শার্লক হোমসকে অনুসরণ করে করোনা মোকাবিলা
স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের জনপ্রিয় কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসের মতো অনুসন্ধান চালিয়ে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকিয়েছে চীনের এক দল মহামারি বিশেষজ্ঞ।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমনই এক শার্লক হোমসের গল্প।
২২১ বি বেকার স্ট্রিট থেকে সাংহাই অনেক দূরে হলেও এখানেই করোনায় আক্রান্তদের খোঁজে অনুসন্ধান চালিয়েছেন আধুনিক সময়ের শার্লক হোমস মহামারি বিশেষজ্ঞ গং শিয়াওহুয়ান।
কয়েক মাস ধরে নিরলসভাবে চীনের মেট্রোপলিটন শহর সাংহাইয়ে করোনা আক্রান্ত ও সংস্পর্শে আসাদের খুঁজে বের করেছেন গং (৩২)।
কীভাবে তিনি অনুসন্ধান চালিয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমরা করোনা সংক্রমিত ও সংক্রমণের আশঙ্কা আছে এমন সবার সঙ্গে কথা বলেছি। শেষ ১৪ দিনে তারা কোথায় গিয়েছেন, কী করেছেন, কাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে বিস্তারিত তথ্য নিয়েছি। এই প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে আমরা একটা সামগ্রিক চিত্র পাই যেটা অনুসরণ করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, কাজটা অনেকটাই পুলিশি তদন্তের মতোই অনেক বেশি যত্ম ও ধৈর্যের সঙ্গে করতে হয়েছে।
করোনা মহামারির আগে সাংহাই সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মহামারি জরিপকারীর দায়িত্বে ছিলেন গং। পাঁচ বছর ধরে তিনি অভ্যন্তরীণ সংক্রমণ শনাক্ত এবং অনুসন্ধানের কাজ করছেন।
জানুয়ারি মাসে সাংহাইয়ে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে ওই রোগী হাসপাতালের আসেন। অনুসন্ধান শুরু করেন গং। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) পরেই তার সঙ্গে কথা বলেন। জানা যায়, ৫০ বছর বয়সী ওই নারী উহান থেকে ডিসেম্বর মাসে সাংহাইয়ে মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ওই নারীর করোনা শনাক্ত হয়।
গং বলেন, ‘ওইসময় আমরা ভাইরাসটি সম্পর্কে খুব কম জানতাম। গত ৩১ ডিসেম্বর রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ- সিডিসির পক্ষ থেকে সব কর্মকর্তাকে একটি সম্ভাব্য মহামারির প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছিল। তাই আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছি। তিনি কোন গাড়িতে সাংহাইয়ে এসেছেন, কাদের সংস্পর্শে এসেছেন সবকিছু জেনে সে অনুযায়ী কোয়ারেন্টিন, নমুনা সংগ্রহ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে।’
মহামারির জরিপের মূল লক্ষ্য হলো উৎস্য খুঁজে বের করা। প্রথমত, সংক্রমণটি কোথা থেকে শুরু হয়েছে সেটা জেনে সংস্পর্শ বন্ধ করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত ও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকাদের খুঁজে বের করে চিকিৎসা ও কোয়ারেন্টিনে রাখা।
সাংহাই সিডিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শহরটির ৩৩০ জন আক্রান্তের এক তৃতীয়াংশই অন্য রোগীর সংস্পর্শের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৮০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধান করেছেন গং। দুই থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় নিয়ে তিনি একেকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীরা আমাদের সহযোগিতা করেছেন। কয়েকজন ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমি তাদেরকে বলছি, এই অনুসন্ধানে সহযোগিতা করা বাধ্যতামূলক। তা না হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
যেকোনো ভালো গোয়েন্দার মতো ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন গং। অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ব্যবহার করেছেন। প্রতিটি তথ্যের সত্যতা যাচাই করে রোগীর ১৪ দিনের কার্যক্রমের একটি সামগ্রিক চিত্র তৈরি করেছেন।
অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, শেষ ১৪ দিনের দৈনন্দিন কার্যক্রম বিস্তারিতভাবে সবাই মনে রাখতে পারে না। গং তাই শুরুতেই শনাক্ত হওয়ার আগের দিনকে প্রথম দিন ধরে নিয়ে বিস্তারিত জানতে চান, এরপর দ্বিতীয় (তার আগের দিন), তৃতীয়… ধরে নিয়ে ধীরে ধীরে ১৪ দিন পর্যন্ত সব জানার চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, ‘বয়স্ক অথবা গুরুতর অসুস্থদের ক্ষেত্রে আমি তাদের পরিবারের সদস্য, আপনজনের সঙ্গে কথা বলেছি।’
কাজটি সবসময় সহজ ছিল না। কখনো কখনো গং ও তার সহকর্মীদের হাল ছেড়ে দিতে দিয়েছে। অনেকসময়, তাদের তথ্য যাচাই করে মিলিয়ে দেখতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে।
ফেব্রুয়ারির শুরুতে সাংহাইয়ে দুজন আক্রান্ত শনাক্ত হয় যারা উহান থেকে আসেননি। এই দুই রোগীর অনুসন্ধানের দায়িত্ব আসে গংয়ের ওপর। অনুসন্ধানে তিনি জানতে পারেন, তারা দুজনই চীনের আনহুই প্রদেশ থেকে আসা একজনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, একসঙ্গে খাবার খেয়েছিলেন। ওই ব্যক্তিকে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখা যায় তিনি উপসর্গহীন করোনার বাহক।
আরেকটি জটিল অনুসন্ধান ছিল ৭০ বছর বয়সী এক নারীকে নিয়ে। তিনি একাই থাকতেন। কখনও সাংহাইয়ের বাইরে যাননি। ১৪ দিনের মধ্যে কোনো ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানেও যাননি। অনুসন্ধানের ১০ দিন পর আরেকজন আক্রান্তকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে গং জানতে পারেন ওই নারী সম্প্রতি একটি সরকারি অফিসে গিয়েছিলেন। তাদের দুজনের সেখানে দেখা হয়েছিল।
ডা. ওয়াটসনের সাহায্য ছাড়াই বেকার স্ট্রিটের কাল্পনিক গোয়েন্দার মতো করোনা আক্রান্তদের উৎস, সংক্রমণের সামগ্রিক চিত্র সফলভাবে তুলে ধরেছেন গং।
তিনি বলেন, ‘এই ধরনের অনুসন্ধানের জন্য ধৈর্য প্রয়োজন। কারণ প্রতিটি বিবরণই পরীক্ষা করে দেখতে হয়।’
সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক হু শ্যানলিয়ান বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করার জন্য মহামারি জরিপ গুরুত্বপূর্ণ। এটাতে অনেক শ্রম ও সময় দিতে হয়। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম শর্ত এটাই।’
তিনি জানান, প্রথম সারির চিকিৎসাকর্মীদের পাশাপাশি একইরকম গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেও কেন যেন মহামারির অনুসন্ধান করা এই মানুষগুলো অনেকের কাছেই অদৃশ্য। অথচ এ মানুষগুলোই উপসর্গহীন বাহকদের খুঁজে বের করে ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকাতে অবদান রাখছেন। ঝুঁকি নিয়ে এক আক্রান্ত থেকে অন্য আক্রান্তের কাছে ছুটে চলছেন।
Comments