করোনাভাইরাসের উৎস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের ‘শীতল যুদ্ধ’

Coronaviru
ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের উৎস নিয়ে শুরু থেকেই চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে যুক্তরাষ্ট্রের। সম্প্রতি, নাটকীয়ভাবে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।

শীর্ষ কূটনীতিকরা বলছেন, গত ৪০ বছরের মধ্যে এবারই দুই দেশের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে নেমেছে। এমন পরিস্থিতিকে অনেকে ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’ বলছেন।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, গত এক সপ্তাহ ধরে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ওপর ব্যাপক কূটনৈতিক চাপ তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওসহ দেশটির অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস উহানের ল্যাবে তৈরি হওয়ার তত্ত্ব প্রচার করেছেন।

এমন অভিযোগ শুরু থেকেই প্রত্যাখ্যান করে আসছে চীন। গত বুধবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, নির্বাচনী কৌশল হিসেবে রিপাবলিকানরা চীনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘রিপাবলিকানদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, ভাইরাসের কারণে তারা চীনকে আক্রমণ করেই চলছেন। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ জানাই, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো বন্ধ করুন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করবেন না। নিজেদের দেশের সমস্যার দিকে নজর দিন। এ সময় আপনাদের উচিত দেশের মহামারি মোকাবিলায় মনোযোগী হওয়া।’

হুয়া আরও জানান, পম্পেও গণমাধ্যমে যেসব তথ্য দিয়েছেন সেগুলোর কোনো প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি।

তার মতে, ‘পম্পেও কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবেন না কারণ তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। এই বিষয়টি যাচাইয়ের দায়িত্ব বিজ্ঞানীদের। বিজ্ঞানীরাই এ নিয়ে কথা বলবেন। দেশের রাজনৈতিক প্রয়োজনের বাইরে এসে ভাইরাস নিয়ে কথা বলা রাজনীতিবিদদের কাজ না।’

সিএনএন জানায়, ল্যাব থেকে ভাইরাস ছড়ানোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে মার্কিন রাজনীতিবিদদের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়েছে।

এমনকী, গণমাধ্যমে মাইক পম্পেওকে ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি আক্রমণও করা হয়েছে। চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিসিটিভি তাকে ‘উন্মাদ’ ও ‘দুষ্টলোক’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে খবর প্রচার করেছে।

রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া তাকে ডেকেছে ‘মিথ্যাবাদী’ ও গ্লোবাল টাইমস তাকে ‘নৈতিকতা হারানো নেতা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

বেইজিং শুরু থেকেই জোর দিয়ে বলেছে করোনাভাইরাসের উৎস নিয়ে তারা কোনো কথা বলবেন না কারণ এ বিষয়টি বিজ্ঞানী ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করবে।

তবে, ভাইরাসটির উৎপত্তি সম্পর্কে আন্তর্জাতিকভাবে স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানানো হলেও তাতে সায় দেয়নি চীন। চীনের দাবি, আন্তজার্তিক তদন্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

প্রার্দুভাব মোকাবিলায়, বিশেষ করে শুরুর দিকে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার স্বীকার হয় চীন সরকার। জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ও সংকট নিয়ে মিথ্যা তথ্যের অভিযোগও উঠে চীনের বিরুদ্ধে। তবে, বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে চীন।

গত মার্চে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পসহ মার্কিন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা করোনাকে ‘চীনা ভাইরাস’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ায় চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিজিয়ান টুইটে বলেন, ‘মার্কিন সেনাবাহিনীই উহানে করোনাভাইরাস এনেছে।’

সম্প্রতি, কোভিড-১৯ এর মূল উৎস সন্ধান চীনের অভ্যন্তরীণ গবেষকদের জন্যও কঠিন হয়ে পড়েছে। গত মাসে চীন সরকার এ জাতীয় প্রতিবেদন প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুসন্ধান ও অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ না করার নিয়ম চালু হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা যা বলছেন

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে ২৭ জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চীনের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’কে প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারা জানান, বন্যপ্রাণী থেকেই ভাইরাসটি ছড়াতে পারে।

হোয়াইট হাউজ টাস্ক ফোর্সের সদস্য ডা. অ্যান্টনি ফউসি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে জানান, ভাইরাসটি কোনো প্রাণী থেকে ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি।

তিনি বলেন, ‘বাদুড়ের দেহে ভাইরাসের বিবর্তন ও নতুন করোনাভাইরাসটিকে যাচাই করার পর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ খুব দৃঢ়ভাবে দাবি করেছে যে, এটা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়নি। এই ধরনের মিউটেশন প্রাকৃতিকভাবেই হয়েছে।’

গত ১৭ মার্চ নেচার মেডিসিনে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার এক দল সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ জানান, ভাইরাসটির জিনোমিক তথ্য বলছে সার্স-কোভ-২ ল্যাবে তৈরি করা অসম্ভব।

অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, বাদুড়ের দেহেই ভাইরাসটির উৎপত্তি। তবে মধ্যবর্তী হোস্ট হিসেবে বনরুইয়ে ভাইরাসটি ছড়িয়ে থাকতে পারে।

প্রাথমিকভাবে চীনা কর্তৃপক্ষ উহানের একটি সামুদ্রিক মাছের পাইকারি বাজারে প্রথম আক্রান্ত মানুষকে শনাক্ত করে। ওই বাজারের কর্মী ও ক্রেতাদের মধ্যে ভাইরাসটির সংক্রমণ দেখা দেয়। এরপর থেকেই ভাইরাসটির সঙ্গে চীনকে জড়িয়ে বিভিন্ন ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ তৈরি হয়।

বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি

উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি থেকেই নতুন করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের দেশগুলো।

উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজিতে ‘ক্লাস ৪ প্যাথোজেন’ (পি-৪) নিয়ে গবেষণা করা হয়। পি-৪ হলো এমন জীবাণু, যা একজন থেকে অন্যজনের শরীরে দ্রুত সংক্রমিত হতে পারে।

ফ্রান্সের সহায়তায় ২০১৫ সালে ইনস্টিটিউটের পি-৪ গবেষণাগারটি তৈরি হয়। গবেষণার কাজ শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে। ২০০২-০৩ সালে সার্স করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর সর্তকতা হিসেবে সংক্রামক রোগের প্রস্তুতির জন্য ওই ল্যাবটি তৈরি করা হয়। ভাইরাসের অ্যান্টিবডি, ওষুধ, ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা ও তৈরির জন্য ল্যাবটিতে নানা ধরনের পরীক্ষা করা হতো।

মার্চ মাসে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন কর্মকর্তারা ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি পরিদর্শন শেষে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কথা ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিলেন। তারা সেসময় বাদুড় থেকে সংক্রমিত ভাইরাস সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রকে সর্তক করেন।

কর্মকর্তারা সেসময় জানিয়েছিলেন, ‘ল্যাবটি পরিচালনার জন্য যোগ্য টেকনিশিয়ান নেই। পরীক্ষার জন্য এখানে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা প্রয়োজন।’

সেখানকার ল্যাবে বাদুড় থেকে ছড়ানো করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করা হতো। সার্স যে প্রাকৃতিকভাবে প্যাথোজেনের মাধ্যমে ছড়িয়েছে সেটি ওই ল্যাবে পরীক্ষা করেই আবিষ্কার করেছিলেন চীনের বিখ্যাত ভাইরোলজিস্ট শি জেংলি।

করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণার কারণে সম্প্রতি ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন তিনি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শি বলেন, ‘আমি জীবন বাজি রেখে বলতে পারি, এটা ল্যাব থেকে ছড়ায়নি।’

Comments

The Daily Star  | English

Iran's underground Natanz site hit during Israel strikes: UN nuclear watchdog

Israel says conducted 'extensive strikes' in Iran's west, while explosions near Tel Aviv, sirens blare across Israel; smoke rises after explosion in Iran’s Tabriz

9h ago