কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরও কেন করোনার ‘হটস্পট’ পেরু?

পেরুর রাজধানী লিমার সেন্ট্রাল মার্কেটের বাইরে অপেক্ষমাণ মানুষ। রয়টার্স ফাইল ফটো

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে প্রথম থেকেই কঠোর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয় লাতিন আমেরিকার দেশ পেরু। বাড়িতে থাকার নির্দেশনা, সীমান্ত যোগাযোগ বন্ধ এমনকি কারফিউও জারি করা হয়। 

কিন্তু তবুও ঠেকানো যায়নি করোনার বিস্তার। গত সোমবার পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার। আক্রান্তের সংখ্যায় লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিলের পরই পেরুর অবস্থান।

সিএনএন জানায়, ব্রাজিল ও পেরু- এই দুই দেশ দুই উপায়ে মহামারি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সত্ত্বেও একই পরিস্থিতিতে পড়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জ্যার বলসোনারো করোনাভাইরাসের বিপদকে অস্বীকার করেন। অন্যদিকে, পেরুর প্রেসিডেন্ট মার্টিন ভিজকারা গত ১৫ মার্চ দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। সীমান্ত যোগাযোগ বন্ধ করেন। সবাইকে সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা দেন। গত ১৪ এপ্রিল থেকে পেরুতে বাধ্যতামূলকভাবে বাড়িতে থাকার নির্দেশনা কার্যকর করা হয়। 

দুই রকম নির্দেশনার পরেও উভয় দেশেই ভাইরাসটি একইরকমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পেরুর সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশটির ৮৫ শতাংশ ভেন্টিলেটরসহ আইসিইউ বেডগুলোতে রোগী ভর্তি। সামনের দিনগুলোতে অসুস্থদের সেবা না দিতে পারা নিয়ে আশঙ্কা করছে দেশটির সরকার।

পেরু মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক আলফ্রেডো সেলিস বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি কেবল স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা নয় বরং স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ে পৌঁছেছে। মহামারির আকার স্বাস্থ্যখাতের সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গেছে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেরুতে মহামারির প্রকট আকার ধারণের পেছনে একটি কারণ হলো ‘বৈষম্য’। দেশটির চিকিৎসক ডা. এলমার হুয়ার্তা বলেন, ‘আমি যা দেখছি তা হলো ভাইরাসটির বিস্তার মূলত একটি জায়গার আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে।’

পেরুর অধিকাংশ জনগণ দরিদ্র। বেঁচে থাকার জন্য তাদের বাসার বাইরে বের হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

দেশটির ২০১৭ সালের এক জরিপ বলছে, দেশটিতে ৪৯ শতাংশ বাসায় রেফ্রিজারেটর আছে (শহরাঞ্চলের ৬১ শতাংশ)। এর অর্থ হলো, দেশটির অধিকাংশ মানুষকে প্রতিদিন বাজার করতে হলেও বাইরে যেতে হবে। কারণ বাড়িতে খাবার সংরক্ষণ করে রাখার উপায় নেই।

প্রতিদিনই বাজারগুলোতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ক্রেতাদের অপেক্ষা করতে দেখা যায়। অধিকাংশেরই মুখে মাস্ক থাকলেও প্রচন্ড ভিড়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাটা একরকম অসম্ভব।

লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী বলেন, ‘আমাদের ঝুঁকি নিয়ে ভিড় সহ্য করতেই হবে। কারণ আর কোনো উপায় নেই। নইলে না খেয়ে থাকতে হবে। খাবার কিনতেই এইখানে এসেছি।’

এদিকে, করোনাভাইরাস ত্রাণ তহবিল থেকে সাহায্যের জন্যও অনেক মানুষ ব্যাংকগুলোতে ভিড় করে।

ক্যালিফোর্নিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও পেরুর অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টিয়ান লোপেজ ভার্গাস বলেন, ‘পেরুর কয়েক লাখ দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া প্রণোদনা প্যাকেজটি ভালো হলেও এর বিতরণ ব্যবস্থা দুর্বল।’

গত বছরের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশটিতে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৩৮ শতাংশের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। ফলে সাহায্য পেতে হলে অধিকাংশেরই বাড়ির বাইরে বের হয়ে ব্যাংকে যেতে হবে।

এছাড়াও পেরুর অধিকাংশ জনগণের বাসস্থান ও পেশার কারণে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা সহজ নয়।

লোপেজ ভার্গাস বলেন, ‘৩০ শতাংশেরও বেশি পরিবার গাদাগাদি পরিবেশে বাস করে। অনেক বাড়িতে একই ঘরে ৪ জনের চেয়েও বেশি মানুষ একসঙ্গে থাকে।’

পেরুর জাতীয় পরিসংখ্যান এবং তথ্য ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির অর্থনীতির ৭২ শতাংশের বেশি পেশা অনানুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে জড়িত। ফলে, দৈনন্দিন আয় করে বেঁচে থাকা মানুষের পক্ষে বাড়ির বাইরে বের না হয়ে থাকা অসম্ভব।

দেশটিতে স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের কারণে জনগণ সামাজিক দূরত্ব মানছেন না বলে দোষারোপ করেন প্রেসিডেন্ট ভিজকারা।

তিনি বলেন, ‘মহামারির সঙ্গে লড়তে হলে মানুষকে সামাজিক আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। অনেকেই আমাদের চারপাশে যা ঘটেছে সেসব উপেক্ষা করে। এই উপেক্ষা করার কারণেই পরিস্থিতি এতটা মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছেছে। এই ধরনের “স্বার্থপর” আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। এটা শুধু পেরু না, গোটা পৃথিবীর মানুষের ক্ষেত্রেই সত্য।’

তবে, জনগণের ওপরই সব দোষ চাপিয়ে দেওয়া যায় না বলে জানান লোপেজ।

তিনি বলেন, ‘মহামারির কারণে যে বৈষম্য অনেকাংশে দায়ী তা এখন ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। আমাদের উচিত বৈষম্য দূর করার ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া। অবস্থা পরিবর্তনের দিকে নজর দেওয়া।’

Comments

The Daily Star  | English

Polls no later than June 2026

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus has said that next national polls will be held within June 2026.

1h ago