মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ: শেষ যাত্রায় সঙ্গে ছিল পুলিশ

মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ চক্রবর্তী। ফরিদপুর সদরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার ছাড়াও জড়িত ছিলেন বিভিন্ন সামাজিক কাজে। ছিলেন সদর উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি।
ফরিদপুরে মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ চক্রবর্তীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করে পুলিশ সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ চক্রবর্তী। ফরিদপুর সদরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার ছাড়াও জড়িত ছিলেন বিভিন্ন সামাজিক কাজে। ছিলেন সদর উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি।

আজ রোববার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে করোনা আক্রান্ত হয়ে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কমলেশ চক্রবর্তী ওরফে ভানু (৬৫)।

তবে তার শেষযাত্রায় বাঁধ সাধেন এলাকাবাসী। শ্মশানঘাটে দফায় দফায় বিরোধিতার মুখে পড়ে শবদেহবাহী গাড়ি। দাহ’র সময়ে পাওয়া যায়নি কারও সহায়তা। করোনায় মারা যাওয়া কাউকে অম্বিকাপুর শ্মশান ঘাটে দাহ করতে দেওয়া হবে না বলে জানায় তারা।

দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ থেকে মুক্তিযোদ্ধা কমলেশের মরদেহ পুলিশ পাহারায় একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রথমে নিয়ে আসা হয় শহরের নিলটুলীস্থ কালী মন্দির সংলগ্ন বাড়ির সামনে। সেখান থেকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় অম্বিকাপুর শ্মশান ঘাটে। সেখানেই মুক্তিযোদ্ধা কমলেশের দাহপূর্ব গান স্যালুট অনুষ্ঠিত।  

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) রাশেদুল ইসলাম জানান, শ্মশান ঘাটে ঢোকার পথে তারা এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে পড়েন। শ্মশানে যাওয়ার সড়কটি এলাকাবাসী আগে থেকেই বাঁশ ও কাঠের গুড়ি ফেলে আটকে রাখে। ওই সড়কে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় একজন মানুষের পক্ষে পায়ে হেঁটে ওই সড়কটি অতিক্রম করার সুযোগ ছিল না। পরে এলাকাবাসীকে বুঝিয়ে, রাজী করিয়ে মরদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এলাকাবাসী দাহ কাজের বিরোধিতা অব্যাহত রাখে।

তিনি বলেন, মরদেহ দাহ করার জন্য পৌরসভার দায়িত্বরত কোন ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আগে কাঠ পাঠানো হলেও এলাকাবাসী সে কাঠ ফিরিয়ে দেয়। তারা কোনভাবেই কভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিকে শ্মশানে দাহ করতে দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

ফরিদপুর পুলিশ লাইনস এর রিজার্ভ এসআই আনোয়ারুল ইসলাম জানান, মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো, শ্মশানে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো, কাঠ দিয়ে চিতা সাজানো এবং চিতায় মরদেহ স্থাপন সব কাজই করেছে পুলিশ সদস্যরা। এর আগে পুলিশের একটি চৌকশ দল গর্ড অব অনার প্রদান করেন।

তিনি বলেন, কীভাবে ধর্মীয় রীতি মেনে চিতা সাজাতে হয়, কিভাবে মরদেহ চিতায় শুইয়ে দেওয়া হয় এর কোন কিছুই জানা ছিল না। পরে একাজে নিয়োজিত পৌরসভার কর্মচারী পরিতোষ সরকারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নিয়ম কানুন জানান এবং পুলিশ সদস্যরা তা প্রতিপালন করেন। পরে মুখাগ্নি দেন মৃতের ছেলে উজ্জল চক্রবর্তী। পরবর্তীতে শবদাহের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করে পুলিশ সদস্যরা। বিকেল পৌন পাঁচটার দিকে শেষ হয় শেষকৃত্য।

নিয়ম অনুযায়ী ওই পৌর শ্মশানে যার দাহ করা হয় তার নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু শ্মশানের পরিচালনায় জড়িত কোন ব্যক্তি নামটি লিপিবদ্ধ করতে রাজী হননি। পরে এগিয়ে আসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) রাশেদুল ইসলাম। তিনি শ্মশানের খাতায় লিপিবদ্ধ করেন কমলেশ চক্রবর্তীর নাম, ৯১৩ নম্বরে।

এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ দুপুরে অম্বিকাপুর শশ্মানে নিয়ে যাওয়া হলে, সেখানে স্থানীয় কিছু জনতা তার সৎকারে বাঁধা সৃষ্টি করে, শশ্মানের চিতায় করোনায় মৃত্যুবরণকারীর দেহ দাহ হতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয়। বাক-বিতন্ডার এক পর্যায়ে সেখানে পুলিশ বাড়ানো হয়। সৎকারের কাজে শশ্মান কমিটি, সৎকার সমিতি বা হিন্দু সমাজের কোন ব্যক্তিকে পাওয়া যায়নি। উপস্থিত ছিলেন না কোন মুক্তিযোদ্ধা। পুলিশ এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানিয়ে অবশেষে তারাই মৃতের পুত্রের মাধ্যমে সনাতনী ধর্ম অনুযায়ী দাহ সম্পন্ন করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন সদর সার্কেল পুলিশ সুপার, ইউএনও সদর, কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যক্তি।

ফরিদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার নজরুল ইসলাম জামাল জানান, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা শ্মশানে শবদাহে অংশ নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসন থেকে আমাদের নিরুৎসাহিত করা হয়। মরদেহ যখন বাড়ির সামনে আনা হয় আমরা দূরত্ব বজায় রেখে তার প্রতি সম্মান জানিয়েছি।

এ বিষয়ে অম্বিকাপুর শশ্মান কমিটির সভাপতি লক্ষ্মণ দত্তের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছি, কিন্তু যাইনি। করোনা ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে স্থানীয়রা দাহে বাঁধা দিয়েছিল।

ফরিদপুর কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোর্শেদ আলম বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এলাকাবাসীর আচরণ সুস্থ, স্বাভাবিক ও মানবিক ছিল না। আমরা পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামানের নির্দেশে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ যথাযথ সম্মান জানিয়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছি ।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago