করোনা সংক্রমণের কোন পর্যায়ে আছি আমরা?
নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ নিয়ে প্রায় দুই সপ্তাহ কিছু লিখি নাই। সবার লেখা দেখছিলাম, পড়ছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যার যার জায়গা থেকে যে প্রচেষ্টা তা আমার কাছে অভূতপূর্ব মনে হয়েছে।
যারা জনস্বাস্থ্যের মানুষ নন, তারাও পড়ালেখা করে কিছু একটা দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন। তাদের এই চেষ্টা পুরোটাই যৌক্তিক। কেননা, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলি, করোনাভাইরাস নিয়ে আমরা কেউই প্রায় কিছুই জানি না। যারা এই বিষয়ে কথা বলছেন সবাই এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে নিজের জ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক ধারণা নিয়ে বলছে। ব্যাপারটা তাই এমন না যে পৃথিবীতে ২০ জন করোনাভাইরাস বিশেষজ্ঞ আছেন, কেবল তারাই লিখার অধিকার রাখেন, অন্যরা রাখেন না।
তবে যে হাজার হাজার নিবন্ধ লেখা হচ্ছে তার মধ্যে যাদের ধারণা বাস্তব হচ্ছে তারা নায়ক হচ্ছেন, যাদের ধারণা ভুল হচ্ছে তারা ভিলেন হয়ে যাচ্ছেন। তাই তথ্য উপস্থাপনার সময় এটি বার বার বলা দরকার যে যেকোনো ধারণাই ভুল বা সঠিক হতে পারে। যারা লিখবেন তাদের এটি খেয়াল করে লিখা উচিত যে লেখায় ধারণা থাকতে পারে, কিন্তু ভুল তথ্য যা মানুষ অনুকরণ করবে, এমন বিষয় এড়িয়ে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য।
আজকে করোনাভাইরাসের এমন কিছু ধারণা নিয়ে লিখছি যা হয়ত সবার চিন্তার খোরাক যোগাতে পারে। গত দুই মাসের নিরবিচ্ছিন্ন পড়ালেখা, গবেষণা ও আশেপাশের জানা-অজানা তথ্য বিশ্লেষণ করেই এই লেখাটি।
করোনাভাইরাস কি সহসা একদিন নির্মূল হবে?
সম্ভাবনা খুব কম। অনেকে বলতে পারেন ভ্যাকসিন আবিস্কার হলেই তো হয়ে যাবে। আসলেই কি তাই? করোনাভাইরাসের ওষুধ বা ভাইরাস নিয়ে গবেষণা অনেক হচ্ছে। করোনাভাইরাস চলে যাবে কি না তা জানার আগে আসুন সংক্ষেপে করোনাভাইরাসের অতীতটা একটু জেনে নিই, যা আমাদের অনেকেরই হয়ত অজানা।
* করোনাভাইরাস প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৩০ সালে। পোষা মুরগির শ্বাসনালীতে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ লক্ষ্য করা যায়।
* মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে এমন করোনাভাইরাস প্রথম চিহ্নিত হয় ১৯৬০ সালে।
* মুকুটের মতো আকৃতি বলে এই ভাইরাসের নাম করোনা দেন জুন এলমিডা ও ডেভিড টাইরেল।
সুতরাং প্রায় শতবর্ষ আগে খোঁজ মেলা এই ভাইরাস হঠাৎ করে যেমন আসেনি, হঠাৎ করে চলে যাবে, এমনটি ভাবারও কোনো কারণ নেই। উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন না তো? পুরো লেখাটি পড়ুন তাহলে। শেষ লাইনে গিয়ে সন্তুষ্ট হলেও হতে পারেন।
করোনাভাইরাস কি মৃত মানুষের দেহে বেঁচে থাকছে?
মনে হয় না। ভাইরাস জিনিসটাই বেশ শৌখিন! সে চায় না তার আক্রমণে মানুষ বা অন্য প্রাণী মারা যাক। সে মনের আনন্দে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কাউকে সাধারণত মারতে চায় না। কেননা, যে শরীরে ভাইরাসটি বাস করে, সেই শরীরের মৃত্যু হলে ভাইরাস নিজেও মরে যায়।
ভাইরাস একাকী বাঁচতে পারে না। তার বাঁচার জন্য একটি জীবিত বাহক দরকার হয়। সে তার বাহককে অসুস্থ করে তার মধ্যে হাঁচি-কাশি সৃষ্টি করে। তারপর সেই হাঁচি-কাশিতে ভর করে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। অন্য প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে বংশবৃদ্ধি করে, দিন দিন তার আকার-আকৃতি-ধরন পাল্টাতে থাকে। কিন্তু, চায় না তার আবাসস্থলটি মরে যাক। আবাসস্থলের মৃত্যু হলে ভাইরাস হিসেবে করোনাভাইরাসও মৃত মানুষের দেহে বাঁচতে পারবে না বেশিক্ষণ।
করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফনে অংশ নেওয়া কতটা নিরাপদ?
করোনাভাইরাস মৃতদেহে বাঁচতে পারে না। অজ্ঞাত যেসব অনলাইন নিউজে মাটির নিচের মৃতদেহ থেকে করোনা ছড়িয়েছে টাইপ নিউজ আসছে, সেগুলো আপনি চোখ বন্ধ না, চোখ খোলা রেখে অবিশ্বাস করতে পারেন। মারা যাওয়ার পর শরীরের যাবতীয় কাজ থেমে যাওয়া পর লাশ হিমাগারে রেখে, হাসপাতালের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে, অ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করে, ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে, কবরস্থানের অনুমতি নিয়ে দাফন করা পর্যন্ত যেতে বাংলাদেশে এখন দুই থেকে তিন দিন ন্যূনতম লেগে যায়। ততদিনে করোনাভাইরাস মরে যাওয়ার কথা।
হ্যাঁ, করোনাভাইরাস লাশের শরীরে না থাকলেও হাসপাতালে, হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় ফুটপাতে জব্বার মিয়ার থুতুতে, কবরস্থানের গেটের গায়ে, পথের মধ্যে আফজাল খানের হাঁচি থেকে ওড়ে আসা ড্রপ্লেটের মাধ্যমে অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে অনেক জায়গায় থাকতে পারে। সেখান থেকে আপনার শরীরেও ছড়াতে পারে। কিন্তু, বাবা-মায়ের মৃত লাশ, যেটি মোড়ানো আছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ লাশ ঢাকার নিশ্ছিদ্র কাভারে, সেখান থেকে আপনি করোনায় আক্রান্ত হবেন— এই ভয়ে জীবিত ও অসুস্থ বাবা-মাকে জঙ্গলে রেখে আসবেন না; কিংবা তাদের দাফন না করে লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে যাবেন না।
করোনাভাইরাসে মৃত মানুষের লাশ দাফন হয় পুলিশ পাহারায়। সেই লাশ থেকে ১০ হাত দূরে দাঁড়িয়ে বাবা-মার জন্য দোয়া করবেন না, দাফনে যাবেন না— এতটা ভয়াবহ করোনাভাইরাস এখনও হয়নি।
আজ বুধবার পর্যন্ত নতুন করোনাভাইরাসে মানুষ মারা গেছে প্রায় ২ লাখ ৫৭ হাজার। অথচ বিশুদ্ধ পানির অভাবে এই সময়ে মারা গেছে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার মানুষ। তাই নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকবেন। করোনার প্রকোপ একদিন কমে আসবে। কিন্তু বাবা-মার প্রতি দায়িত্বহীন আচরণ নিয়ে আপনি আর আপনার বিবেক এক শরীরে কীভাবে থাকবেন, সেই বোঝাপড়াটি এখনই করে নিন।
করোনা ভাইরাস তো আবিষ্কার হলোই গত সেপ্টেম্বরের দিকে, তাই না?
জ্বী না। করোনাভাইরাস প্রথম ধরা পড়ে ১৯৩০ সালে মুরগির মধ্যে, আর ১৯৬০ এ মানুষের মধ্যে। এখন পর্যন্ত সাত ধরনের করোনাভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলো মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। এরমধ্যে বর্তমানে যে ভাইরাসটি, তার মাধ্যমে সৃষ্ট রোগের নাম কোভিড-১৯, কিন্তু এই নামে কেউ এটিকে ডাকে না, তাই আমিও ডাকি না। এর আগে করোনাভাইরাস সৃষ্ট আরও দুটি রোগের নাম আমরা সবাই জানি— সার্স ও মার্স।
সার্স-মার্স ভয়াবহ রোগ। কিন্তু, মূলত ধনী ও উন্নত বিশ্বের মানুষদের সার্স ও মার্স কম আক্রান্ত করায় এটির চাইতে বর্তমান করোনাভাইরাসের হাঁকডাক বেশি।
করোনাভাইরাস যদি আগের সার্স ও মার্সের মতোই আফ্রিকার কোনো অজপাড়াগাঁয়ে বা অল্প কিছু উন্নত দেশের স্বল্পকিছু মানুষকে আক্রমণ করত, তাহলে এটি নিয়েও সম্ভবত এত হৈচৈ হতো না।
পৃথিবীর সাধারণ সর্দি কাশির তিনভাগের একভাগের জন্যই নাকি করোনাভাইরাস দায়ী?
একদম ঠিক। সার্স, মার্স ও কোভিড ১৯ এর আগের যে অন্য চারটি করোনাভাইরাস, সেগুলোতে আক্রান্ত হয়ে কম সংখ্যক মানুষ মারা গেলেও সেগুলোতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। পৃথিবীতে যত মানুষ সাধারণ সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয় তার প্রতি ১০ জনের তিন জনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। এই করোনাভাইরাসগুলোর নাম জানা যাক:
১) HCoV-OC43
২) HCoV-229E
৩) HCoV-NL63
৪) HCoV-HKU1
এই করোনাভাইরাসগুলো কিন্তু নির্মূল হয়নি। যদিও উন্নত দেশগুলোতে ফ্লু ভ্যাকসিন বের হয়েছে এদের প্রতিরোধ করতে, কিন্তু তা প্রতিবছরই দিতে হয়। এই ব্যাপারটা খুব ভালো করে খেয়াল করুন। এই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানুষের মধ্যে কিছুটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নেয়, কিন্তু পুরোপুরি প্রতিরক্ষা তৈরি হয় না। তাই ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার পরও প্রতি বছর এই চারটি করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য এখনও মানুষকে ভ্যাকসিন দিয়ে যেতে হচ্ছে।
অর্থাৎ একবার কোভিড-১৯ হলে আপনার শরীরে হয়ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হবে, আপনি হয়ত পরবর্তীতে এর সংক্রমণে মারা যাবেন না, কিন্তু তাই বলে এটি আর কখনই হবে না এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে, করোনাভাইরাসের ভয়ে আধমরা হয়ে বাঁচলেও চলবে না, আবার আমাদের স্বাস্থ্যবিধিতে যে আচরণগত পরিবর্তন এসেছে, তা আর কখনো ভুলে যাওয়ারও সুযোগ থাকছে না।
করোনাভাইরাস রোগ ও সার্সের অনালোচিত কিন্তু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য কী?
সার্সের সময় শুধুমাত্র যারা আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হতেন তারাই অন্যের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিতেন। কিন্তু, করোনার ক্ষেত্রে আপনার পাশের বাসার মানুষটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলার সময়, বা রাস্তায় আপনার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া অজানা মানুষটিও কোনো লক্ষণ ছাড়াই এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারেন। সুতরাং, সার্সের সময় শুধুমাত্র যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদেরকে আলাদা করেই সার্স নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছিল। কিন্তু, করোনায় যেহেতু কোনরকম লক্ষণ দেখানো ছাড়াই রোগ ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাই এদের পার্থক্য অনেক বড়।
সার্সে মৃত্যুর হার ছিল শতকরা ১০ শতাংশ। করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা শতকরা ১ ভাগেরও কম, এই কথাটি কি সঠিক?
করোনাভাইরাসের চেয়ে সার্স অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ছিল মৃত্যুর শতকরা হিসাবে। পৃথিবীর প্রায় ২৯ দেশের ৮,০০০ মানুষ সার্সে আক্রান্ত হয়েছিল। মারা গিয়েছিল প্রায় ৮০০ মানুষ, অর্থাৎ মৃত্যুর হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি। করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার এখন পর্যন্ত এক শতাংশেরও কম।
এছাড়াও, বিশ্বে যে কোটি কোটি মানুষকে কোন লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই এই ভাইরাসটি ইতোমধ্যেই সংক্রমিত করলেও তারা সুস্থ হয়ে গেছেন, সেই বিবেচনায় বলা যায় আসলে নতুন করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর হার শতকরা এক ভাগেরও অনেক কম।
খেয়াল করুন পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা ৭৮০ কোটির মতো। এর এক শতাংশ করোনাভাইরাসে মারা গেলে সংখ্যাটি হতে হবে ৭ কোটি ৮০ লাখ। অথচ, করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা এখনও ৩ লাখের কম।
পরীক্ষা করে যে ৩৬ লাখ মানুষের আক্রান্ত হিসাবে ধরা হচ্ছে, সেই গাণিতিক হিসাবেও মৃত্যুর হার ৯ শতাংশের মতো। কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কখনই লক্ষণ প্রকাশ না করে সুস্থ হয়ে যাওয়া কোটি কোটি মানুষকে এই হিসাবে রাখছেন না। তবে এটি সঠিক তথ্য আরও বহুদিন পর, করোনার মহামারি যখন শেষ হবে, তখন মৃত্যুর মূল শতাংশ-হার বোঝা যাবে। আমি আমার লেখাপড়া ও গবেষণা থেকে বলতে পারি, এক শতাংশের কম হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত প্রায়।
কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় মে মাসের প্রথমভাগেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে ৭ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে বলে যে দাবি করা হয়েছিল, সেটির সত্যতা কতটুকু?
এই গবেষণার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য সেক্টরে মুখচেনা এবং প্রশংসিত গবেষক। আমি খুবই মনোযোগ দিয়ে তাদের গবেষণাপত্রটি পড়েছি। গবেষণাটিতে নির্দিষ্ট একটা মডেল ফলো করে ইউরোপের কেইস হিস্ট্রিকে ভিত্তি করে মূলত অংক কষে একটি সংখ্যা বলে দেয়া হয়েছে। এই অংকে কোন ভুল নেই। কিন্তু সমসয়া হচ্ছে শুধু অংক কষলেই তো হবে না। জনস্বাস্থ্যে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব আছে, কিন্তু সেটা সীমিত। জনস্বাস্থ্যের মূল বিষয় হচ্ছে সামাজিক ও আচরণগত বিজ্ঞান, এই গবেষণায় তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। তাই ইউরোপ, চায়নার পরিস্থিতি বিবেচনায় যে হিসাব দেওয়া হয়েছে তা যে কখনই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশে বাস্তবতার নিরিখে প্রযোজ্য হবে না, সেটি পড়লেই বোঝা যাচ্ছিল।
আশা করা যায় ভবিষ্যতে এই ধরণের সংখ্যাগত কিংবা পরিসংখ্যানগত গবেষণা করার সময় সামাজিক ও আচরণগত বিজ্ঞানীদের পরামর্শ নিয়ে মডেল দাঁড় করানো হবে, যা বাস্তবতার নিরিখে তথ্য-উপাত্ত তৈরি করতে সহায়তা করবে। তবে গবেষকদের তাদের কাজের জন্য কখনই সমালোচনার মুখোমুখি করানো ঠিক নয় যতক্ষণ পর্যন্ত তারা জ্ঞানের অন্বেষণে এই কাজটি করেন।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ২০০ জন, অথচ আমাদের ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আলেম সমাবেশ, কারওয়ানবাজারের বেচাকেনা কিংবা গত মাসে কাজে ফেরত আসা গার্মেন্টস শ্রমিকদের ভিড়ের পর ধারণা করা হচ্ছিল লাখ লাখ বাংলাদেশি মারা যাবে। আসলে কি হলো?
