করোনাকাল, তারপর-৪

ছবি: স্টার

অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয় চিকিৎসক সমাজের কথা; গবেষণার প্রতি অবহেলা, সময় অব্যবস্থাপনা, উনাদের কর্মস্থলের দুর্বল পরিবেশ নিয়ে। আজও সমন্বয়হীনতা রয়েছে ক্লিনিশিয়ান-নার্স, বেসিক সায়েন্স, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় জড়িত মূলত চারটি ডিসিপ্লিনের মাঝে। বেসিক সায়েন্সে মেধাবী লোকদের গবেষণার সুযোগ নেই। ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা’ এখনো আধুনিক বিজ্ঞান হিসাবে স্বীকৃতি পেল না।

সাঁতারের প্রশিক্ষক হয়তো অনেক আছেন; কিন্তু নিজেই হয়তো সাঁতার জানেন না।

সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য উপরোক্ত সবকটি বিভাগেই প্রত্যক্ষভাবে আমার কাজ করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। আমাদের নিজেদের ভেতর সমন্বয়ের অসংগতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অযাচিত ইগো-অহংকার আমাদের করুন জনস্বাস্থ্যের একটি অন্যতম কারণ। এমনিতেই জনবহুলতা, বসবাসের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপুষ্টিজনিত স্বাস্থ্যহীনতার করুণ চিত্র এবং উচ্চমাত্রার ব্যাপক পরিবেশের দূষণে অতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আমরা। সব কিছু মিলে আজকের এই অকল্পনীয় স্বাস্থ্য সংকট অর্থনৈতিক সংকটে পরিণত হতে চলেছে। এখনো আমরা এন-৯৫ মাস্ক, সার্জিক্যাল মাস্ক, সাধারণ কাপড়ের মাস্ক—কোনটা কি বস্তু এ বিষয়ে স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে পারিনি। পিপিইর প্রসঙ্গতো আছেই। এসব কিন্তু ক্লিনিশিয়ানের একমাত্র কাজ নয়। তাদের এর চেয়েও কঠিন কাজ আছে।

বহুদিন ধরেই দেখছি জনপ্রিয় কোন ডাক্তার অর্থাৎ প্রচুর রোগী দেখেন বা বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে শক্তিশালী—তাদেরকেই প্রশাসনের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত উঁচু উঁচু চেয়ারে বসানো হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিন্তু সাধারণ জনগণ। একদিকে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে পাচ্ছে না। সময়মতো রোগীরা দেখা পায় না ওই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। প্রশাসনের ‘জটিল ভুবনে’ ব্যস্ত থেকে উনি দৌড়াচ্ছেন দেশে-বিদেশে, মিটিংয়ে-সিটিংয়ে।

আমরা জানি আমাদের স্বাস্থ্যসেবার একটা বড় দুর্বলতা যে প্রয়োজনের তুলনায় দক্ষ চিকিৎসক ও নার্সের অপ্রতুলতা। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা সবার পিছনে। আমাদের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো কিন্তু সারাদেশে প্রচুর পরিমাণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। তাদের অবকাঠামোর (অর্থাৎ দালানকোঠা, টেবিল, চেয়ার, অর্ধমৃত এম্বুলেন্স, অব্যবহৃত যন্ত্র, পুরনো বেড) পেছনেও অনেক খরচ সরকারের। কিন্তু স্বাস্থ্য-জনবল তৈরির নীতিমালাতে একেবারে বেহাল অবস্থা! নতুন করে সাজানোর কোন বিকল্প নেই। জাতির স্বাস্থ্য ভঙ্গুর হলে সামগ্রিক অগ্রগতি যে থমকে যায়, তা আমাদের চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। করোনাভাইরাস একসময় চলে যাবে। ভবিষ্যতে কিন্তু আরও বিপজ্জনক সংক্রামক রোগের আবির্ভাব হতে পারে। হয়তো আমরা অচিরেই জিকা ভাইরাসের কথা শুনব অথবা অন্য কোনো ভাইরাসের কথা। তার জন্য আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।

‘জনস্বাস্থ্য রক্ষার চেয়ে রাষ্ট্রের অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো রাখা জরুরি’ বলে যে সকল অর্থনীতিবিদ মনে করেছেন—তা আজকের এই মহাসঙ্কটে যুক্তরাষ্ট্রকে দেখে তাদের ভুল আশা করি ভাঙবে। দেশি-বিদেশি সংবাদ ও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সাধারণ মানুষ আজ দিশেহারা। আমরা বেশি কথা বলতে পছন্দ করি এটা নতুন কিছু নয়। বলতে শুরু করলে অন্য আর কারো কথা শুনতেও চাই না। আমাদের সামগ্রিক কথোপকথনে ‘আমরা’ শব্দটা দুর্লভ। ‘আমিত্ব’ থেকে বের হবার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। এখন তো ঘরেই আছেন—মনে হয় কি! ‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার, এই তোমাদের পৃথিবী, এর বাইরে জগত আছে তোমরা মানো না…………।’

ডা. রুবায়ুল মোরশেদ: চিকিৎসক, গবেষক, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠাতা, সম্মান ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

 

আরও পড়ুন

করোনাকাল, তারপর-১

করোনাকাল, তারপর-২

করোনাকাল, তারপর-৩

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Terrorism Act

Banning party activities: Govt amends anti-terror law

Activities of certain entities, and activities supporting them can now be banned

1h ago