‘কাজলের হাতের হাতকড়া তো দেখা যাচ্ছে, আপনার হাতেরটা দেখতে পান?’

ছবি: সংগৃহীত

সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল নিখোঁজ হয়েছিলেন, নাকি তাঁকে নিখোঁজ করে রাখা হয়েছিলো— সেই প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। হওয়ার সুযোগও সম্ভবত আর নেই। কাজল গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং তাকে পিছমোড়া করে হাতে হাতকড়া পরিয়ে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাতিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে— একজন ‘নিখোঁজ’ থাকা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং আমাদের সাংবাদিক কমিউনিটি অনেকটা নীরবেই সেটা মেনে নিয়েছেন।

কাজলকে গ্রেপ্তার এবং ‘পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে’ জেলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী আসলে কাজলকে নিখোঁজ করে দেওয়ার দাবিটাকে নাকচ করে দিয়েছেন। তারা স্পষ্টতঃই বার্তা দিয়েছেন— শফিকুল ইসলাম কাজল নামের ব্যক্তিটি একজন ‘দাগি অপরাধী’ এবং আইনশৃংখলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোও তারা পরিষ্কার করেছে— কাজল অনুপ্রবেশকারী, তার নামে বিভিন্ন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কয়েকটি মামলা আছে।

দেশের একজন নাগরিক নিজ দেশে ফিরে এলে তাকে কোন আইনের ধারায় ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলা হয় এবং তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগে মামলা হয়— সেটি  আইনের প্রশ্ন। কাজলের পরিবারের পক্ষ থেকে সম্ভব না হলে দেশের অসংখ্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উচিৎ হবে এই বক্তব্যকে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসা কোনো বাংলাদেশির বিরুদ্ধেই কিন্তু এর আগে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারাও কি অনুপ্রবেশকারী ছিলেন? তা হলে কাজল কিভাবে অনুপ্রবেশকারী হন?

কাজলের নামে বিভিন্ন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার কথাও পুলিশ বলেছে। এই মামলাগুলোর কথা বলে পুলিশ আসলে আমাদের কাজলের নিখোঁজ হওয়ার প্রেক্ষিতটা নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী, যিনি বর্তমানে সংসদ সদস্য, একটি মামলার বাদি। আমরা জানি, পাপিয়া কাণ্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুবই সরব ছিলেন কাজল। পাপিয়া কাণ্ডের অনেক স্পর্শকাতর তথ্য সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঈঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তাও লিখেছেন কাজল। তাঁকে নিখোঁজ করে দেওয়া কিংবা তাঁর নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে এসব বিষয় জড়িত বলে সবারই ধারণা ছিলো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার প্রসঙ্গটা সামনে এনে পুলিশ আমাদেরকে যে বার্তাটি দিতে চেয়েছে সেটি নিশ্চয়ই আমরা বুঝতে পারছি।

কাজলকে পিছমোড়া করে হাতকড়া পরানো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘মিউ মিউ’ জাতীয় কিছু প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েছে। অনেক সাংবাদিক এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সাংবাদিকদের নানা সংগঠন আছে, অনেক বড় বড় সাংবাদিক নেতা আছেন। তারা দান খয়রাত, রিলিফ পাইয়ে দেওয়ার জন্য এবং ছিটেফোঁটা রিলিফ পেলে তার জন্য কৃতজ্ঞতার  বন্দনা গাইবার জন্য যতোটা উচ্চকণ্ঠ হন— কাজলের হাতকড়া নিয়ে তাদের গলা থেকে তেমন একটা শব্দ বের হয়েছে বলে শুনিনি। হাতকড়া কেন, কাজলকে ‘নিখোঁজ’ করে দেওয়া নিয়েও তারা যে খুব একটা উচ্চকণ্ঠ ছিলেন তা সম্ভবত নয়।

প্রেসক্লাবের সামনে কয়েকটা অবস্থান কর্মসূচী পালিত হয়েছে, সেগুলোর সচিত্র সংবাদ হয়েছে, সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ছবি-টবি দেখা গেছে। কিন্তু, সরকারের উপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করা কিংবা জবাবদিহি চাওয়ার মতো মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়াতে সাংবাদিক নেতাদের দেখা যায়নি।

দেশের সাধারণ একজন নাগরিক নিখোঁজ হয়ে গেলেও রাষ্ট্র তৎপর হয়ে উঠে— বিশ্বের যে কোনো সভ্য দেশেরই চিত্র এটি। একজন সাংবাদিক নিখোঁজ হয়ে গেছেন, তার পরিবার থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়ে নিগ্রহের মুখোমুখি হয়েছেন।

জিডির পর পুলিশ কী করেছে, আদৌ তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে কিনা— এ নিয়ে খোঁজ-খবর করার মতোও কেউ কি ছিলো? ছিলো না। সামাজিক চাপ তৈরির বিষয়টা আমরা তো ভুলেই গেছি। ‘সুশীল সমাজ’ শব্দটাকে গালিতে পরিণত করে  কার্যকর বিরোধীদলহীন রাষ্ট্রকে, সরকারকে যা খুশি করার ‘পাসপোর্ট’ দিয়ে রেখেছি।

সাংবাদিক সংগঠনগুলোও, সাংবাদিক নেতারাও পুলিশ কর্মকর্তাদের, মন্ত্রীকে এমনকী প্রধানমন্ত্রীকে এ নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি করার সাহস দেখাতে পারেনি। একজন সাংবাদিককে কেন পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে কারাগারে নেওয়া হলো— এই প্রশ্ন নিয়ে সরকারের মুখোমুখি হওয়ার মতো সাংবাদিক নেতা বা সংগঠন আমরা খুঁজে পাবো না। কেননা, রিলিফ চাইতে চাইতে, করুণা ভিক্ষা করতে করতে আমাদের সাংবাদিক নেতারা অধিকার, আত্মসম্মান, সাংবাদিকতার মর্যাদা— এসবই ভুলে বসে আছেন।

তারা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না— পিছমোড়া করে হাকতড়া পরানো কাজলের ছবিটা আসলে বাংলাদেশের মিডিয়ারই চিত্র, মুক্ত গণমাধ্যমেরই চিত্র। বাংলাদেশের মিডিয়া, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নয়— অধিকারটাকেই যে এভাবে পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছে— সেটাও হয়তো তারা বুঝতে চাইবেন না। ফলে সাংবাদিক কাজলকে তার মতো করেই ভুগতে হবে, তার পরিবারকেই থানা আর আদালতের বারান্দায় ছুটে বেড়াতে হবে।

সাংবাদিক কাজলের জন্য আমারও কিছু চাইবার নাই। শুধু অধ্যাপক আলী রিয়াজের কথাটাই উদ্ধৃত করি, কাজলের হাতের হাতকড়া তো দেখা যাচ্ছে, আপনার হাতেরটা দেখতে পান? ‘দাসত্বের শৃঙ্খল কি শুধু পদপ্রান্তে?’

শওগাত আলী সাগর: কানাডার বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশর প্রধান সম্পাদক

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

'Frustrated, Yunus hints at quitting'

Frustrated over recent developments, Chief Adviser Prof Muhammad Yunus is considering stepping down, said sources familiar with what went down at the Chief Adviser’s Office and Jamuna yesterday.

2h ago