দেখুন, এই বিষয়টি একটি রহস্যের মতো বলা যায়। এই তিনটি ঘটনায় মানুষের উদ্বেগ খুবই স্বাভাবিক ছিল। যদিও এখনও সময় আছে, তবুও বলা যায় ব্রাক্ষণবাড়িয়া, কারওয়ানবাজার কিংবা গার্মেন্টসকেন্দ্রিক মহামিলনের পর যেই হারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর আশঙ্কা করা হয়েছিল, বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এর সঠিক কারণ পৃথিবীর কারও পক্ষেই বলা সম্ভব না। তবে যে যে কারণে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার কম বলে আমি মনে করি—
১) অনেকে ধারণা করছেন বাংলাদেশের করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ৮ মার্চ। কিন্তু আমার ধারনা চায়নার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক থাকার কারণে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছে আরও আগে, সম্ভবত ফেব্রুয়ারিতেই। তাই অনেকেই আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে গেছেন কোন লক্ষণ প্রকাশ না করেই, আর যারা মারা গেছেন, তাদের অন্যরোগের আউটকাম হিসেবে ধরা হয়েছে।
২) ঘন জনবসতির কারণে আমরা অন্য দেশের তুলনায় দ্রুততম সময়ে ‘হার্ড ইমিউনিটির’ দিকে যাচ্ছি।
৩) বাংলাদেশের অত্যাধিক তাপমাত্রা। গরম আবহাওয়ায় ড্রপলেট দ্রুত শুকিয়ে যায় ফলে করোনাভাইরাস ড্রপলেটে ভর করে অত ছড়াতে পারেনি। যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল।
৪) করোনাভাইরাসের নানা ধরণ আছে। এটি আগের চাইতে নতুন নতুন ও ভিন্নরূপে প্রকাশ পাচ্ছে এবং নানা প্রকারের করোনা নানা দেশের মানুষকে আক্রান্ত করছে। বাংলাদেশে যে করোনাভাইরাস আক্রমণ করেছে, সেটি হয়ত অতটা বিধ্বংসী না।
৫) বাংলাদেশের খাবার, পরিবেশ, দূষণ ইত্যাদির সাথে অভ্যস্ততার কারণে আমাদের এই বিশেষ ভাইরাসের প্রতি ইমিউনিটির গভীরতা কি অন্য দেশের চাইতে বেশি? হতেও পারে।
৬) আমাদের প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়ে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করে কোয়ারেন্টাইন বজায় রাখতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছেন। গরিব দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটাও তার জন্য অনেক বড় সিদ্ধান্ত ছিল।
এটি মনে রাখা দরকার, চীন ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশ শতভাগ লকডাউন বা কমিউনিটি ট্রান্সমিসান ঠেকাতে পারেনি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এটি করা সম্ভব না। কানাডাতেও অনেক মানুষ বাইরে গিয়েছেন, এখন অনেকেই ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু বড় দেশ ও জনসংখ্যা কম হওয়ায় এখানে না চাইলেও অনেক সময় ছয় ফিট দূরত্ব থেকেই যায়, তাই সেই তুলনা বাংলাদেশের সঙ্গে করলে তো হবে না। যদিও মনে করছি মৃত্যুর হার কম, কিন্তু আমি মনে করছি না আমাদের সংক্রমনের হার কম।
যেহেতু আমাদের টেস্টের সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতে অনেক কম, তবুও দেখবেন টেস্টের অনুপাতে পজিটিভ রোগীর সংখ্যা পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশে অন্যতম বেশি। সেই হিসেবে আমাদের দ্রুত হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছে যাবার যে ধারণা, তা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
করোনাভাইরাসে মৃত্যু কম হবার পেছনে দেশের মানুষের ভূমিকা আছে কি?
অবশ্যই আছে। এত ছোট একটি দেশে বিশাল সংখ্যক মানুষের বসবাস, সেখানেও এই ভাইরাসকে রুখে দেবার জন্য জনগণের একটা বড় অংশের সদিচ্ছা ছিল দেখার মতো। কোটি কোটি মানুষ সপ্তাহর পর সপ্তাহ ঘরে বসে থেকেছেন। গরিব মানুষ বাধ্য হয়ে বাইরে গেছে। কিছু সহজ সরল মানুষ আড্ডা ও চা খেতে বাইরে গেলেও মাস্ক পরার চেষ্টা করেছেন। অনেকের অনেক গাফিলতি ছিল, সচেতনার অভাব ছিল, হয়ত অনেকের ইচ্ছার অভাবও ছিল। কিন্তু সার্বিকভাবে দেশের মানুষের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ দিতেই হবে। শতভাগ মানুষ টানা ১৪ দিন ঘরে থাকতে পারলে ভালো হতো, না হলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কোনভাবেই পুরোপুরি ঠেকানো যায় না। তাই অবশ্যই বাংলাদেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে, কিন্তু আবার অনেক মানুষ ঘরে থেকে নিজে আক্রান্ত হননি এবং অন্যকে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন। একই সময়ে অনেকের করোনা হয়েছে, তারা ইমিউনিটি পেয়েছেন। এই সাফল্যের কৃতিত্বের ভাগীদার দেশের মানুষ তো বটেই। এত ঘনবহুল একটা দেশে আমরা তো কখনও এভাবে গৃহবন্দি হবার পরিস্থিতিতে পড়িনি আগে কখনও।
সামনে কী আসছে?
সত্য কথা হচ্ছে, আমরা যারা জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি, যারা পলিসি নিয়ে কাজ করেন, যারা গবেষণা করেন, যারা রাজনীতি করেন, যারা চিকিৎসা দেন, আমরা সবাই যদি আপনাদের কাছে সৎ থাকি, তাহলে বলতে হবে, সামনে কী হবে আমরা জানি। আমরা জানি এই ভাইরাসের আগের যে চারটি ধরণ, যার কারণে সর্দি কাশি হয়, সেগুলো কিন্তু পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি, বরঞ্চ বেশ ভালোভাবেই রাজত্ব করছে। তাই আমরা জানি না—
১) ভ্যাকসিন তৈরির যে প্রক্রিয়া তা এক্ষেত্রে কার্যকর হবে কিনা?
২) হলে তা কি একজনকে আজীবনের জন্য রোগমুক্তির নিশ্চয়তা দিবে?
৩) সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষের সবাইকে কি এই ভ্যাকসিন আদৌ দেওয়া যাবে? গেলে কবে নাগাদ?
৪) কোন ঔষুধ আবিষ্কারে পথে নেই। আমেরিকায় যে ঔষধ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, remdesivir, তাকে করোনার ওষুধ কোনোভাবেই বলা যায় না, এবং এর কার্যকারিতা খুব ভালো তো দূরের কথা, কেবলমাত্র ঠেকা দেবার উপযুক্ত বলা যায় হয়ত।
৫) পৃথিবীতে এখনও মাস্ক, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ বেড, হাই ফ্লো অক্সিজেন সরঞ্জাম প্রয়োজনের চাইতে অনেক কম।
৬) মহামারিতে সেকেন্ড ওয়েভ, থার্ড ওয়েভ স্বাভাবিক। আগামী শীতে আমাদের খুবই কড়া নজর রাখতে হবে করোনার আবার উপদ্রব হয় কিনা।
৭) পৃথিবীর অর্থনীতি ধসে গেছে। সামনে স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত দেশে দ্রুত ভালো হলেও, বেশিরভাগ দেশে পরিবর্তনের সম্ভাবনা অনেক কম। উপরন্তু ভঙ্গুর অর্থনীতির জন্য উন্নত দেশের অর্থে নির্ভরশীল দেশের জন্য তেমন আশার বাণী নেই বললেই চলে।
এবার করোনাভাইরাসের রহস্য নিয়ে একটু বলি।
সার্স একটি খুবই কম আলোচিত রোগের নামঃ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের রহস্য থেকেই গেছে!
২০০২ সালের শীতে প্রথম সংক্রমণ হয় সার্সের। তখন ধারণা করা হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লুর পর সার্সই হতে যাচ্ছে সবচেয়ে বড় মহামারি পৃথিবীজুড়ে। ২০০২ সালে প্রথম ধরা পড়ার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সার্সের কথা ঘোষণা করে, এবং পৃথিবীকে বড় ধরণের দুর্যোগের জন্য সতর্ক করে। সারা পৃথিবীতে সার্স নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যে ৫ জুলাই ২০০৩ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায় সার্সকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কেইস পাওয়া গেলেও ২০০৪ এর পর আর কোন সার্স রোগী পাওয়া যায়নি। অথচ সার্সের জন্য কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে সারা পৃথিবীর মানুষকে সেই ভ্যাকসিন দেয়াও হয়নি।
যদিও সার্স শুধুমাত্র লক্ষণ প্রকাশ পেলেই ছোঁয়াচে বলে জনস্বাস্থের সামাজিক ও আচরণগত বিজ্ঞানীদের নির্দেশনায় টেস্টের মাধ্যমে কেইস নির্ধারণ, আইসোলেসন, কোয়ারেন্টাইন, কন্টাক্ট ট্রেসিং (অর্থাৎ কার কার সাথে দেখা হয়েছিল, যাদের মধ্যে ছড়াতে পারে), কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ে প্রাপ্ত মানুষদের আলাদা করে রোগ ছড়ানোর চেইন ভাঙার মাধ্যমে সার্স আটকে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু গণহারে ভ্যাকসিন ছাড়া এটি নির্মূল হয়ে যাওয়া এখন পর্যন্ত একটি রহস্য।
আশার কথা হোক কিছুটা
তাহলে করোনাভাইরাস নির্মূল হচ্ছে না, অন্তত সহসা। তাহলে কি কোনো আশার বাণী নেই? আছে। কী সেগুলো?
১) পৃথিবী ইতিমধ্যেই হার্ড ইমিউনিটির দিকে এগিয়েছে।
২) আশঙ্কার চাইতে সারা বিশ্বে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অনেক অনেক কম এখন পর্যন্ত।
৩) মানুষ অনেক বেশি সচেতন হয়েছে, সরকারগুলো যার যার সামর্থ্য নিয়ে যে ব্যবস্থা নিয়েছে তাতে পৃথিবির অর্থনীতির কোমর ভেঙে গেলেও মানুষের জীবন যে তারা গুরত্ব দিয়ে দেখে তা প্রমাণিত হয়েছে।
৪) করোনা প্রতিরোধের মূল মন্ত্র এখনও মানুষের কাছে। নিয়মিত হাত ধুয়ে, দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিকতা বজায় রাখলে, পুষ্টিকর খাবার খেলে, প্রতিবেশীর চাইতে পরিবারকে বেশি গুরুত্ব দিলে, স্বাস্থ্যাভ্যাস বজায় রাখলে ভালো থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি বেড়ে যায়।
৫) পৃথিবী সারা জীবন আটকে রাখা সম্ভব না। সবকিছু আস্তে আস্তে খুলে যাবে। সেটি নিয়ে হৈ চৈ না করে নিজের জীবনপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা সম্ভব। বিলাসী আচরণ ত্যাগ করে সমাজ, দেশ ও সমাজের গরিব মানুষদের সহায়তায় স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে এগিয়ে এসে একে অপরকে বাঁচতে সহায়তা করা যায়।
৬) সরকার সব খুলে দিলেও আপনি পরিমিত জীবনযাপন করলে সব জায়গায় যাওয়া আপনার জন্য জরুরি নয়।
৭) যাদের বয়স বেশি কিংবা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ফুসফুস, যকৃতে প্রদাহ আছে তাদের ঘরে রেখে অন্যরা সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাজে সংশ্লিষ্ট হতে পারেন।
৮) করোনা একেবারে যাবে না। কানাডার মতো উন্নত দেশে এত কিছু করার পরও দুই মাস পরেও একটা প্রদেশে প্রায় প্রতিদিনই ৫০০ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছেন ৫০ জন করে। এটি স্বাভাবিক। বাংলাদেশেও কিছু মানুষ মারা যেতে থাকবেন, অনেক মানুষ আক্রান্ত হতে থাকবেন, এটি ঠেকানো যাবে না লক ডাউন করে, বরঞ্চ ব্যক্তিগত ও এলাকাভিত্তিক সতর্কতা এই সংক্রমণ কমিয়ে দিতে পারে অনেকাংশে।
তাই সার্বিকভাবে মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকুন। স্বাস্থ্যাভ্যাস যা গড়ে উঠেছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। আশেপাশের পরিবর্তনে, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে অহেতুক হতাশ না হয়ে নিজেকে কিভাবে মানিয়ে নিয়ে সুস্থ রাখা যায় সেই চিন্তা করতে হবে। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। অল্প খেতে হবে, অহেতুক ব্যয় কমাতে হবে দেশের ভবিষ্যতের জন্য। আগামী কয়েকবছর বিদেশে পর্যটনের টাকা নষ্ট করবেন না। বিদেশি পণ্য কিনবেন না। আপনার সামর্থ্য থাকলে সেই টাকা আপনার বাসার কাজের মানুষ, ড্রাইভার, গৃহ কর্মী, রিকশাওয়ালাকে প্রয়োজনের চাইতে বেশি দিয়ে উপকার করুন। শুধু অনলাইনে বা অজানা অচেনা দাতব্য সংগঠনে টাকা দিয়ে সাহায্য করার চাইতে সবাই যদি নিজের চারপাশের মানুষগুলিকে সুস্থ রাখেন, তাতে সবাই ভালো থাকবে।
পজিটিভ থাকুন। পজিটিভ আলাপ করুন। পরচর্চামুক্ত জীবনযাপন করুন।
শামীম আহমেদ: সোশাল এন্ড বিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টো
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments