করোনা সংকট নিরসনে

সরকার-মালিক-শ্রমিক এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান

দেশে চলমান করোনা সংকট নিরসনে সরকার-মালিক-শ্রমিক সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
BILS Roundtable
ছবি: সংগৃহীত

দেশে চলমান করোনা সংকট নিরসনে সরকার-মালিক-শ্রমিক সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

মহান মে দিবস ২০২০ উপলক্ষে ‘কোভিড-১৯, বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণে করণীয়’ শিরোনামে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) ও ডেইলি স্টার অনলাইন গোলটেবিল বৈঠকে এই আহ্বান করা হয়।

গতকাল ৩০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত অনলাইন বৈঠকে আলোচকরা মহান মে দিবসের বীরযোদ্ধা ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং তাদের পথ ধরে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে দিবসের চেতনা বাস্থবায়নেরও আহ্বান জানান।

বিলস চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান সিরাজের সভাপতিত্বে এবং মহাসচিব ও নির্বাহী পরিচালক নজরুল ইসলাম খানের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান আলোচক হিসেবে অংশ নেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর।

বৈঠকে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ, নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধিগণ, গবেষক ও শিক্ষাবিদ উপস্থিত ছিলেন।

করোনা মোকাবিলায় সরকার গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে শিবনাথ রায় বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শ্রমিকরা। তাদের কল্যাণে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের অর্থ কীভাবে ব্যয় করা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। এ ছাড়া কল্যাণ তহবিল থেকে শ্রমিকদের সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে আলোচনা করতে হবে।’

যেসব শ্রমিক ইতোমধ্যে চলে এসেছেন তাদের সুরক্ষার বিষয়টিকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন,  ‘যেসব কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য পরিদর্শকবৃন্দ, শিল্প পুলিশ ও বিজিএমইএকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

পর্যায়ক্রমে কারখানাগুলোকে খোলা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তবে ঢাকার বাইরে থেকে শ্রমিক আনা হবে না বলে মালিকরা বলেছেন। তারা বলেছেন, কোন শ্রমিক ছাঁটাই বা লে-অফ করবেন না। তবে ৬০ ভাগ বেতন দেওয়া হবে।’

তিনি বলেন মালিকপক্ষ বেতন দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ৪২২টি কারখানার ১ লাখ ১ হাজার ১৭০ শ্রমিক মার্চ মাসের বেতন পাননি।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘দেশে এমনিতেই বেকারত্বের হার বেশি, এখন করোনার কারণে এ হার আরও বেড়ে যাবে। এছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ কমে আসায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও দুর্বল হতে পারে।’

করোনা মোকাবিলায় শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আগামী বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং স্থায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি বর্তমানে দ্রুত জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিবর্তন করে স্বাস্থ্য কার্ড করা প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সভাপতির বক্তব্যে বিলস চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান সিরাজ বলেন, ‘করোনা সংকট মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন। শ্রমিকরা যাতে বেতন পায় তার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। তারপরও শ্রমিকরা এখনো বেতন ভাতার জন্য আন্দোলন করছেন। এ জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

শ্রমিকদের সুরক্ষায় ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের ভূমিকা আরও জোরদার করার দাবি জানিয়ে শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের আহ্বায়ক ড. হামিদা হোসেন বলেন, ‘শুধুমাত্র গার্মেন্টস নয় অন্যান্য সেক্টরের শ্রমিকদের কথাও ভাবতে হবে। যেসব স্থানে কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে সেসব কারখানার শ্রমিকদের কারখানার কাছাকাছি রাখার ব্যবস্থা করতে পারলে শ্রমিকদের সুবিধা হবে। এতে শ্রমিক আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে।’

এছাড়া লকডাউন অবস্থায় নারী শ্রমিকদের উপর নানা ধরণের নির্যাতন হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘নারী নির্যাতন কীভাবে রোধ করা যায় সেটা নিয়েও ভাবতে হবে।’

স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি ও বিলসের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য মেসবাহউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতের আরও অনেক উন্নয়ন করতে হবে। এর জন্য দরকার বেশি বিনিয়োগ।’

কৃষিখাতে বেশি করে প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে কৃষকদের বেশি করে সাহায্য করা গেলে করোনা-পরবর্তী খাদ্য সংকট উত্তরণে সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশনের সভাপতি ও বিলসের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য শাহ মো. আবু জাফর বলেন, ‘মে দিবসের স্বাদ বাংলাদেশের শ্রমিকরা এখনো পায়নি। এখনো শ্রমিকরা ভালোভাবে বাঁচার জন্য আট ঘণ্টা কাজের বাইরে ওভারটাইম করে জীবিকা নির্বাহ করছে ‘

তিনি আরও বলেন, ‘শ্রমিকদের পাওনা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে মালিকদের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে।’

গার্মেন্টস কারখানা খোলার বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘একাত্তরের শরণার্থীর মতো শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে ঢাকায় আসছে এরকম দৃশ্য আমাদের দেখতে হচ্ছে। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার।’

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অভিবাসী ইস্যূতে বাংলাদেশ পাঁচ ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হবে। যেমন, নতুন কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাবে, রেমিটেন্সের পরিমাণ কমবে, দেশে বেকার সমস্যা বাড়বে, অভিবাসী নারী শ্রমিকদের ঝুঁকি বাড়বে এবং ফিরে আশা শ্রমিকরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হবে।’

দেশে ৪০ লক্ষ দোকান কর্মচারী বর্তমানে মানবেতর জীবন-যাপন করছে উল্লেখ করে জাতীয় শ্রমিক জোট বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নইমুল আহসান জুয়েল বলেন, ‘দোকান কর্মচারীরা শ্রম আইনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।’

জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজম খসরু বলেন, ‘করোনা কোন স্থানীয় সংকট নয়, এটা বৈশ্বিক সংকট। এ সংকটময় মুহূর্তে বিভেদ নয় বরং ঐক্য নিয়ে যার যার অবস্থান থেকে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’

Comments