করেছে। তারা সরকারকে পরামর্শ দেবে। করোনাজনিত অতিমারিতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার সমাধান কারো কাছে নেই। কিন্তু, সরকারি-বেসরকারি খাত একসঙ্গে কাজ করলে অর্থনীতি অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু, নেতৃত্ব ও সব সমস্যার সমাধান দিতে হবে সরকারকেই।
সাইফুল হাসান, সাংবাদিক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments