মা পাশে ছিলেন বলেই...

নিগার নিজে যত না কষ্ট করেছেন, তার চেয়ে বেশি করেছে তার পরিবার। নানা রকম সামাজিক বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করেছে তার পরিবার। সমাজের অনেক লোকই স্বাভাবিক দৃষ্টিতে নিতে পারত না সেসব। কানাঘুষা তো চলত নিয়মিতই। আর এসব কিছু সামাল দিয়েছেন তার মা সালমা হক।
nigar sultana

ক্রিকেট বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। এ ব্যাপারে কারও হয়তো দ্বিমত নেই। দেশের প্রায় সব মানুষ খোঁজ-খবর রাখেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের। তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমদের মাঠে খেলতে দেখে তারা রোমাঞ্চ অনুভব করেন। কেবল তা-ই নয়, মাঠের বাইরে ক্রিকেটাররা কে-কী করছেন, সেসব গল্প শোনার ব্যাপারেও দেশের মানুষের আগ্রহ অনেক। আর পাদপ্রদীপের আলোয় সাধারণত থাকে ছেলেদের দল। সে যা-ই হোক। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশব্যাপী চলমান এই অচলাবস্থায়, দ্য ডেইলি স্টার যোগাযোগ করেছে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের সঙ্গে। পেশা হিসেবে ক্রিকেটকে বেছে নেওয়ার পেছনে তাদের যে লড়াই ছিল, কষ্ট ছিল কিংবা যে কারণগুলো তাদের খেলোয়াড় হওয়ার পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে, সেসব তুলে ধরার প্রচেষ্টা থেকে।

দ্বিতীয় পর্বে উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান নিগার সুলতানা জ্যোতির গল্প উপস্থাপন করা হচ্ছে পাঠকের সামনে, যিনি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর ঠিক আগেই শেষ হওয়া নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক ব্যাটসম্যান ছিলেন।

যখন একটু একটু করে হাঁটতে শিখেছেন, তখন থেকেই ব্যাট, বল নিগারের প্রিয় খেলনা। শুরুর দিকে বড় ভাইদের সঙ্গে যোগ দিতেন ক্রিকেট খেলায়। ধীরে ধীরে তা পরিণত হয় নেশায়। তারপর অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে এখন ক্রিকেটই তার পেশা। কিন্তু শুরুটা এত সহজ ছিল না।

নিগার নিজে যত না কষ্ট করেছেন, তার চেয়ে বেশি করেছে তার পরিবার। নানা রকম সামাজিক বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করেছে তার পরিবার। কারণ, একে খেলাধুলার হাতেখড়িটা পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলে, তার ওপর শেরপুরের মতো ছোট্ট মফস্বল শহরে অনুশীলনের জন্য ক্রিকেটীয় সরঞ্জাম বহন করে মাঠে যাওয়া ছিল বেশ ঝক্কির কাজ। সমাজের অনেক লোকই স্বাভাবিক দৃষ্টিতে নিতে পারত না সেসব। কানাঘুষা তো চলত নিয়মিতই। আর এসব কিছু সামাল দিয়েছেন তার মা সালমা হক।

শুরুর দিকে পরিবার কতটা সংগ্রাম করেছে তা বর্ণনা করতে গিয়ে কিছুটা আবেগী হয়ে পড়েন নিগার, ‘শুরুতে সবদিক থেকেই অনেক বাধা ছিল। আমাকে দারুণভাবে সমর্থন করেছে পুরো পরিবার, তাই আমার কাছে তেমন বাধা মনে হয়নি। তবে তারা বুঝতে পেরেছে, বাধাটা কী, ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে নেওয়া একটা মেয়ের জন্য কত কঠিন। চারদিকে নানা কানাঘুষা চলত। অনেকে কটু কথাও বলেছে।’

নিগারের জন্য ক্রিকেটার হয়ে ওঠাটা কঠিন ছিল আরও একটা কারণে। পড়াশোনাতেও মেধার ছাপ রেখেছিলেন তিনি। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পেয়েছেন, বৃত্তি পেয়েছেন অষ্টম শ্রেণিতেও। এরপর খেলাধুলায় মনোযোগী হওয়ায় সে অর্থে আর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি। তবে পরিবারের আপত্তি ছিল না তাতে, ‘আমি পড়াশোনাতে বেশ ভালো ছিলাম। চাইলে অন্য কোনো অঙ্গনে ভালো কিছু হতে পারতাম। কিন্তু তারপরও আমি ক্রিকেটার হতে চাইলে আমার পরিবার আমাকে সমর্থন করেছে। আর ক্রিকেটের সরঞ্জাম কেনার যে খরচ তা সব দিয়েছে। আমাদের মতো পরিবারে এ ধরনের খরচ অবশ্যই অন্য কোনো দিক থেকে টাকা বাঁচিয়ে তারপর করতে হয়েছে।’

২০১৪ বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দলে জায়গা না পেয়ে মন ভেঙে গিয়েছিল নিগারের। মায়ের অবদানের কথা জানতে চাইলে ওই সময়ের স্মৃতিগুলোই তুলে ধরেন তিনি। তখন তার মা পাশে থেকে সাহস তো যুগিয়েছেনই, নিজেই নিয়ে গেছেন অনুশীলনে। কেউ যাতে কিছু বলতে না পারে তাই মাঠে বসে থেকেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ‘২০১৩ সালে প্রথম জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পাই। ২০১৪ সালেও ক্যাম্পে ছিলাম, বিশ্বকাপের সময়। কিন্তু দলে সুযোগ হয়নি। তখন মনে একটা জিদ কাজ করেছে, যে করেই হোক ২০১৫ সালের মধ্যে আমি জাতীয় দলে ঢুকবই। যত কষ্ট করতে হয় করব। তো আমার কোচ (মোখলেসুর রহমান) স্বপন স্যার আমার পেছনে প্রচণ্ড শ্রম দিয়েছেন। সকাল-বিকাল অনুশীলন করতাম। আমার আম্মু তখন স্টেডিয়ামে গিয়ে বসে থাকত। আমাকে সাহস দিত। মূলত, কেউ যেন কিছু না বলতে পারে। আম্মু রান্না করে আমাকে অনুশীলনে নিয়ে আসত। আমি দুপুরে একটা বিরতি দিয়ে খেয়ে আবার অনুশীলন শুরু করতাম। এরপর ২০১৫ সালে পাকিস্তান সফরে ডাক পাই। এইভাবে শুরু। এরপর এখন পর্যন্ত তিনটা বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছি আলহামদুলিল্লাহ্‌।’

২২ বছর বয়সী নিগারের পরিবেশটা বদলাতে শুরু করে ঘরোয়া ক্রিকেটের বড় পরিসরে খেলা শুরু করার পর। ঢাকায় প্রিমিয়ার লিগ খেলে বাড়ি ফিরে বুঝতে পেরেছিলেন পরিবর্তনটা, ‘আমার বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি বাড়ির বাইরেই থাকতেন বেশি। আমার সবকিছুর পেছনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদান আমার মায়েরই। মফস্বলের মতো একটা জায়গায় এটা খুব কঠিন ছিল। প্রথম দিকে তো খুবই বাজে কথার শিকার হতে হয়েছে আমার পরিবারকে। তবে পরে যখন আমি ঢাকাতে খেলতে গেলাম, তখন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা বদলায়। সবাই বুঝেছে যে, না, ক্রিকেট থেকেও ভালো কিছু করা যায়।’

মায়ের অবদানটা বড় করে দেখলেও ভাই সালাহউদ্দিন সম্রাটকেও নিগার কৃতিত্ব দিয়েছেন নিজের বর্তমান অবস্থানের জন্য। ছোটবেলায় তার ভাইই তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন মাঠে। পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নটাও তিনিই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন নিগারের মাথায়, ‘আমার ভাই প্রায়ই বিভিন্ন পত্রিকার ছবি এনে দেখাত। এটা সালমা (খাতুন), এটা রুমানা (আহমেদ), এটা জাহানারা (আলম)। বলত, এদেরকে দেখো। তোমাকেও একদিন ওদের সঙ্গে খেলতে হবে। এভাবেই মাইন্ডসেট তৈরি হয়ে যায় যে, আমাকেও একদিন জাতীয় দলে খেলতে হবে।’

এরপর স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক স্বপন নিগারের সামনে উন্মোচিত করেন স্বপ্নের সিঁড়ি, ‘২০০৭ সালের দিকে আমাদের ওইখানে (শেরপুর) যখন সবাই জানতে পারে যে মেয়েদের দল হচ্ছে, তখন সবাই বলত, ও (নিগার) একদিন বাংলাদেশ দলে প্রতিনিধিত্ব করবে। এরপর আস্তে আস্তে শুরু করি। শুরুতে ভাইয়া অনুশীলন করাত। স্কুলে সব ধরনের খেলায় অংশ নিতাম। হ্যান্ডবল, ভলিবলও। তখন আমার কোচ স্বপন স্যার বললেন, আমি জানি, তুমি ক্রিকেটও ভালো খেল। তুমি ক্রিকেট অনুশীলন শুরু করো। তো উনিই আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। তখন আমার ভাইয়া বললেন, তোমাকে যদি বড় পর্যায়ে খেলতে হয়, তাহলে এই অনুশীলনে হবে না, তোমাকে পেশাদার কোচিং করতে হবে। একজন কোচ দরকার যিনি সবকিছু শিখিয়ে দিতে পারবেন। তখন থেকেই শুরু করি।’

করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমানে গৃহবন্দি জীবনযাপন করছেন নিগার। তবে ফিটনেস ধরে রাখার কাজটা নিয়মিতই করছেন তিনি, ‘বিসিবি থেকে আমাদের কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করছি। তবে রমজান মাসের জন্য কিছুটা কম করছি। আগে চার সেট করলে এখন দুই সেট করছি কিংবা একদিন পর পর করছি। বাইরে অনুশীলন করার তো সুযোগ নেই। তবে বাড়ির পাশে বাবা আমাকে ছোট একটি জায়গা করে দিয়েছে ব্যাটিং করার জন্য। সেখানে বিকালে অনুশীলন করছি।’

তবে নিগার আশা করছেন যে, খুব শিগগিরই হয়তো করোনাভাইরাসের প্রভাব কমে আসবে। আবার পৃথিবী হবে আগের মতো উন্মুক্ত, ‘আশা করছি, সব ঠিক হয়ে যাবে দ্রুতই। তবে করোনার প্রভাব কাটতে কিছু সময় তো লাগবেই। তবে প্রত্যাশা, তেমন কোনো সমস্যা যেন না হয়। যেহেতু আমরা খেলা-পাগল মানুষ, তাই চাই যে, সব খেলা শুরু হয়ে যাক। যে খেলাগুলো ছিল আমাদের, সেগুলো যেন হয়। কারণ, এমনিতেই আমাদের খেলা কম। ব্যক্তিগতভাবে এখন তেমন কোনো প্রত্যাশা নেই। আগে সব ঠিক হোক।’

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago